ইরাকে তুর্কি অভিযান নিয়ে ইরান-রাশিয়ার ভূমিকা

সশস্ত্র কুর্দি সেনারা - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ২৪ মার্চ ২০২১, ০৯:১২

ইরান ও তুরস্কের মধ্যে সর্ম্পক অম্ল-মধুর। সিরিয়া ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন ইরাকে অবস্থানরত কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। যদিও দুই দেশই কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণার বিরোধী। এরইমধ্যে দুই দেশের সর্ম্পকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে রাশিয়া।

ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহীদের সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে ঘাঁটি রয়েছে। পিকেকে’র সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে তুরস্কে হামলা চালিয়ে সামরিক-বেসামরিক লোকজনকে হতাহত করে। এজন্য তুরস্ক প্রায়ই উত্তর ইরাকে পিকেকে’র বিরুদ্ধে সেনা অভিযান ও বিমান হামলা চালিয়ে থাকে। কিন্তু ইরাকে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত ইরাজ মাসজেদি সম্প্রতি এক বিবৃততে উত্তর ইরাকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর অভিযানের নিন্দা জানান। তিনি অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিপর্যস্ত ইরাকের মাটিতে কোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি না করার জন্য তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানান।

তার এই বিবৃতি প্রদানের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তুরস্কে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ফারাজমান্দকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে মাসজেদির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়। উত্তর ইরাকের ইয়াজিদি গোষ্ঠির লোকজন অধ্যুষিত সিনজার অঞ্চলে তুরস্ক সেনা অভিযান বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এ পরিস্থিতিতে ইরাক নিয়ে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে আগামী দিনগুলোতে উত্তেজনা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের নানা বিষয়ে এখন নাক গলাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধ নিরসনে মধ্যস্থতাকারি হিসেবে ভূমিকা পালনের আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সিনজারে তুরস্কের সেনা অভিযান এবং এ নিয়ে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসনে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। মস্কো চুপচাপ থেকে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সরকারি মিডিয়াগুলো সিনজারে কুর্দি বিদ্রোহীদের সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের সামর্থ্য নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

রাশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা আরআইএ নভোস্তি তুরস্কের ১৩ জন বেসামরিক নাগরিককে পিকেকে অপহরণের পর হত্যা করার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র যে বিবৃতি দেয় তা খুব বড় করে প্রচার করে। উত্তর ইরাকে তুরস্কের সেনারা অভিযান চালানোর সময় এই ১৩ জনের লাশ উদ্ধার করে। রাশিয়ার প্রচার মাধ্যমে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বের দিকগুলো বেশি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিনজারে তুরস্কের ব্যাপক সেনা অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আঙ্কারা ও তেহরানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাক তা হয়ত রাশিয়া চাইবেনা। রাশিয়া ইরাকে তার প্রভাব অনেক বাড়িয়ে নিতে চায়। সেজন্য দেশটি ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা কমিয়ে পরিস্থিতিকে শান্ত করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যাতে এ পরিস্থিতি নিয়ে হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ না পায় সেটাও নিশ্চিত করতে চায়।

এরমধ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ হঠাৎ করে ইস্তাম্বুল সফর করেন। কিন্তু তার এই সফরের আলোচ্যসূচি প্রকাশ করা হয়নি। দুদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আঞ্চলিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন। তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে এই আলোচনার পেছনে রাশিয়ার কোনো ভুমিকা আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।

ইরাক সরকার, ইরাকি কুর্দিস্তান এবং ইরাকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গ্রুপ হাশদ আল শাবি’র সাথে সব সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে রাশিয়া। এই তিনটি গোষ্ঠির মধ্যে উত্তেজনা কমিয়ে রেখে মস্কো তার সুফল ভোগ করে।

তুরস্ক সিনজারে সামরিক অভিযান চালালে তা নিয়ে দেশটিতে মেরুকরণ ঘটবে। ইরাক সরকার সম্ভবত: সিনজারে তুরস্কের সামরিক অভিযানের বিস্তৃতি ঘটানোর বিরোধিতা করবে। গত বছর জুনে উত্তর ইরাকে পিকেকের বিরুদ্ধে তুরস্কের সামরিক অভিযানের বৈধতার প্রশ্ন তুলে এর নিন্দা জানিয়েছিল ইরাক সরকার। অন্যদিকে মিলিশিয়া গ্রুপ হাশদ আল শাবিও তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়তে পারে। কেননা, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান এটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

ইরাকি কুর্দিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মাসরুর বারজানী আবার উত্তর ইরাকে তুরস্কের সামরিক অভিযানকে সমর্থন করতে পারেন। তার সাথে রয়েছে তুরস্কের ঘনিষ্ট সর্ম্পক। সম্ভাব্য এই মেরুকরণের কথা মাথায় রেখেই রাশিয়া বর্তমানে মুখ বন্ধ করে আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কিন্তু পরি¯ি’তির গুরুতর অবনতি ঘটলে তখন রাশিয়াকে একটি পক্ষ হয়ত নিতে হতে পারে।

ইরাকে ধীরে ধীরে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছে। রাশিয়ায় নিযুক্ত ইরাকি রাষ্ট্রদূত ২০১৯ সালের মে মাসে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ইসরাইলের হামলার হুমকি বৃদ্ধি পওয়ায় এবং তুরস্ক সামরিক অভিযান চালালে তাদের বিমান হামলা প্রতিরোধে ইরাক সরকার রাশিয়ার কাছে আবারো এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার প্রস্তাব দিতে পারে। যদি রাশিয়া ইরাকের এই প্রস্তাব কিভাবে গ্রহণ করে তা দেখার বিষয়।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পার্লামেন্ট সদস্য ফারেস শেহাবি সম্প্রতি সিরিয়ায় ইসরাইলের বিমান হামলা ও তুরস্কের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে দেশটিকে রক্ষা করতে না পারার জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেন। ইরাকের ক্ষেত্রেও একই ধরণের ঘটনা ঘটলে তা রাশিয়ার ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইরাকের মিলিশিয়া সংগঠন হাসদ আল শাবি’র নেতা ফালি আল ফায়েদ রাশিয়াকে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর অংশিদার হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু উত্তর ইরাকে তুরস্কের সামরিক অভিযানের বিষয়ে রাশিয়া যদি নীরব থাকে বা সিরিয়ার ভূমিকার পুনরাবৃত্তি ঘটায় তাহলে তাদের ভূমিকা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তুলবে হাসদ আল শাবি।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সমাধানে ইরান ও তুরস্ককে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও কার্যকর অংশিদার মনে করে রাশিয়া । এ কারণে এই দুটি দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা চলমান থাকাকে নিজের স্বার্থের জন্যই ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করছে রাশিয়া। যদি ইরান ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে সেটাকে খুব সহজ ভাবে নেয়া মস্কোর পক্ষে সম্ভব হবেনা। এছাড়া তখন ইরাকে ইরান সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে।

ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গ্রুপ হাশদ আল শাবি এক বিবৃতিতে বলেছে, ইরাকের জনগণ দখলদারদের প্রতিরোধ করবে এবং তুরস্ককে ইরাক থেকে বিতাড়িত করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবে। এই বিবৃতির পর তুরস্কের মিডিয়া বলছে যে, উত্তর ইরাকের এসব সংগঠনের সাথে তুরস্কের গেরিলা গ্রুপ পিকেকে’র দীর্ঘমেয়াদি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের একজন উপদেষ্টা সতর্ক করেছেন, শিনজারে হাশদ আল শাবি মিলিশিয়া গ্রুপের ১৫ হাজার সদস্য অবস্থান নিয়েছে।

তুরস্ক যদি শিনজার থেকে পিকেকে বিরোধী সামরিক অভিযান ইরাকি কুর্দিস্তানের আরো ভেতরে নিয়ে যায় তাতে রাশিয়ার বাণিজ্যিক স্বার্থ হুমকির মুখে পড়বে। ২০১৮ সালের মে মাসে রাশিয়ার তেল কোম্পানী রসনেফট ইরাকি কুর্দিস্তান সরকারের সাথে তেল-গ্যাস অবকাঠামো উন্নয়নের চুক্তি করেছে। একটি নতুন পাইপলাইন স্থাপনের ডিজাইনও করবে তারা। ইরাকি কুর্দিস্তানে রাশিয়া তাদের বাণিজ্যিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। কোম্পানিটি আশা করছে কুর্দিস্তান সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এই অঞ্চল থেকে তারা ৫দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করতে পারবে।

তুরস্কের বিমান হামলা যদি শুধুমাত্র সিনজারের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে উত্তর ইরাকে রাশিয়ার স্বার্থের কোন ক্ষতি হবেনা। বছর তুরস্কের অপারেশন ক্ল-ঈগল ও অপারেশন টাইগার নামের দুটি সেনা অভিযান জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।

সিনজারে সেনা অভিযানকে কেন্দ্র করে যদি ইরান-তুরস্ক উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠে তাহলে রাশিয়া নিজের স্বার্থেই এতে হস্তক্ষেপ করবে এবং উত্তেজনা কমিয়ে আনতে কার্যকর কূটনেতিক উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কের চেয়ে ইরানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। যদিও মস্কো ইয়েমেনে ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি থামাতে এবং সৌদি আরবে হুথি বিদ্রোহেিদর হামলা বন্ধের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইরাকে ইরান-তুরস্কের উত্তেজনা যাতে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধে রুপ না নেয় এবং তা সিরিয়াতেও ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে রাশিয়া সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।