যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার বয়স ২৪৪ বছর। প্রায় আড়াইশ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২২৭ বছর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের কোথাও না কোথাও যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আর গত ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে ৪৬টি বোমা হামলা চালিয়েছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস মানে যুদ্ধের ইতিহাস। আর যুদ্ধ মানে হত্যা আর ধ্বংস। সাম্প্রতিক ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় আগ্রসনসহ যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বছরের এসব যুদ্ধে নিহত হয়েছে অগণিত মানুষ। আহত আর ঘরবাড়িছাড়া হয়েছে কত মানুষ, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় অসম্ভব। ধ্বংস হয়েছে সভ্যতার পর সভ্যতা আর জনপদ।
কেবল ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ৩ লাখ ২৬ হাজার বোমা এবং মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যান্টিওয়ার গ্রুপ কোডপিংকের সর্বশেষ গবেষণার তথ্য এটি। এই গবেষণাকাজ করেছেন বেঞ্জামিন এবং নিকোলাস জে এস ডাভিস। চলতি মাসে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কমন ড্রিম ওয়েবসাইট।
বর্তমানে বিশ্বে যুদ্ধের কারনে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত দেশ হলো সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক এবং আফগানিস্তান। একই সাথে লেবানন, লিবিয়া, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশকেও একই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হয়েছে।
কোডপিংক এর তথ্যের প্রাথমিক সূত্র যুক্তরাষ্ট্র আর্মির অফিসিয়াল বিভিন্ন রিলিজ। এ ছাড়া ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন জার্নালিজম, দি ইয়েমেন ডেটা প্রজেক্ট এবং দি নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশন এর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে গবেষনায়।
২০০১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় যে ৩ লাখ ২৫ হাজার বোমা ও মিসাইল হামলার সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবের তুলনায় তা অনেক কম। কারন ট্রাম্প প্রশাসন ২০২০ সালের বোমা হামলার তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। ফলে তার আগের দুই বছরে ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানে বোমা ও মিসাইল হামলার কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে হেলিকপ্টার থেকে বোমা ও মিসাইল আক্রমন, এসি-১৩০ গানশিপ আক্রমন, কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অথবা কাউন্টার টেরোরিজম অপারেশনের তথ্যও হিসেবের বাইরে। এসব তথ্য যোগ করলে বোমা ও মিসাইল হামলার সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৫ ফেব্রুয়ারি সিরিয়ায় প্রথম বোমা হামলা পরিচালনা করেন। এ সময় ১ দশমিক সাত পাঁচ টন বোমা বর্ষন করা হয়। নিহত হয় কমপক্ষে ২২ জন। এই বোমা হামলার ঘটনায় ওয়াশিংটনের ভেতরে অনেকে উল্লসিত। এমনকি করেপারেট মিডিয়া গোষ্টীও ছিলো আনন্দিত।
সিরিয়া হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে সুর মিলিয়ে অনেক গণমাধ্যম কথা বলেছে। তারা সমর্থন যুগিয়েছে শত্রুর বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে । আবার তাদের মতে একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রকে হতে হবে মানবাধিকার রক্ষার চ্যাম্পিয়ন।
পৃথিবীর সব দেশের একত্রে যে সামরিক বাজেট যুক্তরাষ্ট্রের একার সামরিক বাজেট তার প্রায় সমান। কিন্তু এরপরও বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ চলছে তার প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রে তেমন বোঝা যায় না। এই দুই গবেষক বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব জনগনের নামে যে হত্যা এবং ধ্বংসলীলা পরিচালনা করছেন সে বিষয়ে আমেরিকান জনগণ এবং বিশ্ব বলতে গেলে পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট এর ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বের সব দেশের মোট সামরিক বাজেট ছিল ১ হাজার ৯১৭ বিলিয়ন ডলার। আর ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট ছিল ৭৩২ বিলিয়ন ডলার।
দি ব্যালেন্স ডট কমে বলা হয়েছে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক বাজেট ৯৩৪ বিলিয়ন ডলার।
ইনফরমেশন ক্লিয়ারিং হাউসের তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক যুদ্ধ আর ইরাক দখলের পর থেকে ২০২১ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯০ জন ইরাকী নিহত হয়েছে। আর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মারা গেছে ৪ হাজার ৮০১ জন।
