প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্ষমতায় বসার ৬০ দিনের মধ্যেই চীনের সঙ্গে নজিরবিহীন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে ওয়াশিংটন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি শতাব্দীর একটি বড় অংশজুড়েই উত্তেজনাপূর্ণ সময় কাটবে দুই দেশের মধ্যে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে চীনেও সরকার পরিবর্তন বা রেজিম চেঞ্জের চেষ্টা করতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে বৈরিতা প্রশমিত হতে পারে বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় বাইডেন আমলে দুই দেশের প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রকাশ্যেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে কূটনীতিকদের মধ্যে।
সেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিই বলেছে, ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন বিশ^ ব্যবস্থা মেনে নিতে হবে চীনকে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য হচ্ছে বিশে^ তাদের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হতে না দেওয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই এ নীতি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অন্যদিকে চীন চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ^ ব্যবস্থা বদল করে নিজে নিয়ন্ত্রণ নিতে।
চীন এখন বিশে^র বৃহত্তম সামরিক শক্তি বলে কোনো কোনো গবেষণায় বলা হচ্ছে। পাশাপাশি আগামী এক দশকের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে চীন বিশে^র বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও চীন দ্রুত উপরে উঠছে। ইতিমধ্যেই নৌবাহিনীর শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে চীন। আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সংঘাতের একটি বড় ক্ষেত্র হবে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ।
ফলে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সেটা শেষ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও শীতল যুদ্ধে যে গড়াবে তা প্রায় নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা একমত যে চীনের সঙ্গে তাদের বৈরিতা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে এবং এটা চলবে বহু বছর।
কিভাবে চীনকে বশে আনা যায় তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একক কোনো পন্থা অবলম্বনের কথা ভাবছে না। তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করবে। এর মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে চীনকে বিপাকে ফেলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই কৌশল পুরোপুরি সফল হবে বলে কেউই আস্থা রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের কৌশল নিতে পারে আসুন জেনে নেই সেই বিশ্লেষন।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে ব্যর্থ করে দিয়ে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করতে পারে। অর্থাৎ চীনে রেজিম চেইঞ্জের চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
একই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ঘটিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে কয়েক দশকের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পর কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। এরফলে ভেঙে যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়ন।
শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নই নয়, ওয়াশিংটনে প্রতি বৈরি মনোভাবের বিভিন্ন দেশের সরকারকেও ফেলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধে না জড়িড়ে সিআইএর মাধ্যমে রেজিম চেঞ্জ করায় ওয়াশিংটন। এবার একই সূত্র প্রয়োগ করা হতে পারে চীনের ক্ষেত্রেও।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন যে চীনের সঙ্গে তাদের বিরোধের বড় কারণ দেশটির কমিউনিস্ট শাসন। তারা বুঝাতে চাইছেন যে দেশটিতে যতদিন কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন এই বিরোধের অবসান হবে না। তবে প্রকাশ্যে তারা বলছেন, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরিবর্তন আনা তাদের লক্ষ নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক কট্টরপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আবার এতোটা রাখঢাকের ধার ধারতেন না।
তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটনের বিদেশ নীতির সামনে এখন দুটো পথ। একটি হচ্ছে ভবিষ্যতে কমিউনিস্ট চীনের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া আর অন্যটি হচ্ছে মুক্ত বিশে^র নেতৃত্ব। তিনি চীনের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকসহ সব ফ্রন্টে লড়াইয়ের কথা বলেছেন। এর মানে হচ্ছে চীনে রেজিম চেইঞ্জ। পম্পেও বলেছেন, মুক্ত একবিংশ শতাব্দী চাইলে চীনের ব্যাপারে অন্ধ থাকার সুযোগ নেই। নতুন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্ত বিশ^কে জয়ী হতে হবে।
