যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যখন মধ্যপ্রাচ্য নীতি নতুন করে সাজাচ্ছে, তখন রাশিয়া খুব ভালোভাবেই এ অঞ্চলে শক্তি প্রদর্শন করছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ সম্প্রতি উপসাগরীয় দেশগুলো সফর করেছেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতারের শাসকদের সাথে বৈঠক করেছেন। এই সফরের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে রাশিয়া বিশেষ বার্তা দিতে চেয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপসাগরীয় দেশগুলো সফরে এসব দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব দেশের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠকের সময় অস্ত্র বিক্রি ও জ্বালানি তেল সংগ্রহসহ বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি হয়েছে।
রাশিয়া উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। গত শীতেই আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা মস্কো সফর করেন। এর পরই ল্যাভরভ এই সফরে এলেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরকালে ল্যাভরভ দেশটির যুবরাজ আবুধাবির শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সহযাগিতা বিষয়ক মন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সাথে বৈঠক করেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ভাষ্য হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন পারস্পারিক আস্থা ও বিশ^াসের ভিত্তিতে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রেখে চলেন। তার অংশ হিসাবেই আমিরাতে ল্যাভরভ দেশটির নেতাদের সাথে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সংলাপেও অংশ নেন।
এর আগে শীর্ষ পর্যায়ে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্য সহযোগিতা কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা করা হয়। করোনা মহামারির কারণে আর্থিক টানাপোড়েন সত্বেও রাশিয়া ও আমিরাতের মধ্যে বাণিজ্য গত বছর ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে যা যে কোন সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, রাশিয়া উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে, মস্কো এই অঞ্চলের দেশগুলোর ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে সিরিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ক্ষমতা দেখিয়েছে। সফরকালে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী এই বার্তাও দিয়েছেন , উপসাগরীয় দেশগুলো যদি ইরানের সাথে তাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চায় তাহলে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে রাশিয়া এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে পারে। এটা রাশিয়ার পক্ষেই সম্ভব। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের ভুমিকা রাখতে পারবেনা বলেও তিনি পরোক্ষভাবে এসব দেশকে জানিয়ে দেন।
উপসাগরীয় অঞ্চল সফরকালে ল্যাভরভ কেবল অস্ত্র বিক্রি ও নিরাপত্তা চুক্তি নিয়েই আলোচনা করেননি, এসব দেশকে তিনি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন দিয়েও সহযোগিতা করার কথা জানান। রাশিয়া যে এসব দেশের ব্যাপারে খুবই মানবিক এর মাধ্যমে সেটাও তিনি প্রমান করার চেষ্টা করেছেন।
প্রায় ৩০ বছর আগে ১৯৯০-৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় সংকটের সময় ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েতকে তার দেশের অংশ দাবি করে সেটি দখল করেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোন শক্তি ছিলনা। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মাধ্যমে একাধিক দেশকে নিয়ে সামরিক জোট গঠন করে কুয়েতকে ইরাকের দখলমুক্ত করেন। এ সময় টানা প্রায় ৬ সপ্তাহ ইরাকি বাহিনীর উপর বিমান হামলা চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। যুক্তরাষ্ট্রের বি-৫২ বোমারু বিমান ও ষ্টেলথ যুদ্ধ বিমানও এই অভিযানে অংশ নেয়। পরে প্রায় ১০০ ঘন্টার স্থল অভিযানে ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে হটিয়ে দেয়া হয়।
এক দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়ক ও স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ‘আরব বসন্ত’ নামের গনবিক্ষোভ শুরু হয়। এর ঢেউ েেস লাগে সিরিয়াতেও। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধে রুপ নেয়। ২০১৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসুরি দেশ হিসেবে রাশিয়ান ফেডারেশন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ৩০ টি যুদ্ধ বিমান, সেনাবাহিনী, বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধা ও মিলিশিয়া বাহিনী নিয়ে রাশিয়া সিরিয়ায় এসে শক্ত অবস্থান নেয়। ইরানও যোগ দেয় রাশিয়ার সাথে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট বাশার বিরোধীদেরকে উপসাগরীয় দেশগুলোর দেয়া সমর্থন বড় ধরণের হোচট খায়। পরিস্থিতি প্রেসিডেন্ট বাশারের অনুকূলে চলে যায়। বিরোধীরা বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং তাদের অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার পথে। ৯০ এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অবস্থান এখন আর নেই। পরিস্থিতি বদলে গেছে। রাশিয়া এখন এ অঞ্চলে অনেক বেশি প্রভাবশালী।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের এবারের সফরকে উপসাগরীয় দেশগুলো ভালোভাবেই গ্রহন করেছে। এটা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই অঞ্চলের দেশগুলো শুধু একটি মিত্র দেশ হিসেবে নয়, আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়ে মধ্যস্থতাকারি হিসেবে রাশিয়ার ভূমিকাকে যেমন স্বাগত জানিয়েছে, তেমনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিজয়কেও তারা মেনে নিয়েছে।
রাশিয়া শুধু সিরিয়াতেই নয়, লিবিয়াতেও যুদ্ধ বিমান ও ভাড়াটে যোদ্ধা মোতায়েন করেছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, রাশিয়া এটা ভালোভাবেই প্রমান করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই সেনা ও যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করার ক্ষমতা রাখেনা, রাশিয়াও সেটা করতে পারে। তারা সেটা করে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা প্রমান করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তদের সামরিক উপস্থিতির যতই বিস্তৃতি ঘটাক না কেন, রাশিয়া যে তাদের টপকে যাবে সেটা মস্কো ভালোভাবে ওয়াশিংটন ও এই অঞ্চলের দেশগুলোকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেবলমাত্র সৌদি আরবের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। এর ফলে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক তেমন একটা ভালো ছিলনা। কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। এজন্য তিনি তার পররাষ্ট্র নীতিকে নতুন করে সাজাচ্ছেন। তার পররাষ্ট্র বিষয়ক অভিজ্ঞ টিম এ লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতির ধরণটা কি রকম হবে সে বিষয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত রাশিয়া। উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র যাতে আর শক্ত ভিত্তির উপর দাড়াতে না পারে সেজন্য রাশিয়া সম্ভাব্য সব কিছুই করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ল্যাভরভের মধ্যপ্রাচ্য সফর রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমি পুতিনের সেই নীতিরই প্রতিফলন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুতিনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্যই ল্যাভরভ এসেছেন এই সফরে। পুতিন এই অঞ্চলের কোন একটি পক্ষের সাথে নয়, বরং সব পক্ষের সাথেই সুসম্পর্ক ও মিত্রতা গড়ে তুলতে চান। রাশিয়া নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বলিষ্ঠ মধ্যস্থতাকারি ও প্রভাব বিস্তারকারি শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চায়। কেবলমাত্র রাশিয়াই এই মুহুর্তে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে কিংবা ইরান ও উপসাগরীয় দেশগলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারে বলে মস্কো প্রমান করতে চায়।
রাশিয়া এটাও প্রমান করতে চায় যে, তারা শুধু মধ্যস্থতাকারিই নয়, গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারি দেশও হতে পারে। দিতে পারে করোনার ভ্যাকসিনও। রাশিয়ার এই ভ্যাকসিন কূটনীতি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মন জয় করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ল্যাভরভের সফরের অন্যতম উদ্দেশ্যও ছিল এই ভ্যাকসিন কূটনীতি। যা এই অঞ্চলে রাশিয়ার জন্য নতুন একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে করোনার যে তিনটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রাশিয়ার স্পুটনিক-ফাইভ একটি। স্পুটনিক ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য আমিরাতে তিন হাজার স্বেছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন ইরান, সিরিয়া, মিসর ও ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ ও তুরস্ক রাশিয়ার স্পুটনিক-ফাইভ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে মধ্যপ্রাচ্যে কমিউনিজমের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টারও অবসান ঘটে। এরপর রাশিয়ার পররাষ্ট্র নীতির নতুন পথচলা শুরু হয়। গত ৩০ বছরে এটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্ত’ নামের গণবিক্ষোভ শুরু হলে তা রাশিয়ার জন্য নতুন সুযোগ এনে দেয়। এরপর ২০১৫ সালে ইরানের পরমানু কর্মসূচি নিয়ে বিশ^শক্তিগুলোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষিরত হয়। এসব ঘটনা রাশিয়াকে সিরিয়া থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত তার প্রভাব বিস্তার করতে সহায়তা করে।
এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ও জ্বালানি সম্পদে প্রবেশের পথও উন্মুক্ত হয়ে যায় রাশিয়ার জন্য। একই সাথে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয় রাশিয়া।