লিবিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক-রাশিয়ার নতুন মেরুকরণ


  • মেহেদী হাসান
  • ২০ মার্চ ২০২১, ০৮:১৭

ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্ঘাত আর বৈশ্বিক আধিপত্যকেন্দ্রিক রাজনীতির হটস্পট হতে পারে লিবিয়া । লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করলেও বাইডেন প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করবে না। ফলে লিবিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক এবং রাশিয়ার মধ্যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটতে পারে।

লিবিয়ায় বাইডেন প্রশাসনের চাওয়া রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূমিকা কমিয়ে আনা বা দেশটি থেকে বের করে দেওয়া। এর ফলে ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার মধ্যে নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা হতে পারে। সিরিয়া ও নাগরনো-কারাবাখের মতো লিবিয়াতেও তুরস্ক-রাশিয়া এক কাতারে দাঁড়াতে পারে। যা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

অপরদিকে, রাশিয়ার লাগাম টানতে বাইডেন প্রশাসন লিবিয়ায় তুরস্কের পক্ষ নিতে পারে। ওয়াশিংটন-আঙ্কারা এক হয়ে জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত সরকারের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে পারে। লিবিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক উন্নয়নেরও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে পড়তে পারে। কারণ, বাইডেন প্রশাসন চাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়ায় তুরস্কের ভূমিকার বিরুদ্ধে। ফলে লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা জটিল সমীকরণ তৈরি করতে পারে।

অনেকের মতে বাইডেন প্রশাসনের লক্ষ্য লিবিয়া থেকে রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়কে বের করে দেয়া এবং নিজেদের সেনা উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে নতুন মেরুকরণ। ন্যাটোর একমাত্র সদস্য হিসেবে লিবিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি পছন্দ করছে না বাইডেন প্রশাসন। রাশিয়ার মোকাবেলায় লিবিয়ায় তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে চাইলেও তুরস্ক এ ধরনের ব্যবহারের সুযোগ দেবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলায় রাশিয়া-তুরস্ক ভাল বোঝাপড়ায় সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেন দায়িত্ব গ্রহনের পর টেলিফোনে কথা বলেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কভুসগ্লুর সাথে। তারা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে, সিরিয়া সঙ্কট, পূর্ব ভূ-মধ্য সাগর নিয়ে উত্তেজনা, তুরস্ক-রাশিয়া প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এবং ফেতুল্লাহ গুলেনের মতো দুদেশের সর্ম্পকের বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু এ আলোচনায় স্থান পায়নি লিবিয়া প্রসঙ্গ। অথচ লিবিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে সম্পর্ক জটিল রুপ ধারণ করতে পারে।

লিবিয়া নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান তুরস্ককে সাহসী ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করেছে। লিবিয়া গৃহযুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। ফলে সেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, রাশিয়া আর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তুরস্ক ভুমিকা রাখতে পেরেছে। এসব শক্তির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে। লিবিয়ায় তুরস্কের পক্ষে রয়েছে ইতালী এবং কাতার। এ সংঘাতে মিশর ও তুরস্ক মুখোমুখি অবস্থানে দাড়ায়। এমনকি লিবিয়ায় তুরস্কের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে লিবিয়ায় সামরিক অভিযানের হুমকি দিয়েছিলো মিশর।

জাতিসংঘ স্বীকৃত লিবিয়ার গভমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড বা জিএনএ সরকারকে খলিফা হাফতার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষায় তুরস্ক সেখানে সামরিক অভিযান শুরু করে ২০১৯ সাল থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, রাশিয়ার বিপরীতে দাড়িয়ে তুরস্ক সেখানে জিএনএ সরকারের পক্ষে কার্যকরী ভূমিকা পালন কঠিন হয়ে পড়ছে। তুরস্ক বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখেও পড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত লিবিয়ার হাফতার বাহিনীকে অর্থ, অস্ত্র, তেলসহ যাবতীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়াও গোপনে হাফতার বাহিনীকে বিমান সহায়তা দিয়েছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও হাফতার বাহিনীর পক্ষে ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে। তুরস্কের ঘাটিতে মিশর ফ্রান্সের তৈরি রেফালে বিমানের সাহায্যে আক্রমণ করেছে।

আসলে ট্রাম্প প্রশাসনের নিরব ভূমিকার কারণে লিবিয়া ঘিরে অনেক শক্তি নাক গলানোর সুযোগ পেয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভবিষ্যতে বৃহত্তর আরবে লিবিয়া একটি হট স্পট হতে পারে। বাইডেন প্রশাসন লিবিয়ায় সক্রিয় হলে অনেক শক্তি সেখানে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে।

বাইডেন প্রশাসন ইতোমধ্যে তুরস্ক, রাশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তাদের সৈন্য ও ভাড়াটিয়া বাহিনী লিবিয়া থেকে সরিয়ে নেয়ার আহবান জানিয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, লিবিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্প প্রশাসনের মত নিরব ভূমিকা পালন করবে না। লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থান জিএনএ সরকারের পক্ষে। বাইডেন প্রশাসনও যদি জিএনএ সরকারের পক্ষে ভূমিকা পালন করে থাকে তাহলে তুরস্ককে বাইডেন প্রশাসন কোনো চাপ সৃষ্টি করবে কি না সে প্রশ্ন সামনে এসেছে।

