যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ফ্রিডম হাউস তাদের সর্বশেষ ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতের নাগরিক অধিকার পরিস্থিতি এখন খুবই নিম্নগামী। ভারতের অবস্থান এ তালিকায় বরাবরই বেশ পেছনের দিকেই থাকে। গত বছরের তুলনায় এবার আরও পাঁচ ধাপ নেমে গেছে। ভারতের বিষয়ে ফ্রিডম হাউসের পর্যবেক্ষণ হলো- ভারতে অনেক কিছুই স্বাধীন মনে হলেও দেশটির মানুষ বাস্তবে খুব সামান্যই স্বাধীনতা ভোগ করে।
ফ্রিডম হাউস বিশ্বের ২১১টি দেশকে নিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে। কিছু দেশকে স্বাধীন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিছু দেশকে আংশিক স্বাধীন এবং কিছু দেশকে একেবারেই বন্দিদশার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে ২০১৪ সাল থেকেই রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার অনেকটাই খর্ব হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে। তাদের কার্যক্রমকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদেরকে কোণঠাসা করে রাখার পাঁয়তারা চলছে। হিন্দু ধর্মান্ধগোষ্ঠীর হামলার মাত্রা বেড়েছে। মুসলিমদের ওপর গণহারে আক্রমণের ঘটনার সংখ্যাও অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে। মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তবে দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরাও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে সাংবিধানিকভাবে নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের সুযোগ থাকলেও প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে এসে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সাংবাদিকদের ওপর হয়রানি এবং সরকারের সমালোচকদের মুখ চেপে ধরার প্রবণতা বেড়েছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ওপর শুধুমাত্র শারীরিক নিপীড়নই বাড়েনি বরং তাদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখার প্রচেষ্টাও দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাংবাদিক, ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ইনফরমেশন টেকনোলোজি এ্যাক্ট নামক একটি আইন প্রনয়নের মাধ্যমে নাগরিকদের সরকারের সমালোচনার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন এবং কভিড-নাইনটিন পরিকল্পনা নিয়ে যারা কথা বলেছেন তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্য সরকার হরহামেশাই এ আইনের প্রয়োগ করছে। মানবাধিকার সংগঠন এবং জনগনের প্রতিবাদ কর্মসূচীর ওপর পুলিশের মারমুখী মনোভাবও অতীতে এভাবে লক্ষ্য করা যায়নি।
পরপর তিন বছর মানবাধিকার পরিস্থিতির তালিকায় ভারতের পতনের ধারাবাহিকতা চলেছে। ২০১৯ সালে সরকারের গৃহীত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার সরকার ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দেয়। সংবিধানের ৩৭০কে বিলুপ্ত করে কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসিত অবস্থান বাতিল করে দেয়ার পরও প্রশাসন সেখানে সব ধরনের বন্ধ করে দিয়েছিল।
বিশ্বের বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত নিজেদেরকে দাবি করলেও কার্যত মোদির সরকার এখন জাতিকে বিভক্ত করার এবং কর্তৃত্বপরায়ণ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের কারণে ভারতে যখন লকডাউন আরোপ করা হয় তখন অনেক স্থানে মুসলিমদেরকে ধরে ধরে তাদের মুখে কাশি দেয়ার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয় বলে অনেক গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। উগ্রবাদী হিন্দুরা তখন প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারণাও চালায় , মুসলিমদের কারণেই ভারতে করোনা ভাইরাসের আমদানি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই লকডাউনে চলে যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে যায় এবং শহরে থাকা কোটি কোটি ভাসমান মানুষ জীবন ও জীবিকা ভয়ংকর সংকটের মুখে পড়ে। এমনকী নিজেদের এলাকায় ফিরে যাওয়ার মতো কোনো যোগাযোগ মাধ্যমও তারা পায়নি। পায়ে হেটে তাদেরকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে যে দাঙ্গা শুরু হয় তা নিয়েও এই প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ দাঙ্গায় ৫০ জন মানুষ নিহত হয় যার অধিকাংশই মুসলিম। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের মিত্ররা বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন সব বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যা সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে এবং জাতিগত বৈষম্যের পরিমান বাড়াচ্ছে।
ভারত নিয়ে ফ্রিডম হাউসের এই প্রতিবেদন তাৎপর্যপূর্ন। কারণ মার্কিন সরকারের অর্থায়নে এ থিঙ্কট্যাঙ্কটি পরিচালিত হয়। ফলে এ প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ মার্কিন নীতিনির্ধারণী মহলে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগের প্রতিবেদনগুলোতে ভারতকে স্বাধীন দেশ হিসেবে মুল্যায়ন করলেও ২০২০ সাল থেকে ফ্রিডম হাউস ভারতকে আংশিক স্বাধীন দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফ্রিডম হাউসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পৃথিবীর মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ এখন স্বাধীন দেশগুলোতে থাকার সুযোগ পাচ্ছে।
ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বল হয়, বিরোধী দলগুলোকে একপেশেভাবে কোনঠাসা করা হলেও সরকার সমর্থক নেতাকর্মীরা বড়ো বড়ো অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দায়ে যেসব বিজেপি নেতা অভিযুক্ত হয়েছিলেন গত সেপ্টেম্বরে আদালত তাদের সকলকেই খালাস দিয়ে দিয়েছে। আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ এখন সর্বজনবিদিত। বিজেপি কয়েকযুগ আগে বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের যে লক্ষ্যের কথা বলেছিল, সর্বশেষ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যপূরণের পথও বাস্তবায়িত হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের এ জাতীয় নজির ইতোপূর্বে ভারতে দেখা যায়নি।
ভারতের নির্বাচন কমিশন নিয়ে এর আগে কখনো তেমন বিতর্ক শোনা না গেলেও ২০১৯ সাল থেকে ভারতের নির্বাচন কমিশনের রাজনীতিকরণ। সরকারের পক্ষে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন ব্যবস্থায় নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মতো বিষয়গুলো সরকারের পক্ষেই গিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন।
ভারতের রাজনীতিবীদরাও আগের মতো করে আর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা ইস্যুতে সংঘাত চলমান থাকায় স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড ব্যহত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অনেক স্থানেই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বৃদ্ধির নেপথ্যে ভূমিকা রাখছেন। প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করার স্বার্থে তারা সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোকে নিজেদের মতো করেও ব্যবহার করছেন।
মুসলিমরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ হলেও লোকসভায় ৫৪৫টি আসনের মধ্যে মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ২৭ জন। লোকসভার মোট আসনের মাত্র ৫ শতাংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার ভারতে আজও হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে।
আসামে বসবাসরত প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার নাগরিকত্বও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই প্রদেশে বিপুল সংখ্যক মুসলিম ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজনকে উদ্বাস্তু করার পরিকল্পনা থেকে এ আইন বাস্তবায়নের উদ্যেগ নেয়া হয়েছিলো।
ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোদি সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ও নিপীড়ন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। মিডিয়ার কন্ঠরোধ করার জন্য প্রশাসন নিরাপত্তার হুমকি, মানহানি, রাষ্ট্রদোহিতা, ঘৃনা ছড়ানো ও আদালত অবমাননার মতো অভিযোগ আনছে। সরকার বিরোধী যে কোনো মন্তব্যকে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হিসেবে গন্য করা হচ্ছে।
সরকারের মহামারি সংক্রান্ত কৌশলের সমালোচনা করায় ২০২০ সালে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে আটক করা হয়। মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে দিয়ে সরকারের পক্ষে প্রতিবেদন করানোর অভিযোগ তোলা হয়। ২০২০ সালের মার্চে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি ভিডিও কনফারেন্সে এসে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে নেতিবাচক, হতাশাব্যাঞ্জক ও গুজব না রটানোর জন্য আহবান জানান।
সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করছেন, তারা নিয়মিতভাবে খুন হওয়ার হুমকি পান। কর্মক্ষেত্রে ও বাসায় যাতায়াতের সময় তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। অধিকাংশক্ষেত্রেই এসব হামলার কোনো তদন্ত হয় না। যারা সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হয় তাদেরকেও বিচারের মুখোমুখি করা হয় না। অনেকক্ষেত্রে পুলিশও এসব অভিযোগকে গুরুত্বের সাথে নেয় না এবং অনেকটাই নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে।
ভারতের ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু হলেও দেশটি নিজেদেরকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অথচ দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বেশ কিছু সংস্থা এবং কয়েকটি গনমাধ্যম প্রকাশে মুসলিম বিরোধী প্রচারনা চালায়। গরুর গোশত খাওয়াকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের হত্যার ঘটনাও ২০২০ সালে অনেক বেড়েছে।
ইন্ডিয়াস্পেন্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান জানায় ভারতে এক বছরের মধ্যে গরুর গোশত খাওয়াকে কেন্দ্র করে ৪৫ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে গরুকে অসম্মান করা হয়েছে এ অভিযোগ তুলে ১২০টি জায়গায় দাঙ্গার সূত্রপাত করা হয়েছে। গনপিটুনিতেও লোক হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার এসব কোনো অনিয়ম ও অনাচারের বিষয়েই কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি বলে ফ্রিডম হাউস দাবি করেছে।