আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে হঠাৎ করেই মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ-পরবর্তী আফগানিস্তানে তার দেশের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। কাতারের রাজধানী দোহায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত আফগান শান্তি চুক্তি নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যখন আফগানিস্তানের ব্যাপারে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই রাশিয়া মস্কোতে গত ১৮ মার্চ মস্কোতে আফগান সরকার, তালেবান ও অন্য নেতাদের নিয়ে শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে।
রাশিয়ার দেওয়া শান্তি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। ৪২ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করতে হবে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আফগানিস্তানকে উদীয়মান ইউরেশিয়ান ইকনোমিক ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান এই বৈঠকে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার এই শান্তি উদ্যোগকে সমর্থন করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবরে বলা হয়েছে। যদিও আফগানিস্তানে রাশিয়ার এই ভূমিকা ওয়াশিংটনের জন্য অস্বস্তির কারণ।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, তিনি আশা করেন, মস্কো সম্মেলন আন্ত: আফগান সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রগতি অর্জনে সহায়তা করবে। তিনি একইসঙ্গে সতর্ক করে বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় আর কোন বিলম্ব গ্রহনযোগ্য হবেনা। আফগানিস্তান নিয়ে রাশিয়ার এই তৎপরতার পেছনে রয়েছে মধ্যএশিয়া কেন্দ্রিক গ্রেটগেমে মস্কোর ভুমিকা আরো সংহত করা।
এ মাসের প্রথম দিকে উজবেকিস্তান ঘোষণা দেয় যে, এই গ্রীষ্মেই ‘সেন্ট্রাল এন্ড সাউথ এশিয়া: রিজিওনাল ইন্টারকানেক্টেডনেস, চ্যালেঞ্জেস এন্ড অপরচুনিটিস’ শীর্ষক একটি সম্মেলনের আয়োজন করবে। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হবে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা। পাকিস্তানে চায়না-পাকিস্তান ইকনোমিক করিডোর বা সিপিইসি নামে চীন যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেটিকে আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত নিয়ে আসাই হবে এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য। এর আগে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তারা যৌথভাবে তিন দেশের মধ্যে একটি রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে। এই রেল নেটওয়ার্ক দক্ষিন এশিয়াকে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার সাথে যুক্ত করবে।
আফগানিস্তানে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর উপরই এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন নির্ভর করছে। বৃহত্তর ইউরেশিয়ান ভূ-অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে সামনে রেখে এতে আফগনিস্তানকে অন্তর্ভূক্ত করার চিন্তা মাথায় রেখেই কাজ করছে রাশিয়া। কারণ রাশিয়ার সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। রাশিয়া চাইছে না আইএস কিংবা অন্যকোন উগ্রবাদী গোষ্ঠি তার সীমান্তে ঘাটি গাড়ুক। সেজন্যই রাশিয়া আফগানিস্তানে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য তৎপর হয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়া আফগানিস্তানের সরকার, তালেবান ও অন্য সব প্রভাবশালী গোষ্ঠির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
আফগান সরকারের সাথে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি রাশিয়ার কাছ থেকে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনই কেবল কিনছেনা, রাশিয়াকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান রেল নেটওয়ার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করারও আহবান জানিয়েছে। অপরদিকে আফগান সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের যে অবনতি ঘটছে তার সুবিধাও নিচ্ছে মস্কো।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। আফগানিস্তানের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে যে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে সেজন্য তারা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে কাবুল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন নির্দেশ গ্রহন করবেনা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, আফগানিস্তানে নতুন নির্বাচনের আগে অন্তবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারকে তালেবানের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে হবে। ওয়াশিংটনের এই বক্তব্যের পরই ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে কঠোর এই মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে মার্কিন প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিও নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে ক্ষমতা ছাড়বেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদের সাথে সম্প্রতি বৈঠকের পর কাবুলে এক সরকারী অনুষ্ঠানে আশরাফ গনি এ মন্তব্য করলেন। এর আগে জালমে খলিলজাদ প্রেসিডেন্ট ঘানি ও আফগানিস্তানের প্রধান নেতাদেরকে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। এতে তালেবান সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের প্রচেষ্টায় এই প্রস্তাব দেয়া হয়।
