আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কিছু সঙ্ঘাতপূর্ণ ঘটনা এবং উত্তেজনার জন্ম দিয়েছিল। গত ১০ বছরে ক্রমবর্ধমানভাবে গোষ্ঠিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিরোধ-বিভাজন প্রবল হয়ে উঠেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ সবের জের ধরেই ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে এই ধর্মীয় বিরোধ এখন দেশ দুটির মধ্যে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধকেও চাঙ্গা করে তুলেছে। এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। শিয়া-সুন্নি বিরোধের বাইরে অতীতে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল এবং এখন নতুন করে সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বিরোধ শিয়া-সুন্নি মতবাদকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে। যা দুই দেশের পরস্পরের প্রতি ‘ঘৃণা সৃষ্টির’ মূল উপাদান। কিন্তু দেশ দুটির সাম্প্রতিক ইতিহাস গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আসলে বিষয়টা সে রকম কিছু নয়। বরং বর্তমান ধর্মীয় গোষ্ঠিগত রাজনৈতিক কারণেই শুরু হয়েছে। দুই দেশেরই অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক এজেন্ডা বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই দুই দেশ প্রবল বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।
ইরান একসময় সুন্নি মুসলিম প্রধান দেশ ছিল। কিন্তু ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইরানের সাফাভী রাজপরিবারের শাসকরা ইরানকে আস্তে আস্তে শিয়া মুসলিম প্রধান একটি দেশে রূপান্তরিত করেন। অন্যদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা সৌদ পরিবার সৌদি আরবকে ওহাবী মতবাদের উপর একটি কঠোর রক্ষণশীল সুন্নি প্রধান দেশ হিসেবে গড়ে তোলে। একই অঞ্চলের দুটি দেশের আদর্শিক এই দ্বিমুখী যাত্রা তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। তখন থেকেই ইরান-সৌদি বৈরিতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় দেশই পরস্পরের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে কঠোর ধর্র্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করেছে। তারা তাদের আদর্শিক লাইন অনুসরণ করে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে নিজ নিজ প্রভাব বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালিয়েছে। এতে করে শিয়া-সুন্নি বিরোধ আরো চাঙ্গা হয়েছে। আবার যেখানে দুই দেশের স্বার্থের সরাসরি সংঘাত দেখা দেয়নি সেখানে তারা পরস্পরের সাথে আপোষ ও সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করেছে।
গত ৬০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা কররে দেখা যায়, রিয়াদ ও তেহরানের সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণ ও সেন্টিমেন্ট সব সময় প্রাধান্য পায়নি। বরং অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করার ইস্যু দুটিই অনেক সময় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিপুল তেল সম্পদের অধিকারি দুই দেশই আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও আধিপত্য নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। আবার দুই দেশেরই যে দুর্বলতা রয়েছে তা হচ্ছে তাদের তেল সম্পদে সমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসবাস।
স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হবার পর মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের বড় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ার ও উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে তেল রপ্তানী নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। এর ফলে ইরান ও সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দুটি ‘শক্ত খুটি’ হিসেবে কাজ করতে থাকে। এর ফলে ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তারা পরস্পরকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেমন ছিলো সৌদি - ইরান বন্ধুত্ব আসুন জেনে নেই।
১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে ইয়েমেন যুদ্ধ। আরব জাতীয়তাবাদী সেনা কর্মকর্তাদের অভ্যুত্থানের প্রতি মিসরের সেনাবাহিনী সমর্থন জানালে এর বিরুদ্ধে ইরান ও সৌদি আরব একজোট হয়। তারা ইয়েমেনের বাদশাহকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সমর্থন জানায়। এসময় বাদশাহর পক্ষে লড়াই করতে ইচ্ছুক যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয় ইরান। ফলে শত শত যোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিতে সৌদি আরব থেকে ইরানে যান।
ইয়েমেনের সাথে সৌদি আরবের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। রয়েছে দুই দেশের উপজাতীয় গোত্র গুলোর মধ্যে পুরনো সখ্যতাও। অন্যদিকে ইরানের আশঙ্কা ছিল, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের প্যান আরব চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে ইরানে শাহ বিরোধী গণ আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে। কেননা দেশটির আরব জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত ও তেল সম্পদে সমৃদ্ধ খোজেস্তান প্রদেশে শাহ বিরোধী মনোভাব ইতিমধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল।
১৯৭৮-৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে বিরাট একটা ঝাকুনি দেয়। এই বিপ্লবের পর সৌদি আরবের সাথে ইরানের সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং এক পর্যায়ে তিক্ত হয় উঠে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকা সমর্থিত শাসকদের উৎখাত করার জন্য সরাসরি আহবান জানান। একই সঙ্গে তিনি ইসলামী বিপ্লব রফতানীর মাধ্যমে তার নেতৃত্বে ‘সকল মুসলমানের গণঅভ্যুত্থান’ ঘটানোর আহবানও জানান।