ইউকিপিডিয়ার তথ্যে বলা হযেছে ইরাকে ৪ লাখ ৬০ হাজার ইরাকী নিহত হয়েছে ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আগ্রসনের কারনে ।
যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছর ধরে আফড়গানিস্তানে যুদ্ধরত। এ যুদ্ধে তালেবান সৈন্য মারা গেছে ৭২ হাজারের বেশি। আফগান সিকিউরিটি ফোর্সের সৈন্য মারা গেছে ৭০ হাজারের বেশি। সাধারন মানুষ মারা গেছে ৪০ হাজারের বেশি। আল কায়েদার সৈন্য মারা গেছে ২ হাজারের বেশি। আইএসআইএল সদস্য মারা গেছে প্রায় আড়াই হাজার।
আফানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মারা গেছে ২ হাজার ৪২০ জন। যুক্তরাজ্যের সৈন্য মারা গেছে ৪৫৬ জন। কনট্রাক্টর মারা গেছে ৩ হাজার ৯৫৭ জন।
২০০১ সালের আফগানিস্তান আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাথে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি জড়িত ছিল। অভিযান সম্পন্ন করার পর সেখানে ন্যাটোর সব সদস্য দেশসহ মোট ৪০টি দেশের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় সিকিউরিটি মিশন তথা ইন্টারন্যশানাল সিকিউটির এসিসট্যান্স ফোর্স।
বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনই প্রেসিডেন্ট হবার আগে নির্বাচনী প্রচারনায় তাদের অবস্থান ছিল যুদ্ধ বিরোধী। কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার পর দ্রুত বদলে যায় তাদের এ অবস্থান। ২০১৬ সালে ওবামা একই সাথে বোমা বর্ষন করেন সাতটি দেশে। অর্জন করেন মনিকার ড্রোন কিং। অপর দিকে ট্রাম্প যুদ্ধ বিস্তার ঘটান ইয়েমেনে। ইরানী জেনারেল কাসেম সোলয়ামানীকে হত্যার নির্দেশের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন তিনি। ট্রাম্প অনুমতি দিয়েছেন আফগানিস্তানে মাদার অব অল বম্ব নিক্ষেপের। ২০১৭ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তানের নাঙ্গারহার রাজ্যে ৯ হাজার ৫শ কেজি ওজনের একটি বোমা বর্ষন করা হয়।
নির্বাচনের আগে বাইডেনেরও প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধ নয় কূটনীতিকেই প্রাধান্য দেয়া হবে সমস্যা সমাধানে। অনেকের আশা ছিল বাইডেন প্রশাসন হয়তো মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আনবেন। কিন্তু তার সিরিয়া হামলা প্রমানিত হয়েছে সমস্যা সমাধানে তিনি সমরনীতিকেই বেছে নিয়েছেন।
বাইডেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ করবেন। কিন্তু এ যুদ্ধ বন্ধে তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন এমনটা আশা করা যাচ্ছে না। তিনি কেবলমাত্র সৌদি আরবের কাছে কিছু অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করবেন এবং সৌদি আরবের আগ্রাসী ভূমিকা লাঘবের চেষ্টা করবেন।
সাংবাদিক জামাল খাসোজি হত্যায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের জড়িত থাকার কারনে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে। ইরানসহ বিভিন্ন কারনে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের বিরুদ্ধে বেশিদূর অগ্রসর হবে না বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। ইতোমধ্যে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবে হুতি আক্রমনের নিন্দা জানিয়েছে। হুতিদের আক্রমন থেকে সৌদি আরবকে রক্ষার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছে বাইডেন প্রশাসন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দূত টিমোথি লেন্ডারিং সৌদি আরবের প্রশংসা করেছেন কয়েক দশক ধরে ইয়েমেনীদের প্রতি উদার সহায়তার জন্য।
অপরদিকে ইসরাইলে আমেরিকান দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রতি আগেই পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন বাইডেন। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্বের প্রতি এটি একটি বড় ধরনের সমর্থন। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিস ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে এক মিটিংয়ে ইসরাইল এবং ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতি হোয়াইট হাউসের অবিচল অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন।
ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়া বিষয়ে পেছনে সরে এসেছেন বাইডেন। এমনকি ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় ফিরিয়ে আনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি এ বিষয়েও গড়িমসি করছেন । বরং তিনি সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের ওপর আক্রমন চালিয়ে বরং ইরানের বিরুদ্ধে ভিন্ন বার্তা দিলেন।