আশরাফ ঘানি বলেন, নির্বাচনের পরই তিনি কেবল ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরোধিতা করবেন। তিনি বলেন, যদি তালেবান আগামীকাল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকে তাহলে আমরাও তৈরি, কিন্তু নির্বাচন ছাড়া আমি আমার উত্তরসূরীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নই। মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারকে সামনে রেখে জালমে খলিলজাদ অন্তবর্তী সরকার গঠনের এই প্রস্তাব দিয়েছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সাথে এক বছর আগে তালেবানের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ট্রাম্প সে সময় বেশ কিছু সেনা সরিয়েও নিয়েছেন। কিন্তু এখনও আড়াই হাজার মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে আছে। তালেবনার বলছে চুক্তি অনুযায়ী দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে কোনো আলোচনা সফল হবে না।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে মোতায়েন মার্কিন সৈন্য সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে ১ হাজার জন বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আফগান কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে মোতায়েন থাকা মার্কিন সৈন্য সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে সাড়ে তিন হাজার। এর সাথে ন্যাটো জোটভুক্ত বিভিন্ন দেশের আরো প্রায় সাত হাজার সৈন্য রয়েছে। এসব সৈন্য মার্কিন রসদের ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন। মার্কিন টিভি চ্যানেল এবিসিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ‘আমি এখন সিদ্ধান্ত নেবো, কবে তারা দেশে ফিরবে। হতে পারে এপ্রিলের মধ্যে। তবে তা খুবই কঠিন।’
তালেবান সাথে সাথে বাইডেনের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা বলেছে, ১ লা মের মধ্যে মার্কিন সেনারা দেশে ফিরে না গেলে তাদের ফলভোগ করতে হবে। এএফপিকে তালেবানের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে দোহা চুক্তি মানতে হবে। মার্কিন সেনাদেরকে অবশ্যই ১রা মের মধ্যে দেশে ফিরতেই হবে। কোনো যুক্তি দেখিয়ে বা কোনো ছুতোয় তারা যদি ফিরে না যায়, তা হলে যে পরিণতি হবে, তার জন্য তালেবান দায়ী থাকবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের মতে, শান্তি চুক্তি হওয়ার আগে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনারা যদি আফগানিস্তান থেকে চলে আসে, তাহলে সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই ট্রাম্প মার্কিন সেনার সংখ্যা অনেকটাই কমিয়েছেন। ২০০১ সালের পর এত কম মার্কিন সেনা কখনো আফগানিস্তানে থাকেনি। বাইডেন বলেছেন, তালেবানের সাথে ট্রাম্প যে চুক্তি করেছিলেন, তা খুব ভালোভাবে আলোচনা করে করা হয়নি।
সেনা প্রত্যাহার নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই রাশিয়া আফগান শান্তি আলোচনার উদ্যোগ গ্রহন করে। রাশিয়া আফগনিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার চায়। সেজন্য কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ প্রয়োগ করতে আফগান নেতাদেরও ব্যবহার করছে মস্কো। আফগানিস্তানের বিভিন্ন গোষ্ঠির সাথেও রাশিয়া সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।
আফগানিস্তানের যতগুলো প্রভাবশালী গোষ্ঠি রয়েছে তাদের প্রায় সবার সাথেই সুসম্পর্ক রজায় রেখে চলছে মস্কো। বিশেস করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী আফগান প্রদেশগুলোর বিভিন্ন গোত্রের নেতাদের সাথে রয়েছে নিবিড় সর্ম্পক। অন্যদিকে তালেবানের সাথেও সুসম্পর্ক রয়েছে মস্কোর। তারা পরস্পরের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তালেবান নেতারা মস্কো সফর করেছেন। রাশিয়া তালেবানকে আফগাস্তিানের একটি সত্যিকারের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
রাশিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আফগানিস্তানের সব পক্ষকে নিয়ে একটি শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চুড়ান্ত সমঝোতায় পৌছতে চান। যাতে দেশটিতে ৪২ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটে। এজন্য রাশিয়া তাদের শান্তি উদ্যোগে চীন এবং পাকিস্তানকেও যুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাথেও এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে যাচ্ছে। রাশিয়া ভালো করেই জানে যে, তাদের একার পক্ষে আফগানিস্তানে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবেনা।
তবে রাশিয়ার শান্তি উদ্যোগের উপর ভরসা করতে পারছেনা যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য ওয়াশিংটন জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি বহুজাতিক বৈঠকের আয়োজন করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই বৈঠকে রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইরানকে আমন্ত্রন জানানোর কথা বলা হয়েছে। ফলে রাশিয়ার শান্তি উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া যেহেতু তালেবানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে ফলে আগামীতে দেশটিতে যে সরকারই আসুক না কেন সেখানে রাশিয়ার প্রভাব দিন দিন বাড়তেই থাকবে। রাশিয়া আফগানিস্তানে তার শক্ত ভিত্তি তৈরির পথেই অগ্রসর হচ্ছে।