ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের কূটনৈতিক লড়াই


  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ মার্চ ২০২১, ১৬:৩২

ককেশাস অঞ্চল তুরস্কের জন্য পুরনো পরিচিত জায়গা। উসমানিয়া খেলাফতের আমলে কয়েকশ বছর ধরে জর্জিয়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং আর্মেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণ ককেশাসের পশ্চিমাঞ্চল ছিল অটোমান সুলতানদের নিয়ন্ত্রণে। অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর ওই অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও তুরস্ক এই অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টায় তেমন কোনো সফলতা পায়নি। এরপর কেটে গেছে বহুদিন। আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠারও শত বছর পূর্ণ হতে চলেছে । সম্প্রতি তুরস্ক তার এই পুরনো এলাকা ককশাসে ফিরে এসেছে নতুন রূপে।

নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান করে। এতে বিজয়ী হয় আজারবাইজান। পরাজিত হয় তুরস্কের পুরনো শত্রু আর্মেনিয়া। এরপর থেকেই তুরস্ক ককেশাস অঞ্চলে তার অবস্থান শক্ত করার জন্য সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে জোরালো চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

একদিকে এই অঞ্চলের প্রতি তুরস্কের রয়েছে পুরনো দুর্বলতা, অন্যদিকে ককেশাস ছাড়াও আশপাশের অঞ্চলে জড়িত রয়েছে তুরস্কের নানা স্বার্থ। তবে এখনো তেমন কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি আঙ্কারা। তার পরও দেশটি এই অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত প্রায় তিন যুগ ধরে তুরস্ক ককেশাস অঞ্চলে তার মিত্র আজারবাইজানকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তা তেমন উল্লেখ করার মতো ছিলনা। নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানকে পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা দিতে শুরু করে। অস্ত্র দেয়ার পাশাপাশি সেনাদলও পাঠান প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান। ৪৪ দিনের এই যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোন ও সেনা কমান্ডাররা আজারবাইজনকে বিজয়ী হতে বড় ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে আর্মেনিয়াকে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলো সামরিক সহায়তা সহায়তা দিলেও তাতে সফলতা আসেনি। বরং তুরস্ক আজারবাইজানকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে প্রকারান্তরে রাশিয়ার উঠোনে গিয়ে হাজির হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, আজারবাইজানকে সহযোগিতা দিয়ে তুরস্ক ককেশাস অঞ্চলে নিজের জন্য কতটুকু কি অর্জন করতে পেরেছে? বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, এখন পর্যন্ত তুরস্কের অর্জন খুবই সামান্য যা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। তুরস্কের জন্য প্রথম যে সমস্যাটা তৈরি হয় তা হচ্ছে গত ১০ নভেম্বর যে ত্রিপক্ষীয় অস্ত্র বিরতি চুক্তি হয় তাতে তুরস্কের কোন নাম ছিলনা। চুক্তিটি হয় আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে।

তুরস্কের কর্মকর্তারা বারবার উল্লেখ কেেছন যে, তারা এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি মনিটরিং এবং ভবিষ্যতে নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলের মর্যাদা কি হবে সেই আলোচনা প্রক্রিয়ার অংশ হতে চান। এমনকি ১২ নভেম্বর তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু ঘোষণা দেন যে, অস্ত্র বিরতি চুক্তি মনিটরিং করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার যে ভূমিকা হবে তুরস্কের ভূমিকাও ঠিক তাই হবে।

কিন্তু রাশিয়ার কূটনীতিরা তুরস্কের এই দাবি উড়িয়ে দেন। তারা বলেন, এই চুক্তিতে কেবল যুদ্ধরত দুই দেশ ও রাশিয়া অংশিদার হবে। এখানে তুরস্কের কোন ভূমিকা নেই। এরপর অবশ্য মধ্য নভেম্বরে তুরস্ক-রাশিয়ার যৌথ মনিটরিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি যখন সেই সেন্টারটি চালু করা হয় তখন দেখা যায় সেটি স্থাপন করা হয়েছে কারাবাখ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে মাত্র ১০০ জনের মতো জনবল রয়েছে যাদের অর্ধেক হচ্ছে তুরস্কের। অন্যদিকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া কারাবাখে ভারী অস্ত্র ও যান সজ্জিত ২০০০ এর বেশি সেনা সদস্য মোতায়েন করে। এসব লোকজন সরাসরি আজারবাইজানী ও কারাবাখের আর্মেনিয়ানদের সাথে কাজ করতে থাকে। এখানে তুরস্কের কোনই উপস্থি’তি নেই। এর মাধ্যমে নাগর্নো-কারাবাখের পরিস্থিতি কার্যত রাশিয়ার অনুকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। তুরস্ককে সাইডলাইনে অর্থাৎ দর্শকের ভূমিকায় ঠেলে দেওয়া হয়।

নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে কূটনৈতিক ফ্রন্টে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার যে চেষ্টা তুরস্ক করেছিল তাতেও সফল হননি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি কোঅপারেশন ইন ইউরোপ এর মিনস্ক গ্রুপ কারাবাখ নিয়ে অস্ত্র বিরতি চুক্তির ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে প্রাথমিক দায়িত্বটি পালন করেছে। এখানে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও তুরস্ক সফল হয়নি।

