রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ সম্প্রতি দুই দিনের সফরে পাকিস্তানে আসেন। গত ৯ বছরের মধ্যে রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম পাকিস্তান সফর। তার এ সফরকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি ভারত সফর শেষে পাকিস্তানে আসেন। এ সফরে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেহমুদ শাহ কোরেশির সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ল্যাভরভ বলেছেন, রাশিয়া পাকিস্তানকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করবে। এছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা নিয়েও তিনি পাকিস্তানের নেতাদের সাথে কথা বলেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এপ্রিল মাসের মধ্যে আফগনিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছে, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা দেশটি থেকে সব মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছে রাশিয়া। এজন্য আফগানিস্তানের সব পক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে মস্কোতে এরইমধ্যে বৈঠক করেছে দেশটি।
আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই উদ্যোগে পাকিস্তানকে পাশে চায় মস্কো। সার্গেই ল্যাভরভের সফরের এটি অন্যতম উদ্দেশ্য। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে যখন টানাপড়েন চলছে এবং ভারত-মার্কিন সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে, তখন রাশিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
এশিয়া হচ্ছে বৃহৎ শক্তিগুলোর জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ ও পছন্দের জন্য স্বর্ণের খনি হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে পাকিস্তানের ভূ-কৌশলগত অবস্থান দেশটির প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলোকে আকর্ষণ করে থাকে। অন্যদিকে ভূরাজনীতিতে পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ ও পছন্দকে সামনে রেখে এই অঞ্চলের দেশগুলোও তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনে থাকে। রাশিয়াও এই অঞ্চলের প্রতি এখন বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে রাশিয়াও একজন খেলোয়াড় হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছে।
পাকিস্তান এবং রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্কের কোনো ইতিহাস নেই। বরং এক সময় দেশ দু’টির মধ্যে চরম বৈরিতাই ছিল। কিন্তু কৌশলগত বাস্তবতা দেশ দু’টিকে কাছাকাছি আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে যা দুই দেশের জন্যই ইতিবাচক হতে পারে। এখন দুই দেশই তাদের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরিকে স্বাগত জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্টের উপর নির্ভরতা কমাতে ইসলামাবাদ এখন মস্কোর সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে চায়।
নানা ইস্যুতেই পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। ইসলামাবাদের উপর মস্কোর প্রভাব থাকুক এটা যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়না। কিন্তু পাকিস্তান এখন এটা প্রমান করতে চায় যে, যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কে কোনো ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয় তাহলে তাদের সামনে কৌশলগত বিকল্প পথ বেছে নেয়ার সুযোগ আছে। অন্যদিকে রাশিয়াও এই সুযোগটি নিতে চাইছে। যাতে এ অঞ্চলে তার প্রভাব আরো বাড়ে।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, এশিয়ার এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও দাপট কমে আসছে। পাকিস্তানও চাইছে না কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়ে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক পাকিস্তানকে নতুন বন্ধু ও মিত্রের সন্ধান করতে বাধ্য করেছে। এছাড়া পাকিস্তানের কৌশল হচ্ছে রাশিয়ার সাথে সর্ম্পক উন্নয়ন করে মস্কোর সাথে দিল্লির দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে ঢিলে করে দিতে। চীনের চেয়ে রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির প্রতি পাকিস্তানের আগ্রহ রয়েছে অনেক আগে থেকেই।
রাশিয়ার কাছ থেকে পাকিস্তান সামরিক ও বাণিজ্যিকসহ নানা সুবিধা পেতে চায়। যেমন করাচী থেকে লাহোর পর্যন্ত পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ও এ ধরণের অন্যান্য প্রকল্পে রাশিয়ার সহযোগিতা চায় পাকিস্তান। অন্যদিকে রাশিয়াও পাকিস্তানের ষ্টিলমিলগুলো সংস্কার করে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী।
বিভিন্ন গনমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাশিয়া সেন্ট্রাল এশিয়া-সাউথ এশিয়া সিএএসএ-ওয়ান থাউজেনড জ¦ালানী প্রকল্পে যোগ দিতে আগ্রহী। বিশ^ ব্যাংকের এই প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
অন্যদিকে কৌশলগতভাবে পাকিস্তানের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এবং আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কাছে হওয়ায় রাশিয়া পাকিস্তানের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো সীমান্ত না থাকলেও ভূরাজনৈতিক নানা বিষয়ে দুদেশের সর্ম্পক রয়েছে।
