চীন না যুক্তরাষ্ট্র, কাকে বেছে নেবে পাকিস্তান?


  • মোতালেব জামালী
  • ২৮ মার্চ ২০২১, ০৬:৫৯

যুক্তরাষ্ট্র একদিকে আফগানিস্তানে ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চাইছে, অন্যদিকে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মনোযোগের কেন্দ্রে। ভূ-রাজনৈতিক এই কৌশলগত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান কার পক্ষ নেবে, সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছে ইমরান খানের সরকার।

চীনকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি কৌশলগত জোট গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারত এই জোটের সদস্য। সম্প্রতি এই চার দেশের যে ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, তাতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টাকে প্রতিহত করার বা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই বৈঠকের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত সফর করেছেন। এসব দেশে তারা চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির কৌশল ও পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আফগানিস্তানও সফর করেন।

চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তুতি ও জোট গঠন, তাতে রাখা হয়নি পাকিস্তানকে। বর্তমানে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে তলানীতে রয়েছে। এই মুহুর্তে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কোন স্থায়ী রাষ্ট্রদূত নেই। পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সব সময়ই বৃহৎ পরিসরের ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর আলোকে নির্ধারিত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ থেকে শুরু করে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, নাইন-ইলেভেনের হামলা পরবর্তী সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ পার হয়ে বর্তমানে আফগানিস্তানের যুদ্ধে এসে গড়িয়েছে। আফগান যুদ্ধের ২০ বছর পর এখন এটি একটি সম্ভাব্য চুড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আফগানিস্তানে যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তি এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের নতুন করে সংঘাত শুরুর কারনে নতুন ভূ-রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান কোন পক্ষ নেবে বা কার দিকে যাবে তা নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে দেশটি। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চায়। কিন্তু পাকিস্তানকে নতুন জোটে গ্রহন করার ভূ-রাজনৈতিক কারণ দেখছেনা যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমানে পাকিস্তানকে চীনের শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে , পাকিস্তান কি যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিরোধী গাড়ীতে লাফ দিয়ে উঠার সামর্থ্য রাখে? পাকিস্তান কি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক তৈরিতে সন্ত্রাস বহির্ভূত কোন ভূ-রাজনৈতিক যুক্তি তুলে ধরতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে? এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া পকিস্তানের জন্য বেশ কঠিন।

চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসিতে অবকাঠামো নির্মান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক বছর গুলোতে চীন হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারি দেশ। চীন ও পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্ক এখন অনেক গভীর।

অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসনের চীন বিরোধী অবস্থানও খুবই জোরালো হচ্ছে। স্নায়ু যুদ্ধ ও সোভিয়েত আমল, সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ এবং আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সহজেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যেতে পেরেছে। বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রও তাদের প্রয়োজনে পাকিস্তানকে কাছে টেনেছে। কিন্তু বর্তমানে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে আর সেভাবে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেনা। বরং উল্টো চোখে দেখছে।

পাকিস্তানকে এখন সাবধানতার সাথে দুই পরাশক্তির সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার নীতি ও কৌশল গ্রহন করতে হচ্ছে। কোন পক্ষের সাথেই সংঘাতে না গিয়ে বরং নিজের স্বার্থ হাসিলে দৃই পরাশক্তির সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার কৌশল অবলম্বন করতে চায় দেশটি। এ কারনে ভারতের সাথে আলোচনা শুরু করছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র এতে ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষকে উৎসাহ দিচ্ছে।

চীনের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক যেমন এগিয়ে চলেছে, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও আমদানি বাণি্েযজর সম্পর্ক বজায় রেখেছে ইসলামাবাদ। কিন্তু চীনপন্থী নীতি গ্রহন করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং দেশটির কাছ থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সহায়তা ঝুকির মুখে পড়েছে। সিপিইসি প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বর্তমানে চীন যেমন পাকিস্তানের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অংশিদার, তেমনি পাকিস্তানের টেক্সটাইল ও কৃষি পণ্য সহ বিভিন্ন পণ্য রফতানীর প্রধান গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