যুুক্তরাষ্ট্র এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে বিশে^ চীনের আধিপত্য তারা মানবে না। এজন্য চীনের পতন নাকি কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে হবে সেটা নিয়ে তারা ভাবছে। চীনকে ভেঙে ফেলার পরিকল্পনাও আছে ওয়াশিংটনের। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতিতেও আগ্রহী যদি বেইজিং তার আধিপত্য বা সম্প্রসারণমূলক নীতি পরিহার করে এবং ওয়াশিংটনের আধিপত্য মেনে নেয়। চীন সরকারকে দুর্বল করে দেওয়াও ওয়াশিংটনের লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের একদল নীতি নির্ধারক এখনও মনে করছেন যে চাপ প্রয়োগ ও প্রণোদনা দানের মাধ্যমে চীনকে তার আগ্রাসী আচরণ বন্ধে প্রভাবিত করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে চীনের ওপর ‘ম্যাক্সিমাম প্রেসার’ নীতিই অগ্রাধিকার পাবে ওয়াশিংটনের কাছে। যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিমা ও এশীয় মিত্রদের ব্যবহার করবে একাজে। তারা মনে করছেন, এ কৌশলে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নমনীয় না হলেও তার উত্তরসূরীকে হয়তো বাগে আনা যাবে। এ কৌশলের মূল কথা হলো চীনের সঙ্গে যুুদ্ধ এড়িয়ে কূটনীতিতে জোর দেওয়া।
তবে জিনপিং কবে ক্ষমতা ছাড়বেন তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তিনি মাও সেতুংয়ের মত ৮২ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতা থাকলেও ২০৩৫ সালের আগে বিদায় নিচ্ছেন না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদে চীনের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে হচ্ছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র সন্দিহান যে চীন মুখে অবস্থান নমনীয় করার কথা বললেও বাস্তবে ধূর্ত কৌশল গ্রহণ করতে পারে। সৌভিয়েত নেতারাও মুখে সহাবস্থানের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রকে ধোকা দিতো বলে ওয়াশিংটনের অনেক বিশ্লেষকের দাবি। তারা বলছেন, চীন মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র না হলেও লেলিনের নীতি অনুসরণ করে থাকে। চীনের কমিউনিস্ট নেতারা মনে করেন গণতান্ত্রিক বিশে^র নেতৃত্ব তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
ব্রুকিংস চায়না স্ট্র্যাটেজি ইনিশিয়েটিভের পরিচালক রাশ দোশি মনে করেন, জিনপিংয়ের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিরোধ তীব্রতর হয়েছে। তবে এই বিরোধ কোনো একজন রাষ্ট্রনেতার উচ্চাভিলাসের জন্য নয়। এর শিকড় আরো গভীরে প্রোথিত। চীনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রায়ই বলে থাকেন যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে সবসময়ে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। অর্থাৎ চীনের কমিউনিস্ট সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে আদর্শিক প্রতিপক্ষ মনে করে থাকে।
ন্যাশনাল ব্যুরো অফ এশিয়ান রিসার্চের সিনিয়র ফেলো নাডিজ রোল্যান্ড মনে করেন, বৈশি^ক উদার নীতি চীনের অভ্যন্তরীণ দমনপীড়নমূক শাসনের জন্য সরাসরি হুমকি। নব্বইয়ের দশকেই চীনের সামরিক কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সরকার ব্যবস্থার কারণেই দুই দেশের সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তনের পথে বড় বাধা। নব্বইয়ের দশক থেকেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশি^ক ক্ষমতার লাগাম টেনে নিজেকে বিশ^মঞ্চে হাজির করার প্রচেষ্টা শুরু করে। দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়।
চীনের কমিউনিস্ট সরকার জিরো-সাম নীতিতে বিশ^াসী। এর মানে হচ্ছে একপক্ষ জিতলে অপরপক্ষ হারবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সহাবস্থান প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে চীনের শক্তিমত্তা প্রদর্শন, উইঘুরে মুসলিম নিপীড়ন, করোনাভাইরাস নিয়ে চীনের লুকোচুরির ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে বৈরিতা কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে ওয়াশিংটন চীনের কমিউনিস্ট সরকারকেই বড় প্রতিপক্ষ মনে করছে।
যুক্তরাষ্ট্র চাইবে চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে যাতে তারা বৈশি^ক উচ্চাভিলাস পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ের কারণ হলো চীনের কমিউনিস্ট সরকার এ ধরনের পদক্ষেপে আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকেও আর আগের মত বিশ^াস করতে পারছে না তার পাশ্চাত্যের মিত্ররা। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের বিশ^াস ও আস্থায় বড় ধরনের ফাটল ধরিয়ে গেছেন। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা ধীরে চলো নীতি নিয়ে অগ্রসর হবে। তারা পরিস্থিতি বুঝে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের দিকে ঝুকবে।
সার্বিক দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র চীনে রেজিম চেঞ্জের দিকে ঝুকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে গোপনে বহু দেশে সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ আছে। সেটা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক অনেক দেশে তো গায়ের জোরেই সরকার ফেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়া এর বড় উদাহরণ। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকেও উৎখাত করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পারেনি।
শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ কোথায় গিয়ে গড়ায় তা দেখার জন্য বিশ^বাসীকে আরও বহুবছর অপেক্ষা করতে হবে। এমনকি এ শতাব্দীর একটি বড় অংশ জুড়েই বিরাজ করতে পারে গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট চীনের দ্বন্দ্ব।