ফ্রান্সকে বলা হয় কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু আসলেই কি তাই? ফরাসি সরকার দেশটির প্রায় সব ক্যাথলিক গির্জার খরচ বহন করে থাকে। ইহুদিদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের খরচ দিতেও কার্পণ্য করে না। তবে দেশটিতে ৬০ লাখের মতো মুসলমান বাস করলেও একটি মসজিদও সরকারি সহায়তা পায় না। নতুন একটি আইনের কারণে মসজিদ নির্মাণ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
হিমশীতল ঠান্ডার মধ্যেই সাম্প্রতিক এক শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য সাবেক একটি কসাইখানায় সমবেত হয়েছিলেন শত শত ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ভেতরে জায়গা না পেয়ে বহু লোক বাইরে জায়নামাজে বসে লাউডস্পিকারে ইমামের বয়ান শুনছিলেন।
পশ্চিম ফ্রান্সের অ্যাঞ্জার্স শহরের এই সাবেক কসাইখানাটি ২১ বছর ধরে অস্থায়ী মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখানে একটি স্থায়ী ভবন নির্মার্ণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত শরত থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। মসজিদটি নির্মাণের জন্য মুসলিমরা ২৮ লাখ ডলার চাঁদা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই টাকায় নির্মাণ শেষ হতো না। তাই নির্মাণাধীন মসজদটি মরক্কো সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুসলিম নেতারা। কিন্তু সিটি কাউন্সিলের সদস্যরা সর্বস্মতভাবে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে ।
ফ্রান্সে যখন মুসলিমদের ‘সুসময়’ ছিল তখনও মসজিদ নির্মাণ ছিল দুরূহ কাজ। আইন অনুযাযী মসজিদ নির্মাণ করতে চাইলে মুসলিমদের অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে গরীব হতে হবে। বিদেশি অর্থ সহায়তা নিতে চাইলেই বাধা আসে। অনেক সময় মুসলিমরাও তাদের মসজিদ বিদেশি সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে থাকেন।
প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নতুন যে আইন করেছেন তাতে বিদেশী সহায়তার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। লেইসিটে নামে পরিচিত ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি মুসলিমদের জন্য জটিলতা তৈরি করেছে। এটা গির্জা ও ধর্মকে পৃথক করেছে। ফ্রান্স সরকার সব ধর্মের ব্যাপারেই কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলে বলে দাবি করলেও এ সংক্রান্ত আইন জোরালোভাবে দেশটির ক্যাথলিকদের পক্ষে।
সরকার ক্যাথলিক গির্জার জন্য উদারহস্তে জায়গা বরাদ্দ দেয়, তাদের পেছনে টাকা খরচ করে এবং রোমান ক্যাথলিক সংস্কৃতির অভিভাবক।
১৯০৫ সালের একটি আইনে কোনো ধর্মীয় ভবন তৈরির জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা যায় না। কিন্তু ওই আইন অনুসারে ওই সময়ের আগে নির্মিত সব ধর্মীয় স্থাপনা সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। সরকার সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং সেখানে বিনা পয়সায় ধর্মকর্ম পালনের ব্যবস্থা করে দেয়। ওই আইন বলে ক্রমক্ষয়িষ্ণু ক্যাথলিক ধর্মের জন্য সরকার জনগণের করের টাকা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ফ্রান্সের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান ধর্ম ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য কিছুই করা হয় না।
১৯০৫ সালে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত আইনটি তৈরি করা হয় তখন ফ্রান্সে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল নগণ্য। উনিশ’ সত্তরের দশক থেকে সেখানে মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালের একটি সিনেট প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ৬০ লাখ বলে মনে করা হয়। এ হিসেবে তারা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ লাখ লোক দেশটিতে ২৫০০ মসজিদে যায় নামাজ আদায় করতে। এগুলো সাধারণত কোনো সরকারি সহায়তা পায় না।
বিপরীতে ফ্রান্সে ধর্মাচারী ক্যাথলিকের সংখ্যা ৩২ লাখ। তাদের জন্য গির্জা আছে ৪৫ হাজার। এর মধ্যে ৪০ হাজার গির্জাই সরকারি মালিকানাধীন। জনগণের করের টাকায় সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বলে ওই সিনেট রিপোর্টে বলা হয়।
ওই আইনের ফলে শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই বৈষম্য নয়, ক্যাথলিকরা প্রাইভেট স্কুল সরকারি ভর্তুকি থেকে শুরু করে দানের ক্ষেত্রে বহুবিধ সুবিধা পেয়ে থাকে। ম্যাক্রোঁ ‘ফ্রান্সের ইসলামকে’ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কথা বললেও দেশটিতে তো মসজিদ সংকটই তীব্র। ইমাম সৈয়দ আইত লামা জুমার নামাজের আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এটা একটা প্রহেলিকা।