আয়াতুল্লাহ খোমেনির এই আহবানের পর সৌদি আরবের শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। এই প্রদেশটি তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। এই বিক্ষোভের কারণে তেলের বিশাল মজুদ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় সৌদি শাসকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফলে এই বিক্ষোভ দমনে সরকার ব্যাপক দমনাভিযান শুরু করে। একই সঙ্গে সৌদি সরকার ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার চেষ্টা চালায়। তারা এজন্য শিয়াবিরোধী লিফলেট বিলি ও অন্যান্য প্রচারণার মাধ্যমে এই বিক্ষোভকে মুসলমানদের বিক্ষোভ নয় বরং শিয়াদের চক্রান্ত হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে।
ইরানের খোজেস্তান প্রদেশে দেশটির মোট তেলের রিজার্ভের প্রায় ৮০ ভাগের মজুদ রয়েছে। ইরানের তেল সম্পদে সমৃদ্ধ ও আরব জনগোষ্টি অধ্যুষিত এই প্রদেশের মানুষ স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ও তাদেরকে কোনঠাসা করে রাখার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী কঠোরহস্তে এই বিক্ষোভ দমন করে। এতে শতাধিক মানুষ নিহত হন। আরব জনগোষ্টীর এই আন্দোলন সংগ্রামে সৌদি আরবের সমর্থন ছিলো।
১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনীর মৃত্যুর পর ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি ঘটে। ১৯৯০ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ইরানের মানজিল শহর প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। নিহত হন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। সৌদি আরব জরুরি ভিত্তিতে সেখানে ত্রান সামগ্রী পাঠায়। ১৯৯১ সালে দুই দেশ কুটনৈতিক সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠা করে। এরপর পরই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু করে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাকের সাথে ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ ছিল। একারণে দেশ দুটি কিছুটা খুশিই হয়।
১৯৯৭ সালের মে মাসে ইরানের সংস্কারপন্থি নেতা মোহাম্মদ খাতামী আরব দেশগুলো সফর করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি সৌদি আরবের বন্দর নগরী জেদ্দা সফর করেন। সেখানে তিনি বাদশাহ ফাহদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, পরস্পরের সার্ভভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গিকার করে ইরান ও সৌদি আরব।
এরপর সৌদি যুবরাজ আব্দুল্লাহ ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে ইরানে যান। সেখানে প্রেসিডেন্ট খাতামী তাকে অভ্যর্থনা জানান। সৌদি আরব এটা প্রমানের চেষ্টা করে যে, দুই দেশের সরকারের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তাহলে ইরানের সাথে সৌদির সহযোগিতায় কোনই ঘাটতি থাকবেনা।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। কিন্তু কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আহমাদিনেজাদ ২০০৫ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর প্রতিবেশি দেশ ইরাকে ইরানের প্রভাব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ইরাকের সব বিষয়েই নাক গলাতে থাকে ইরান। এছাড়া ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে থাকে। এতে সৌদি আরব শঙ্কিত হয়ে উঠে।
ইরাকে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধিকে নিজেদের জন্য বড় ধরণের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে রিয়াদ। সৌদি শাসকরা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থি’তি বজায় রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। এমনকি তারা ‘সাপের মাথা কেটে ফেলতে’ ইরানের পরমানু স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানান। এক দশক আগে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হওয়ার পর ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বৈরিতা নতুন পর্যায়ে পৌছে। দুই দেশই এই গণবিক্ষোভকে নিজ নিজ স্বার্থে কাজে লাগোনোর চেষ্টা করতে থাকে।
আরব বসন্তকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশ পরস্পরকে ঘায়েল করার নীতিও গ্রহন করে। এজন্য তারা কোন দেশের বিক্ষোভকে সমর্থন আবার কোন দেশের বিক্ষোভের বিরোধিতা করতে থাকে। ইরান বাহরাইনের বিক্ষোভকে ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন’ হিসেবে অভিহিত করে। অন্যদিকে সিরিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হলে তা দমনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সমর্থনে সেখানে সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্য পাঠায় তেহরান।
অন্যদিকে সৌদি আরব এর বিপরীত পদক্ষেপ নেয়। তারা বাহরাইনের বাদশাহর সমর্থনে সেখানে সৈন্য পাঠায়। অন্যদিকে সিরিয়ায় বাশারবিরোধী বিক্ষোভে সমর্থন জানায়। সেখানের বিক্ষোভকারিদেরকে রিয়াদ সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে। এভাবে দুই দেশের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি এক পর্যায়ে শিয়া-সুন্নি বিরোধেও রুপ নেয়। সৌদি আরব প্রতিবেশি ইয়েমেনে সরকার উৎখাতের চেষ্টারত হুথি বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে সামরিক অভিযান শুরু করে। অন্যদিকে ইরান হুথি বিদ্রোহিদের সামরিক সমর্থন দিতে শুরু করে।
দুই দেশের মধ্যে প্রবল বৈরিতা সত্বেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার কিছু ক্ষেত্র ও সুযোগ আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ইরান বিরোধী অবস্থানের কারণে তারা সব সময়ই ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে কিছুটা বদলেছে। বাইডেনের ইতিবাচক মনোভাব মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা দূর করতে ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। এক্ষেত্রে ইরানের পরমানু কর্মসূুচী নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ও তেহরান এক টেবিলে বসতে পারে। এতে দুই দেশের দূরত্ব কমবে। এটা ইরান-সৌদি সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।