লিবিয়ায় তুরস্কের ভূমিকাকে বাইডেন প্রশাসন কিভাবে মূল্যায়ন করে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ অনেক আরব দেশের অভিযোগ তুরস্ক সম্প্রসারণবাদি ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছে। তারা নিও-অটোম্যান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তুরস্কের এ ভূমিকার বিরুদ্ধে অনেক আরব রাষ্ট্র। আর এসব অনেক আরব শাসকদের মূল পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র জিএনএ সরকারের পক্ষ নিলেও আরবদের বিরুদ্ধে গিয়ে তুরস্ককে কতটা ছাড় দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি জিএনএ সরকারের পক্ষে অধিকতর ভূমিকা পালন করে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রগুলো লবিং করবে তুরস্কের ভুমিকা কমানোর জন্য। ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ওয়াশিংটনে অনেক তদ্বির করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে ব্যবধান বাড়ানোর জন্য। সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে তুরস্ক ইসলামী চরমপন্থীদের সমর্থন দিচ্ছে। আর এ ধরনের একটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হতে পারে না।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রচেষ্টা সফল হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নতুন বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্প প্রশাসনের মত আমিরাতী শাসকদের প্রতি সহানুভূতিশীল নাও হতে পারে। রাজনৈতিক ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদ এত সহজে বাইডেনের প্রশাসনকে বোঝাতে পারবে বলে মনে হয় না।

ট্রাম্প একটা বিষয়ে বিদ্রোহী হাফতার বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল। তা হলো হাফতারের বাহিনী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এখন হাফতারের পক্ষে কোনো এজেন্ডায় বাইডেন প্রশাসন সমর্থন দেবে না।

এক সময় অটোম্যান সাম্রাজ্যর অধীনে থাকা লিবিয়াসহ আরব ও উত্তর আফ্রিকায় তুরস্ক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে এমন অভিযোগ ছড়িয়ে পড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ধরনের অভিযোগ খাড়া করেছে। দেশটি মনে করে তুরস্ক ঔপনিবেশিক মোহমায়ায় ভুগছে।

এমন পরিস্থিতিতে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন লিবিয়া নিয়ে বাইডেন-এরদোয়ান সম্পর্ক উন্নয়নের পরিবর্তে নতুন দ্বন্দ্বের কারণ হতে পারে। যেখানে ফ্যাক্টর হতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাইডেন প্রশাসন চাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে। এরদোয়ানের লিবিয়া নীতি পছন্দ করছে না ইরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া ভূ-মধ্যসাগর, সাইপ্রাস নিয়ে গ্রীস-তুরস্ক দ্বন্দ্বেও ইউরোপী ইউনিয়ন প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে গ্রীসের পক্ষে। ন্যাটোর অন্য দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রকে লিবিয়ায় সক্রিয় দেখতে চায় তুরস্ককে নয়।

তবে লিবিয়া ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের সাথে বোঝাপড়ায় তুরস্কের হাতে এখনো অনেক পয়েন্ট রয়েছে । এর একটি হলো রাশিয়ার ভূমিকা কমাতে তুরস্ককে ছাড় দেয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্র সেপথে যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ বাইডেন প্রশাসনের লক্ষ্য লিবিয়ায় তুরস্ক-রাশিয়া উভয়ের ভূমিকা কমিয়ে আনা। এতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ। ফলে লিবিয়ায় স্বার্থ রক্ষায় বাইডেন প্রশাসন সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে। এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারে ইরোপীয় দেশগুলো।

শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ লিবিয়া থেকে রাশিয়ার হাত গুটিয়ে আনা। আর তুরস্কের ওপর নির্ভরতাও কমাতে চায় বাইডেন প্রশাসন। সে ক্ষেত্রে লিবিয়া নিয়ে তুরস্কের নীতিতে আসতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তন।

যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্ককে ব্যবহার করতে চাইলেও তুরস্ক সে পথে নাও যেতে পারে। তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতিতে এটি স্পষ্ট , আংকার মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভূমিকা পালন করবে না। অপরদিকে রাশিয়া চাইছে, তুরস্ককে সাথে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়দের ভূমিকা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে। যাতে তুরস্ক বেশি লাভবান হবে।

রশিয়ার এই নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে সিরিয়া এবং নাগরনো-কারাবাখে। যেখানে মস্কো ও আঙ্কারা এক সাথে কাজ করছে। লিবিয়ার ক্ষেত্রেও এমন ঘটতে পারে। রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করার মতো বোকামি করবে না তুরস্ক। বরং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা ছাড়াই তুরস্ক-রাশিয়া এ অঞ্চলে ভাল বোঝাপড়া করতে সক্ষম। এছাড়া তুরস্ক আগে থেকেই জিএনএ সরকারের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে। যে সরকারকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে তুরস্ক লিবিয়া সরকারের পক্ষে কেন ভূমিকা পালন করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। বরং রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতিসংঘের বিপরীতে দাড়িয়ে ভূমিকা পালন করছে । ফলে তুরস্কের অবস্থান সেখানে যৌক্তিক।

বাইডেন প্রশাসন মনে করতে পারে লিবিয়া থেকে তুরস্কের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য করার পরও তুরস্ক তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে না। কারণ নিজের স্বার্থে ওয়াশিংটনের সাথে আঙ্কারার ভালো সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। অপর দিকে বাইডেন প্রশাসনকে তুরস্ক বোঝাতে চেষ্টা করবে, আঙ্কারা এবং ওয়াশিংটন এক কাতারে দাড়িয়ে জাতিসংঘের হয়ে লিবিয়া সরকারের পক্ষে ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। এ কূটনীতিতে তুরস্ক কতটা সফল হয় তা দেখার বিষয়।