মসজিদ নির্মাণে সাধারণত কোনো সরকারি সহায়তা নেই। মুসল্লিরাও নিজেদেও টাকায় মসজিদ বানাতে সক্ষম হন না। এ অবস্থায় মুসলিম সম্প্রদায় বিদেশি সরকারের সহায়তা নিয়ে মসজিদ নির্মাণ করে থাকেন। তবে ম্যাক্রোঁর নতুন আইনে এটা আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে। তথাকথিত ইসলামবাদ ঠেকাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও বিদেশি সহায়তা প্রবাহে লাগাম টানার জন্য তিনি এ আইন করেছেন।
সম্প্রতি ফ্রান্স সরকার বলেছে, নতুন আইনে দেশটির আলসেকের স্ট্রসবার্গে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণে সরকারি সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণেই সেখানে ওই মসজিদটি সরকারি ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গেরাল্ড দার্মানিন মসজিদটিতে সরকারি সহায়তা বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ দিয়েছেন। তার দাবি, মসজিদটির সঙ্গে তুরস্ক সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফ্রান্সের সঙ্গে সম্প্রতি তুরস্কের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে।
নতুন আইনটি প্রনয়নের আগেই অ্যাঞ্জার্সের সিটি কাউন্সিল একটি মসজিদকে মরক্কো সরকারের কাছে হস্তান্তরের বিরোধিতা করেছে। তারা রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত বিধিবিধানের দোহাই দিয়ে একাজ করেছে।
নতুন আইনে কেন্দ্রীয় সরকারকেও একই ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে বিদেশি সরকারের কাছে হস্তান্তর করাকে ফ্রান্স সরকার হুমকি মনে করলে তাতে বাধা দিতে পারবে। ম্যাক্রোঁর দাবি, তরুণদের জঙ্গিবাদ থেকে ফেরাতে নতুন আইনটি দরকার।
ফ্রান্সে জঙ্গি হামলায় ২০১৫ সাল থেকে আড়াইশর’ মত লোক নিহত হয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, নতুন আইনে মুসলিমরা বিচ্ছিন্নবোধ করবে। এমনকি ফ্রান্সের ক্যাথলিক গির্জার নেতারাও বলেছেন যে দেশটিতে মুসলিমরা অসুবিধাজনক অবস্থায় আছেন।
ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় আর্চবিশপ ও ক্যাথলিক নেতা এরিক ডি মৌলিন্স -বোফর্ট বলেছেন, ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও ১৯০৫ সালের আইনটির বলে ক্যাথলিকরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মুসলিমরা ফরাসি সমাজে বড় ধরনের অবিচারের মুখোমুখি। তাদের ধর্মীয় প্রয়োজনের দিকে নজর দেয় না রাষ্ট্র।
ওই আইনের ফলে একশ বছরের বেশি সময় পরও ৯০ শতাংশ ক্যাথলিখ গির্জার খরচ সরকার বহন করে থাকে বলে সিনেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের ১২ ভাগ গির্জা ও ইহুদিদের ৩ ভাগ সিনাগগের খরচও সরকার দেয়। কিন্তু একটি মসজিদও সরকারি সহায়তা পায় না।
এক সাক্ষাৎকারে ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি বলেন, এক্ষেত্রে ফ্রান্সে যথেষ্ট ভণ্ডামি রয়েছে। দাবি করা হয়, ফ্রান্স সরকার কোনো ধর্মের জন্য অর্থ খরচ করে না। কিন্তু ১৯০৫ সালের আইনের বলে খ্রিস্টানদের প্রায় সব ধর্মীয় স্থাপনা সরকারি অর্থ সহায়তা পায়। তবে সরকার এক্ষেত্রে মোট কত টাকা খরচ করেছে তার হিসাব পাওয়া যায় না। কারণ খরচটা হয় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাড়া মেলেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী সহায়তা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় অনেক মসজিদের নির্মাণ কাজ বিলম্বিত কিংবা পরিত্যক্ত হয়েছে। যেমন অ্যাঞ্জার্সের সেই মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ৪০ বছর আগে। প্রথমে মুসলিমরা একটি গ্যারেজে নামাজ আদায় করতেন। পরে শহর কর্তৃপক্ষ সাবেক একটি কসাইখানা তাদেরকে বরাদ্দ দেয়। সেখানে কিছু অর্থ সহায়তাও দিচ্ছে কর্র্র্র্তৃপক্ষ।
২০১৪ সালে এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্বোধন করা হয় যেখানে একসময় ২৫০০ লোক নামাজ আদায় করতে পারবেন। এজন্য তারা ২৮ লাখ ডলার চাঁদাও তুলেছিলেন। কিন্তু তা অপ্রতুল হওয়ায় এক পর্যায়ে মসজিদটি নির্মাণের জন্য ফ্রান্সের মিত্র মরক্কোর সহায়তা চাওয়া হয়। মরক্কোর পাশাপাশি আলজেরিয়া ও সৌদি সরকারও ফ্রান্সে অনেক মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছে।
কিন্তু এখন ফ্রান্স সরকার মনে করছে, সেখানে জঙ্গি হামলার পেছনে দেশের বাইরের প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে তারা সন্দেহ করছে বিদেশে প্রশিক্ষিত ইমামদের।
২০১৬ সালের সিনেটের প্রতিবেদনটির সহ -লেখক সিনেটর নাথালি গৌলেট বলেন, বিদেশে প্রশিক্ষিত ইমামদের ওপর কড়া নজরদারি দরকার। তবে মরক্কো, আলজেরিয়া কিংবা সৌদি আরবের সহায়তায় নির্মিত মসজিদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। মসজিদ নির্মাণে বিদেশি অর্থায়ন ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই।