প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ১৪ এপ্রিল অনেকটা হঠাৎ করেই নিঃশর্তভাবে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। তালেবানের সাথে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করা চুক্তি অনুযায়ী আগামী পহেলা মে’র মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করার কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রত্যাহারের সময় আরও ৬ মাস বাড়িয়ে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করেছেন। এই দিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ২০ বছর পূর্ণ হবে। পহেলা মে থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রত্যাহার সম্পন্ন করা হবে। এদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তন থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হবে পাকিস্তানের জন্য এক বড় বিজয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর ৭ অক্টোবর আল কায়েদার অবস্থানে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ শুরু হয়। তালেবান সরকার আফগানিস্তানে আল কায়েদাকে নিরাপদ অবস্থানের সুযোগ দিয়েছিল অভিযোগ করে যুক্তরাষ্ট্র এই বিমান হামলা শুরু করে। এরপর মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের কিছু সদস্যকে আফগনিস্তানে পাঠানো হয় তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সহায়তা করার জন্য। তাদের সহায়তা ও মার্কিন বিমান হামলার মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলীয় জোট তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হয়।
এরপর তালেবানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য দক্ষিন আফগানিস্তানের কান্দাহার নগরীর কাছে একটি সামরিক ঘাটিতে মার্কিন সৈন্যরা আসতে শুরু করে। ২০০১ সালের শেষ দিকে সেখানে মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা ২৩০০ তে পৌছে। এরপর বাড়তে বাড়তে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা গড়ে ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজারের মধ্যে উঠানামা করে। তবে তালেবান হামলা বেড়ে যাওয়ায় এ বছরের নভেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সৈন্য সংখ্যা ৩৩ হাজারে উন্নীত করার নির্দেশ দেন। পরের বছর তা এক লাখের উপরে গিয়ে পৌছে এবং ২০১১ সালেও তা অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু কখনোই মার্কিন বাহিনী তালেবানকে পাজিত করতে পারেনি।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িত হওয়ার প্রয়োজন ছিল কিনা তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। যুক্তরাষ্ট্রেরই অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এটি একটি ব্যর্থ যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কোনই প্রয়োজন ছিলনা। আফগানিস্তানে হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য হয়তো অর্জন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ব্যাপক আকারে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এমনকি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও মনে করেন যে, আফগানিস্তানে যুদ্ধে যাওয়ার আগে কূটনীতিকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছরে লোকবল ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি। বৃটিশ, রুশদের পর আমেরিকানরাও আফগানিস্তানে আনুষ্টানিকভাবে পরাজিত হলো। তালেবানরা ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সদর দফতর পেন্টাগণের বক্তব্য অনুযায়ী বর্তমানে আফগানিস্তানে ২৫০০ সৈন্য রয়েছে। যারা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর কাজে সহায়তা ও তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে মোতায়েন করা কিছু সৈন্য রয়েছে যাদেরকে এই হিসাবে ধরা হয়নি। সেই সংখ্যাটা হাজার খানেক হতে পারে। এছাড়াও আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য আরো প্রায় ১০,০০০ ন্যাটো সৈন্য রয়েছে। যার মধ্যে ৩ হাজার মর্কিন সৈন্য। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সব সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়ার পর ন্যাটো জোট বলেছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত সময়ের সাথে মিল রেখে তাদের সৈন্যদের প্রত্যাহার করবে।
২০০১ সালে সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত আফগানিস্তানে ২ হাজার ৩১২ জন মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার ২১৮ জন যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে। আর ৯৪ জন আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষন দেয়ার কাজে নিযুক্ত থাকার সময় হামলায় মারা গেছে। অন্যদিকে এই যুদ্ধে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। পেন্টাগনের হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ সালে থেকে ২০২০ সালের শেষ সময় পর্যন্ত আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হয়েছে ৮২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিমাসে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৩ বিলিয়ন ডলার করে।
সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে কি ঘটবে তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছেনা যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাইডেন প্রশাসন আশা করছে, এই সময়ের মধ্যে আফগান সরকার ও তালেবান এই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে নিজেদের মধ্যে চলমান সংঘাতের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন , মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর দেশটিতে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