আঞ্চলিক সংলাপ ফোরাম গঠনের বিষয়ে তুরস্ক যে পরামর্শ দিয়েছিল তার প্রতিও কোন আগ্রহ দেখায়নি রাশিয়া ও আর্মেনিয়া। তুরস্ক ৩+৩ ফর্মুলা অর্থাৎ আর্মেনয়া, আজারবাইজন ও জর্জিয়া এবং রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানকে নিয়ে এই ফোরাম গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভুত কাভুসোগলু। কিন্তু আর্মেনিয়া ও জর্জিয়া তার এই প্রস্তাব মেনে নিতে রাজী হয়নি।

ককেশাস অঞ্চলে তুরস্ক আরেকটি বিরোধ মিমাংসার চেষ্টা করেছিল। আর সেটি হচ্ছে আর্মেনিয়ার সাথে আঙ্কারার বহু পুরনো বিবাদের সমাপ্তি ঘটানো। কিন্তু এই উদ্যোগও সফল হয়নি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তুরস্কের কর্মকর্তারা আর্মেনিয়ার সাথে তাদের সীমান্ত পুনরায় চালু ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা বারবার বলে আসছিলেন। কিন্তু এতে সাড়া মেলেনি আর্মেনিয়ার দিক থেকে।

এখন তুরস্ক যদি একতরফাভাবে আর্মেনিয়ার সাথে তার সীমান্ত চালু করে তাহলে সেটা আর্মেনিয়ার বিজয় হিসেবেই দেখা হবে। রাশিয়া অবশ্য এতে খুশিই হবে। কারণ তখন মস্কো আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার ভূখন্ড ব্যবহার করে তুরস্কের সাথে সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হবে

আর্মেনিয়ার সাথে বহু পুরনো রাজনৈতিক বিরোধের বিষয়টি মাথায় রেখে তুরস্ক একতরফা ভাবে সীমান্ত চালু করবেনা। বরং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সব সময়ই আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়ে আসছেন। এবং একইসঙ্গে আজারবইজানের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আর্মেনিয়ানদের উপর গনহত্যা চালানোর যে অভিযোগ তুরস্কের বিরুদ্ধে রয়েছে সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কোন সমবেদনা বা সহানুভূতি মূলক কথা আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্যে কখনো বলেননি। এরপর নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়ার সাথে আজারবাইজানের যুদ্ধে তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানকে সমর্থন দেয়ায় আর্মেনিয়ার সাথে তুরস্কের বিরোধ অবসানের সম্ভাবনা আরো কমে গেছে।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে ককেশাস অঞ্চলে সাম্প্রতিক অভিযাত্রায় তুরস্কের ঝুলিতে তেমন কোন সাফল্য জমা হয়নি। এমনকি যে আজারবাইজানের পক্ষ নিয়ে তুরস্ক লড়াই করেছে তারাও খুব সতর্ক পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছে। দেশটি একই সাথে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশে^র সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে। এটা তুরস্কের জন্য একটা বড় ধাক্কা। তুরস্ক আবার জর্জিয়া কিংবা আর্মেনিয়ার সাথে ত্রিমুখি কোন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। তবে তুরস্ক বসে নেই। মধ্যএশিয়ার গ্রেট গেমে তুরস্ক তার অবস্থান শক্ত করার নানা পদক্ষে নিচ্ছে।

স্নাায়ু যুদ্ধের অবসান, বিশ^ায়নের নতুন ঢেউ, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা, নতুন বিশ^ পরি¯ি’তির সাথে সব দেশকে খাপ খাওয়ানোসহ সার্বিক যে বিশ^ পরিস্থিতি তার সাথে তুরস্ককেও নিজের অবস্থান সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। ককেশাস অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়াতে হলে তুরস্ক এখন এ অঞ্চলে ঝড়ো গতির কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একের পর এক মধ্যএশিয়ার দেশগুলো সফর করছেন। উজবেকিস্তান, কাজখাস্তানের সাথে যোগাযোগ ও বানিজ্য সম্প্রসারনের নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন।

তুরস্ক এ ক্ষেত্রে সফট পাওয়ার পলিসি গ্রহন করেছে। ভাষাগত নৈকট্যর কারনে তুর্কি সিনেমা, মুভি ও সাংস্কৃতিক ফ্রান্টে কাজ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। এসব অঞ্চলে তুর্কি প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে এ কথা বলতে হবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিলো মধ্যএশিয়ার এসব দেশ ফলে রাশিয়ার বিপুল প্রভাব আছে এ অঞ্চলে। সে কারণে ককেশাস অঞ্চলে কূটনৈতিক লড়াইয়ে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের পেরে উঠা সহজ নয় । কিন্তু তুরস্ক বসে নেই। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধে তার সরব উপস্থিতির প্রমান দিয়েছে।

এখন যে কূটনৈতিক লড়াই চলছে তাতে সাফল্য পেলে তুরস্ক একদিকে যেমন ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব কমাতে পারবে, তেমনিভাবে মধ্যপ্রাচ্যেও নিজের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে।