জর্ডানে অভ্যুত্থানের পেছনে এমবিএস-এমবিজেড-নেতানিয়াহু!

জর্ডানের যুবরাজ হামজা বিন হুসেন

  • মোতালেব জামালী
  • ১১ এপ্রিল ২০২১, ০৯:০৯

মধ্যপ্রাচ্যে তেল-গ্যাস সম্পদবিহীন দেশগুলোর একটি হচ্ছে জর্ডান। আর্থিকসহ নানা সংকটে জর্জরিত জর্ডানে হঠাৎ করেই নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে দেশটির উচ্চপদস্থ ২০ জন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গৃহবন্দি করা হয় বাদশাহ আব্দুল্লাহর সৎ ভাই সাবেক যুবরাজ প্রিন্স হামজা বিন হুসেনকে। তার বিরুদ্ধে ‘বিদেশিদের’ সাথে হাত মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রিন্স হামজা স্থনীয় বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীর নেতাদের সাথে দেখা করার পর তাকে গৃহবন্দি করা হয়। বলা হচ্ছে, তিনি এই নেতাদের কিছুটা সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও হামজাকে গৃহবন্দি করার কথা এর আগে অস্বীকার করেছিল জর্ডানের সামরিক বাহিনী। হামজা নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে বিবিসির কাছে পাঠানো দুটি ভিডিওতে সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি অভিযোগ করেন, সমালোচকদের দমনের অংশ হিসেবে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।

ওই ভিডিওতে তিনি দেশটির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও হয়রানির অভিযোগও তোলেন। অভ্যুত্থান করার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে উচ্চপদস্থ অন্তত ২০ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করার পর প্রিন্স হামজা বিবিসিকে ওই ভিডিও পাঠান। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বাদশাহ আব্দুল্লাহর একজন সাবেক উপদেষ্টা এবং রাজপরিবারের আরেক সদস্য রয়েছেন।

আরেক অডিও বার্তায় প্রিন্স হামজা সেনাবাহিনীর আদেশ না মানারও ঘোষণা দিয়েছেন। এই বার্তায় তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর আদেশে তিনি বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবেন না। তিনি বলেন, আমি এখন উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। কিন্তু তারা আমাকে যখন বলে আমি বাইরে বের হতে পারব না, টুইট করতে পারব না, কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারব না; তখন আমি সেই আদেশ মানতে পারি না।

হামজা দেশটির সাবেক বাদশাহ হুসেন ও তার স্ত্রী রানী নূরের বড় ছেলে। ব্রিটেনের হ্যারো স্কুল ও রয়্যাল মিলিটারি একাডেমি, স্যান্ডহার্স্টের গ্র্যাজুয়েট হামজা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করেছেন। তিনি জর্ডানের সশস্ত্রবাহিনীতেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ হচ্ছেন মরহুম বাদশাহ হুসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রিন্সেস মোনার বড় ছেলে।

বাদশাহ হুসেন চেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর প্রিয় সন্তান হামজা সিংহাসনে বসবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কম বয়স ও অনভিজ্ঞ বিবেচনা করে হামজাকে সিংহাসনে বসানো হয়নি। হামজার সৎ ভাই আব্দুল্লাহ বাদশাহ হন। পিতার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে ১৯৯৯ সালে হামজাকে যুবরাজ বা ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করেন আব্দুল্লাহ। কিন্তু ২০০৪ সালে হামজার যুবরাজ খেতাব কেড়ে নেন বাদশাহ এবং নিজের ছেলে হুসেন বিন আব্দুল্লাহকে যুবরাজ ঘোষণা করেন।

বাদশাহ আব্দুল্লাহর এমন সিদ্ধান্তে হামজার মা রানী নূর মর্মাহত হন। তিনি তার বড় ছেলেকে বাদশাহ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে হামজাও তার পিতার ইচ্ছার কথা কোনো দিনই ভুলে যাননি। তিনি সবসময়ই এটা মনে করেন যে, সিংহাসনে বসার ন্যায্য অধিকার তারই রয়েছে।

জর্ডানের জনগণের মধ্যে ৪১ বছর বয়সী প্রিন্স হামজার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশেষ করে দেশটির পূর্বাঞ্চলের উপজাতীয় নেতারা প্রিন্স হামজাকে খুবই পছন্দ করেন। এই নেতারা সব সময়ই হাশেমীয় রাজবংশের প্রতি অনুগত। সম্প্রতি এই অঞ্চলের আল সালাতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তি হাসপাতালে মারা গেলে তার পরিবার ও স্বজনদেরকে সহমর্মিতা জানাতে যান প্রিন্স হামজা। সেখানে পৌছলে তাকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহন করেন স্বজনরা। অন্যদিকে বাদশাহ আব্দুল্লাহ ঐ হাসপাতালে গেলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে অনেকেই তার সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেন। তারা বাদশাহকে একথাও বলেন যে, তার শাসনামলে দেশ দিন দিন ধংসের দিকে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক কালে বেশকিছু ইস্যুতে বাদশাহ আব্দুল্লাহ ইসরাইল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে বিরোধে জড়িয়েছেন। ইসরাইলের সাথে কয়েকটি আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চরি’-কে তিনি মেনে নেননি। এজন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। এ কারণে জর্ডানকে আর্থিক সহায়তা দেয়া দুই দেশ সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের সাথে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতি আর কোনো সহানুভূতিই দেখাচ্ছেন না। ইসরাইলের সাথে এই দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে বাদশাহ আব্দুল্লাহর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাকে ও জর্ডানকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।

ইসরাইলের সাথেও বাদশাহ আব্দুল্লাহর সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। এরমধ্যে করোনা ভাইরাস মহামারির প্রকোপ জর্ডানের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে। এ অবস্থায় বাদশাহ আব্দুল্লাহ চারদিক থেকেই একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। এ কারণে তার অবস্থানকে আরো দুর্বল করার কোনো চেষ্টা সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও ইসরাইল করতেই পারে।

হাশেমীয় বংশের লোকেরা ঐতিহ্যগত ভাবেই যুগ যুগ ধরে জেরুসালেমে অবস্থিত ইসলামে তৃতীয় পবিত্র স্থান বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের দেখাশোনা করে আসছে। সেই হিসেবে জর্ডানের রাজপরিবার এই মসজিদের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। কিন্তু বাদশাহ আব্দুল্লাহর সাথে সম্পর্কের অবনতির কারণে এখন সৌদি যুবরাজ সালমান ইসরাইলের সাথে যোগসাজস করে বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের খাদেমের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছেন বলে নানা সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সম্পর্ক চরম অবনতি ঘটেছে। কিছুদিন আগে বাদশাহ আব্দুল্লাহর ছেলে যুবরাজ হুসেন আল আকসা মসজিদে যাওয়ার ও সেখানে নামাজ আদায়ের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার কয়জন দেহরক্ষী অস্ত্র নিয়ে সেখানে যেতে পারবেন এ নিয়ে ইসরাইলের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সাথে জর্ডানের কর্মকর্তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত যুবরাজ আল আকসা মসজিদে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেন। এই অপমানের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাদশাহ আব্দুল্লাহ যে পদক্ষেপ নেন তা একই সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের সঙ্গে তার সম্পর্ককে তলানীতে নিয়ে যায়।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর আবুধাবিতে একটি ফটোসেশনে অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কথা ছিল। এ কারণে তিনি হেলিকপ্টারে করে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে আসবেন। সেখানে তার জন্য প্রাইভেট বিমান পাঠিয়েছিলেন আরব আমিরাতের যুববাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। কিন্তু বাদশাহ আব্দুল্লাহ ইসরাইলি হেলিকপ্টারকে জর্ডানের আকাশ সীমায় প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় নেতানিয়াহুকে তার আবুধাবি সফর বাতিল করতে হয়।

এজন্য এখন যথেষ্ট মূল্যও দিতে হচ্ছে বাদশা আব্দুল্লাহকে। জর্ডানের প্রতি ইসরাইলের শীতল মনোভাব এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। ইসরাইল জর্ডান নদী থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে নেয়। ইহুদি দেশটির সাথে চুক্তি অনুযায়ী জর্ডান শুস্ক মওসুমে প্রায়ই ইসরাইলের কাছে পানি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে থাকে। ইসরাইল জর্ডান নদীর পানিই আবার জর্ডানকে ফেরত দিয়ে থাকে। কিন্তু নেতানিয়াহুর আবুধাবি সফর বাতিল হওয়ার পর জর্ডানের পানি দেয়ার অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছেন নেতানিয়াহু। ফলে শুস্ক মওসুমে তীব্র পানি সংকটে পড়েছে জর্ডান।

করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় ভ্যাকসিন সংকটও জর্ডানকে আরেকটি বড় বিপদের মুখে ফেলেছে। করোনা ভাইরাসে বর্তমানে বিপর্যস্ত জর্ডান। কিন্তু তা মোকাবেলায় ভ্যাকসিন খুবই কম। এ নিয়েও ইসরাইলের সাথে জর্ডানের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ইসরাইল ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’ করছে। দেশটি অনেক দূরে অবস্থিত গুয়েতেমালাকে করোনার ভ্যাকাসন দিয়ে সহায়তা করলেও পাশের দেশ জর্ডানকে তারা ভ্যাকসিন দিচ্ছে না।

সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও ইসরাইলের সাথে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সম্পর্কের অবনতির কারণে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে প্রিন্স হামজাকে মসনদে বসাতে এই তিন দেশের ইন্ধন থাকতেও পারে। যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।

জর্ডানের রাজপরিবারের সদস্য হাসান বিন জায়েদ ও বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা বাসেম আওয়াদাল্লাহ’র সাথে সৌদি যুবরাজ বিন সালমান ও আরব আমিরাতের যুবরাজ বিন জায়েদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি জর্ডান ও সৌদি আরব দুই দেশেরই নাগরিক। আওয়াদাল্লাহকে গ্রেফতারের মাধ্যমে বাদশাহ আব্দুল্লাহ এই দুই যুবরাজের দিকেই পরোক্ষ ভাবে আঙ্গুল তুলেছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আওয়াদাল্লাহ সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন।গ্রেফতারের পর তাকে ছাড়িয়ে নিতে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল জর্ডানে আসে।

বাদশাহ আব্দুল্লাহ এবার প্রিন্স হামজাহ ও অন্যদের গ্রেফতার করে পরিস্থিতি কোনোভাবে সামাল দিতে পারলেও তার সামনে বিপদ থেকেই যাচ্ছে। তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তিনি সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও ইসরাইলের সাথে সরাসরি সংঘাতে যেতে পারবেন না। এমনকি এই তিন দেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারবেন না। বরং নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখতে এই তিন দেশের সাথে সংঘাত এড়িয়ে সমঝোতার পথে যাওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্প পথ নেই বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।