২০১৯ সালে পাকিস্তানের রপ্তানী খাত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এবছর শুধুমাত্র টেক্সটাইল খাত থেকে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলারের বিভিন্ন পন্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানী করেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে কৃষিজাত পণ্য আমদানী করেছে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। ২০১৯ সালে পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমান ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। একইসঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল।

পাকিস্তানে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ সত্বেও দেশটির অর্থনীতি খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে দেশটি। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফাণ্ড বা আইএমএফ থেকে বেইল আউট প্যাকেজ।

আইএমএফ এর কাছ থেকে এই প্যাকেজও পাকিস্তানের জন্য একটি বড় সমস্যা। কেননা, আইএমএফ পাকিস্তানে চীনের সিপিইসি প্রকল্পকে একটি ঋনের ফাঁদ হিসেবেই বিবেচনা করে। পাকিস্তানের জন্য আইএমএফ এর ঋন প্যাকেজে সিপিইসি’র কাজকর্মে আরো স্বচ্ছতা, এটি যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে চীন-পাকিস্তান সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এখন পাকিস্তানী নীতি নির্ধারকদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হচ্ছে চীনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট না করে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো যায় সেই পথ খুজে বের করা।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কি ভাবে উন্নত করা যায় সে জন্য পাকিস্তান সরকার নানামুখী উদ্যেগ নিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য জোরদার করতে পাকিস্তানের বিনিয়োগ বোর্ড করাচির কাছে একটি নতুন যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের আলোকেই উচ্চ পর্যায়ের এই কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির মিশন হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভূ-রাজনৈতিক নয়, বরং ভূ-অর্থনৈতিক সমম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে পাকিস্তানের সম্পর্ককে নতুন ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া।

সম্ভবত এভাবেই চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ু যুদ্ধে পাকিস্তানের অনাকাংখিত ভাবে জড়িয়ে পড়া এড়ানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাািনজ্যিক অংশিদারিত্ব ও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক মৈত্রীর বন্ধন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, পাকিস্তানী নীতি নির্ধারকদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হ”েছ নিজেদের দেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচানো। একইসঙ্গে এমন একটি উপায় খুজে বের করা যেখানে পাকিস্তানের কোন পক্ষ নেয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি না হয়।

সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তান- যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সব সময়ই ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে নির্ধারিত হয়ে আসছে। যেমন, বাইডেন প্রশাসন কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিচালিত চীনের বিরুদ্ধে ‘সমমনা’ গনতান্ত্রিক দেশগুলোকে নিয়ে জোট গঠন করছে। এখানে পাকিস্তান চাইলেই বা ইচ্ছা করলেই যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ককে নিরাপত্তার দিক থেকে খুব সহজেই অর্থনৈতিক দিকে সরিয়ে নিতে পারবে না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাইডেন প্রশাসনে তাদের পক্ষের লোকজনকে এ ব্যাপারে কতটুকু প্রভাবিত করতে পারবে তার উপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে।

পাকিস্তানকে এটা এখন প্রমান করতে হবে যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন যুগে পাকিস্তান চীনের পক্ষ নেয়নি, বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নতুন উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে উন্মুক্ত রয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকেও এটা নিশ্চিত করে হবে যে, ভারতের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাকিস্তানের আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবেনা। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি যেন না হয় যাতে পাকিস্তান চীনের দিকে যেতে বাধ্য হয়।

চীনের সাথে বিরোধের আলোকে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে দেখার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রকে এড়িয়ে যেতে হবে। চীন কেন্দ্রিক দৃষ্টিকোন থেকে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে বিচার করলে দেখলে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত নয় বরং দিন দিন কেবল খারাপই হবে। এতে দক্ষিন এশিয়ায় কৌশলগত স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে, বাড়বে সংঘাতের ঝুকি।

পাকিস্তানের বিশ্লেষকরা মনে করেন, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে। পাকিস্তানের জন্য আশার দিক হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৌশলগত সর্ম্পক জোরদারের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এছাড়া আফগানিস্তানের যে কোনো শান্তি প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানকে বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে পাকিস্তান আরো বেশি চীনমুখী হোক তা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না।