আফগান সরকার, তালেবান ও ক্ষমতার দাবিদার অন্যান্য পক্ষ সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়বে। আবারো শুরু হবে মারাত্মক গৃহযুদ্ধ। এমনকি মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর তালেবান আবারো ক্ষমতা দখল করতে পারে। দেশটিতে যুগ যুগ ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলেছে তা আবারো নতুন করে শুরু হতে পারে। ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের উপর হামলার মাত্রা বেড়ে গেছে। আফগানিস্তানে জাতিসংঘ সহায়তা মিশনের তথ্য অনযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে হামলায় ১৭০০ এর বেশি বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি।
আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশটির বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় আগামী ২৪ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে তুরস্ক সরকার এই সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সম্মেলনের সাফল্যর ওপর আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া অনেকাংশে নির্ভর করছে। তুরস্ক খুব সর্তকতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানকেও পাশে রাখার চেষ্টা করছে।
তালেবানরা আফগানিস্তানের অর্ধেক অংশই নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যদি আঙ্কারা সম্মেলনে যোগ না দেয় বা বর্জন করে তাহলে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের সুযোগ হারাবে। গ্রুপটি ২০১৩ সাল থেকে কাতারের রাজধানী দোহায় তাদের রাজনৈতিক অফিস খোলার পর থেকে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। আঙ্কারা সম্মেলনের সাথে জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, তালেবান যদি ভবিষ্যৎ আফগন সরকারের অংশ না হয়, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক সমর্থণ ও স্বীকৃতি হারাবে।
এদিকে আফগন সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তোরেক ফারহাদি মনে করেন, তালেবানরা আঙ্কারা সম্মেলনে যোগ দেবেনা। তারা প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সাথে এক টেবিলে বসে আলোচনা করতেই রাজী নয়। বরং মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর তারা স্থানীয় নেতাদের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করবে। এভাবে তারা প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে দুর্বল করার চেষ্টা করবে। আশরাফ ঘানি বিকল্প যে শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত একটি অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হবে এবং তিনি সেই সরকারের প্রধান থাকবেন। তালেবান তার এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যন করেছে।
সৈন্য প্রত্যাহারের নতুন সময়সূচি ঘোষণার পরদিনই মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন হঠাৎ করেই আফগানিস্তানে গিয়ে হাজির হন। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ও শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতেই তিনি দিনের এই অঘোষিত সফরে কাবুলে পৌছেন। নেতাদের সাথে আলোচনা শেষে বিকালে কাবুলে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তালেবানকে এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তারা যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বর্জন করে শক্তি প্রয়াগের মাধ্যমে দেশ দখলের চেষ্টা করে তাহলে তারা বৈধতা হারাবে এবং তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
এর আগে তালেবানের উপর পরোক্ষ চাপ সৃষ্টির লক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সাথে টেলিফোনে কথা বলেন। তালেবানের শীর্ষ নেতারা বতৃমানে পাকিস্তানে অবস্থান করেন। তারা যাতে আঙ্কারা সম্মেলনে যোগদান করেন সেজন্য তাদের উপর চাপ সৃস্টি করতেই ব্লিনকেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের কাছে ফোন করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের সৈন্য প্রত্যহারের ঘোষণার পর সবচেয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন বর্তমান আফগান সরকারের ওপর যতটুকু ভারতের প্রভাব আছে তালেবানরা ক্ষমতায় আসলে তা থাকবে না। এমনকি তালেবানরা কাশ্মীরের সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবদনে বলা হয়েছে যে, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানই লাভবান হবে। পাকিস্তানের ঘাড়ের উপর যুক্তরাষ্ট্র এসে চেপে বসায় ইসলামাবাদ যে অস্বস্তিতে ছিল তা অনেকটাই স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ায় পাকিস্তান এখন স্বস্তির নি:শ^াস ফেলবে।
প্রতিবদনে বলা হয়েছে যে, আফগনিস্তানে সামরিক অভিযানে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেমন ছিল, তেমনি তালেবানকে সার্বিক সহায়তা দিয়ে মার্কিন বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতেও তদের ভূমিকা ছিল। ২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের আগেও তালেবানের সাথে পাকিস্তানের গোয়েন্দ সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তালেবান সক্রিয় রেখে পাকিস্তান আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব বিস্তারের পথকে যেমন ঠেকিয়ে দিয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকেও পরাজয়ের গ্লানি বহন করে সরে যেতে বাধ্য করেছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে , আফগানিস্তানে তালেবান আবারও ক্ষমতায় আসলে পাকিস্তানের উগ্রপন্থি দলগুলোও অনেক বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। সেটা পাকিস্তানের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে।