ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাজনীতিতে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছেন মুসলিম নেতারা। বিহার, আসাম ও তেলেঙ্গনার পর এবার পশ্চিমঙ্গেও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দলগুলো। তবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এখনও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি এ দলগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটির রাজনীতিতে সর্বভারতীয় ইসলামী রাজনৈতিক দলের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
গত বছর বিহারের বিধানসভা বা রাজ্য সংসদের নির্বাচনে ৫টি আসনে জয়লাভ করে চমক সৃষ্টি করেন উদীয়মান মুসলিম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল। এতে প্রমাণিত হয় যে, অল ইন্ডিয়া মসলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন বা মিম আর ভোট কাটুয়া নয়। এই দলটিকে কেউ আর উপেক্ষা করতে পারবে না। ভবিষ্যতে এই দলটিও হতে পারে কিং মেকার।
বস্তুত নব্বইয়ের দশক থেকেই ভারতের রাজনীতিতে শক্ত আসন গেড়েছে সাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে রাজনীতি। এই ধারার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হচ্ছে শিবসেনা, সমাজবাদী পার্টি, বিএসপি বা বহুজন সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, জেডিইউ, তৃণমূল কংগ্রেস, টিডিআর, ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং কর্ণাটকের জেডিএস।
এই সাম্প্রদায়িক বিস্ফোরণের মধ্যে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না মুসলিমদের। অথচ তারা ভারতের মোট জনসংখ্যার অন্তত ১৫ ভাগ। মোট সংখ্যায় তারা ২০ কোটিরও বেশি। বিশে^র তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস এই ভারতে। বিশে^ও মোট মুসলমানের ১১ ভাগের বাস এই ভারতে। শত শত বছর দেশটি শাসন করেছিল মুসলিমরা।
ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হচ্ছে মুসলিমরা। দলিত, উপজাতীয়, যাদব এবং অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়ের চেয়ে মুসলিম ভোটার অনেক বেশি। অথচ এসব সম্প্রদায়ের নিজস্ব রাজনৈতিক দল থাকলেও মুসলিমরা ছিল কার্যত বিচ্ছিন্ন। ওয়াইসির মিম ছাড়াও আসামে এআইইউডিএফ এবং কেরালায় আইইউএমএল নামের মুসলিমদের রাজনৈতিক দল আছে। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি গঠন করা হয়েছে মুসমিলপ্রধান ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। যার প্রধান ফুরফুরা শরীফের পরীজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। তবে তাদেরকে এক ছাতার নীচে আনার মত কোনো বড় নেতা ছিলেন না। অথচ ভারতের মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনীতির হিসাবনিকাশই পাল্টে যেতে পারে।
ভারতের ৫৪৩ আসনের লোকসভা ১৪৫টিতে মুসলিম ভোটার ২০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ৩৮টি আসনে মুসলিম ভোটার ৩০ ভােেগর বেশি। ১৮টি আসনে মুসলিম ভোটার ৫০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে ভারতের ২১৮টি আসনে মুসলিম ভোটাররা বড় ফ্যাক্টর হতে পারেন। তারা এক ছাতার নীচে এলে কিং মেকার হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জল।
সর্ব ভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের প্রধান বাধা হচ্ছে অপপ্রচারের ভয়। বিজেপির পাশাপাশি কংগ্রেসও চায় না এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটুক। এ ধরনের দলকে পাকিস্তানের দালাল হিসেবে চিত্রিত করা হয়। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের আন্দোলনে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতপন্থী মুসলিম দলও ছিল সে সময় । তবে সেই দলটির নাম ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ। কেরালায় সেটি টিকে থাকলেও অন্যত্র আসন গড়তে পারেনি। এ অবস্থায় বেশিরভাগ ভারতীয় মুসলিমই তাদের নিরাপত্তার জন্য তথাকথিত সেক্যুলার পার্টিকে ভোট দেয়।
হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থানে সেই ধারায় পরিবর্তন এসেছে। অটল বিহারি বাজপেয়ীর অধীনেও বিজেপি একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল ছিল। নরেন্দ্র মোদির আমলে দলটি হিন্দুত্ববাদকে আকড়ে ধরেছে। মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা ও তাদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। এতে মুসলিমরা এখন ভীতি সন্ত্রস্ত্র। মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য মোদি সরকার চেষ্টার কোনো কমতি রাখছে না। ভারতের সমাজেও হিন্দত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সামাজিক মাধ্যমেও মুসলিমদের বিদ্রুপ ও তাদেরকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে।
এক সময় মুসলিমরা হিন্দুত্ববাদী আক্রমণ থেকে বাচার জন্য কংগ্রেস করতেন। তবে তা অনেক সময়ই ছিল মরীচিকা। হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে বিজেপির উত্থানের পর কংগ্রেসও নেহরুর সেক্যুলারিজম অনেকাংশে ত্যাগ করে কোমল হিন্দুত্ববাদকে গ্রহণ করেছে। তারাও হিন্দুত্ববাদী ভোটারের ভাগ চায়। এর সবচেয়ে নোংরা উদাহরণ হচ্ছে ২০০২ সালে গুজরাটের নির্বাচন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদির জনপ্রিয়তায় ভীত কংগ্রেস রাজ্যের প্রধান নির্বাচিত করে দলত্যাগী বিজেপি নেতা শঙ্করসিন ভাগেলাকে। এরফলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দি¦তা হয় মূলত দুই আরএসএস নেতার মধ্যে। ওই নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রত্যাশিত ভরাডুবি ঘটে।
কংগ্রেস কোমল হিন্দুত্ববাদকে আকড়ে আছে। এখন দলটির নেতা রাহুল গান্ধীকে ঘটা করে শিব পূজা দিতে দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেসের এই সুবিধাবাদী নীতি নির্বাচনী মাঠে সুপার ফ্লপ করেছে। এক সময় মুসলিম ও সেক্যুলাররা কংগ্রেসের প্রধান শক্তি ছিল। এখন তারা দলটিকে ত্যাগ করছেন। এরফলে সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের পথ সুগম হয়েছে।
হায়দারাবাদে মিম দীর্ঘদিন ধরেই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। দেশভাগের সময় এই দলটি ভারত বা পাকিস্তান কারো সঙ্গে যেতে চায়নি। তারা চেয়েছিল হায়দরাবাদের স্বাধীনতা। ১৯৪৮ সালে ভারত হায়দারাবাদ দখল করে নেয়। এরপর এ দলটি একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয় এবং বহু স্থানীয় নির্বাচনে তারা জয়ী হয়। অনেকে এই দল থেকে মেয়রও নির্বাচিত হন।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি দলটির প্রধান হওয়ার পর থেকেই এটিকে সর্বভারতীয় স্থরে উন্নীত করার উদ্যোগ নেন। ২০১২ সালে মহারাষ্ট্রে এবং ২০১৩ সালে কর্ণাটকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বেশ কয়েকটি আসনে জয়লাভ করে দলটি। ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের পৌর নির্বাচনে ৭৮টি আসনে অংশ নিয়ে দলটি ৩১টিতে জয় পায়। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে অংশ নেয় দলটি। তখন দলিত পার্টির নেতা প্রকাশ আম্বেদকরের সঙ্গে জোট করে ভোটে অংশ নিয়ে লোকসভায় প্রথমবারের মত জয়ী হয় মিম। এরপর বিহারের নির্বাচনে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫টিতে জয় পায় ওয়াইসির মিম। এ সময় বিএসপি ও রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টির সঙ্গে জোট করেছিল মিম। পশ্চিমবঙ্গে এবং উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনেও অংশ নেওয়ার কথা ভাবছে মিম। তবে পশ্চিমবঙ্গে দলটির তৎপরতা কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
মূলত মুসলিমদের মধ্যে দলটির জনপ্রিয় হলেও তারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করে থাকে। বিভিন্ন নির্বাচনে অনেক হিন্দুকেও প্রার্থী করেছে দলটি। যেমন হায়দারাবাদেই দলটির তিনজন হিন্দু মেয়র আছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটি স্থানীয় নির্বাচনে মিমের একজন হিন্দু প্রার্থী কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ দিক।
কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দলের দাবি মিম বিজেপি বিরোধী ভোটে বিভক্তি ঘটাচ্ছে। এতে কার্যত হিন্দুত্ববাদী বিজেপিই লাভবান হচ্ছে। কেউ বলছে দলটি ভোট কাটুয়া। এর আগে বিএসপির বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলেছিল কংগ্রেস। কিন্তু তা কাজে লাগেনি।
একথা ঠিক যে মিম এককভাবে নির্বাচন করলে তাতে বিজেপি বিরোধী ভোটে বিভক্তি দেখা দিতে পারে। কিন্তু মিম বিহারের মত বিভিন্ন রাজ্যে নিজের শক্তিমত্তা দেখাতে পারলে দলটি বিজেপি বিরোধী প্রধান জোটের শরিক হতে পারবে। তখন দলটি বিভিন্ন আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হবে। এতে মুসলিম ভোট আরো সংহত হবে এবং বিজেপির ক্ষতিই হবে।
এখনও মিমকে বড় কোনো দল জোটসঙ্গী করতে চায় না। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মিমকে জোটে নেয়নি মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ জনগণের মধ্য থেকেই এমন দাবি উঠেছিল। বরং মিমকে জনসভা করারও অনুমতিও দেয়নি তৃণমূল সরকার। তবে আব্বাস সিদ্দিকী বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সেই অভাব অনেকটা পূরণ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে আসামের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে মাওলানা বদরুদ্দীন আজমলের দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা এআইইউডিএফ। এর আগে বিজেপির মতোই কংগ্রেসও সহ্য করতে পারত না তাকে। এবার কংগ্রেস নির্বাচনে তাকে সঙ্গে নিয়েছে।
মাওলানা আজমলের দল জোট থেকে এবার ২০-২৫টা আসনে প্রার্থী দেবে। ১২৬ আসনের পরিষদে জিতবে হয়তো ১২ থেকে ১৫টিতে। তবে এই শক্তি নিয়ে আসামে অনেক সময় তারা সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মাওলানা বদরুদ্দীন আসন্ন নির্বাচনে প্রথম থেকে চেষ্টা করছেন বিজেপিবিরোধী একক জোট করতে। যাতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ৩০ ভাগ ভোটই বিজেপিবিরোধী শিবির পায়। সেটা সফল হয়েছে ইউডিএফের কিছু ত্যাগের বিনিময়ে। মুসলমান প্রধান অনেক এলাকায় তাদের কিছু আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে হয়েছে। মাওলানা বদরুদ্দীনের সঙ্গে স্থানীয় বামপন্থীদেরও জোট হয়েছে।
এভাবে ভবিষ্যতে সব মুসলিম রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে বিভিন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস বা অন্য দলের সঙ্গে জোট করে ভোটের মাঠে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে। আর এভাবেই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে উত্থান ঘটবে সর্বভারতীয় কোনো মুসলিম দল বা জোটের।