মস্কো অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানকে তার জন্য সমস্যা সৃষ্টিকারী এবং এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক একটি দেশ হিসেবে বিবেচনা করত। রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি মধ্যমপন্থি দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার ও ইসলামী উগ্রপন্থা দমন করতে পাকিস্তানকে রাজী করানো। মুসলিম বিশে^ পাকিস্তানের প্রভাব রয়েছে এবং রাশিয়াতেও বিপুল সংখ্যক মুসলমান রয়েছে।
রাশিয়া মনে করে আফগাস্তিানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মস্কো আশা করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর রাশিয়া এই অঞ্চলে একটি কৌশলগত স্থান দখল করতে পারবে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। রাশিয়া মনে করে পাকিস্তান চেষ্টা করলে আফগানিস্তানে সহিংসতা কমে আসতে পারে। অপরদিকে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ট সর্ম্পক গড়ার পেছনে পাকিস্তানও নানামুখী কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় পাকিস্তান। আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির জন্য ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দিকে অত্যধিক ঝুকে পড়ায় রাশিয়া তার সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য নতুন বাজার খুজছে।
রাশিয়া এই অঞ্চলে যে ভূমিকা রাখতে চাচ্ছে, পাকিস্তান সেই কৌশলের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেরাও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইউক্রেন প্রশ্নে বর্তমানে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তাদের বন্ধুর সংখ্যাও কম। এজন্য রাশিয়া নতুন বন্ধু খুজছে যারা রাশিয়াকে সহায়তা করতে ও তাদের পাশে থেকে পশ্চিমা বিশ^কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে।
পাকিস্তান ও রাশিয়া নানা ইস্যুতে ক্রমান্বয়ে কাছাকাছি এসেছে। ২০০৯ সালে যখন আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনীতি নিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া ও তাজিকিস্তান একটি আঞ্চলিক কাঠামো দাড় করানোর উদ্যোগ নেয়। সেই সময় মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে প্রথম যোগাযোগ স্থাপিত হয়। চার দেশের এই ধারণা নিয়ে তিনটি বৈঠক হয়। ২০১২ সালে চতুর্থ বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের সেই বৈঠকে যোগদানের কথা ছিল।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই সোইগু ২০১৪ সালে পাকিস্তান সফর করেন। দীর্ঘ ৪৫ বছরের মধ্যে রাশিয়ার কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এটিই ছিল প্রথম পাকিস্তান সফর। এই সফরকালে দুই দেশ রাজনৈতিক-সামরিক ইস্যুতে তথ্য বিনিময় করতে রাজী হয়। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন সামরিক ক্ষেত্র, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২০১৫ সালে মস্কো পাকিস্তানকে এমআই-৩৫এম হেলিকপ্টার সরবরাহ করতে রাজী হয়। পাকিস্তান এ ধরণের ২০ টি হেলিকপ্টার কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ২০১৭ সালে রাশিয়া ৪টি সরবরাহ করে। দুই দেশ সামরিক সহযোগিতা জোরদার ও যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠানেও সম্মত হয়। এছাড়া পাকিস্তানের উদ্যোগে একই বছরে আরব সাগরে নৌবাহিনীর আন্তর্জাতিক মহড়ার আয়োজন করা হলে রাশিয়ার নৌবাহিনী এতে যোগ দেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই সহযোগিতা আফগানিস্তানের দৃশ্যপটের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। আফগান পরিস্থিতি রাশিয়ার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কারণ আফগান্তিানে স্থিতিশীলতার জন্য পাকিস্তানেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পাকিস্তানের গঠনমূলক ভুমিকা ছাড়া আফগানিস্তানে সমস্যার সমাধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি অলীক চিন্তা মাত্র। রাশিয়া সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য পদ লাভে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছে। এসসিও’র সদস্যপদ লাভ এই অঞ্চলে পাকিস্তানের কৌশলগত ও আঞ্চলিক গুরুত্ব বাড়াতে সহায়তা করেছে।
এদিকে পাকিস্তানও তার একুশ শতকের পররাষ্ট্র নীতিকে নতুন করে সাজাচ্ছে এবং এতদিন যাদের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন হয়নি তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পাকিস্তানী উদ্যোগ বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে।
এছাড়া ভারতের সামরিক সক্ষমতার বিপরীতে নিজেদের সমরাস্ত্র ভান্ডার সাজাতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই রাশিয়ার দিকে নজর দিতে হবে। রাশিয়ার অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি পাকিস্তানের জন্য প্রয়োজন। অন্যদিকে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বন্ধুত্বের বিপরীতি রাশিয়া-পাকিস্তান মৈত্রীর সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে রাশিয়ার একটি মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। চীনের সাথে পাকিস্তানের আগে থেকেই সুসম্পর্ক রয়েছে। এখন রাশিয়ার সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হবে পাকিস্তানের জন্য কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।