পাকিস্তান-ভারত অস্ত্রবিরতির নেপথ্যে চীন

-

  • মোতালেব জামালী
  • ১৬ মার্চ ২০২১, ১২:৩৮

ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দুই দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ কাশ্মির ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণরেখায় হঠাৎ করেই কঠোর অস্ত্রবিরতি মেনে চলতে সম্মত হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে হটলাইনে আলোচনার পর উভয়পক্ষ এই সিদ্ধান্ত নেয় বলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নিয়ন্ত্রণরেখা ও অন্যান্য সেক্টরে উভয়পক্ষ সব চুক্তি, সমঝোতা ও যুদ্ধবিরতির কঠোর নজরদারিতে একমত হয়েছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত কাশ্মির ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণরেখায় ২০০৩ সাল থেকে উভয়পক্ষের সম্মতিতে যুদ্ধবিরতি চালু হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ই তা ভঙ্গ করা হয়েছে। এতে দুই পক্ষেরই সামরিক ও বেসামরিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

গত বছর ভারতীয় বাহিনীর কামানের গোলা বর্ষণ ও গুলিতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরে অন্তত ২৮ বেসামরিক লোক নিহত ও ২৫৭ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানায় পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাকিস্তানের দাবি, চলতি বছরে এ পর্যন্ত ভারত অন্তত ১৭৫ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে যাতে আট বেসামরিক লোক আহত হয়েছেন।

অন্যদিকে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, ২০২০ সালে পাকিস্তান অন্তত পাঁচ হাজার ১৩৩ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে যাতে ২২ বেসামরিক লোক ও ২৪ সৈন্য নিহত এবং ১৯৭ জন আহত হয়েছেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মির নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। উভয় দেশই পুরো ভূখণ্ডটি নিজেদের দাবি করছে। ভূখণ্ডটির অধিকার নিয়ে উভয় দেশ দু’বার যুদ্ধে জড়িয়েছে ।

আকস্মিক এই অস্ত্র বিরতির ঘোষণার ঠিক দু’বছর আগে কাশ্মিরে ভারত ও পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর মধ্যে লড়াই হয়েছে। পাকিস্তান ভারতের একটি বিমান ভূপাতিত ও এর পাইলটকে আটক করে। পরে অবশ্য তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু এবারের আকস্মিক অস্ত্র বিরতির ঘোষণার আগে এ বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে এমন কথাও শোনা যায়নি। এখন ঠিক কি কারণে হঠাৎ করে দুই ঘোরতর শত্রু দেশ কঠোর অস্ত্র বিরতিতে সম্মত হলো তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

বিরোধপূর্ণ লাদাখ অঞ্চলে সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীন তাদের মধ্যে বৈরিতা অবসানের জন্য গত ১১ ফ্রেব্রুয়ারি চুক্তি স্বাক্ষর ও হটলাইন চালুর ঘোষণা দেয় । এর পরপরই পাকিস্তান ও ভারত কাশ্মিরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় অস্ত্র বিরতি মেনে চলার কথা জানাল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, ভারত-চীন এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আকস্মিক অস্ত্রবিরতির ঘোষণার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থাৎ বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা রয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের সাথে পাকিস্তানের আকস্মিক অস্ত্র বিরতির পিছনে চীনের সাথে ভারতের সমঝোতার বড় ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে অস্ত্র বিরতিতে ভূমিকা রেখেছে যাতে পাকিস্তান কাশ্মিরে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে না রেখে আফগানিস্তানে তালেবানকে যুদ্ধ বন্ধ করে একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসতে রাজী করাতে পারে। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি বিষয়।

ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রবীন স্বামী মনে করেন, এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, অস্ত্র বিরতির আকস্মিক ঘোষণা দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ৪টি দেশের মধ্যে একটি বোঝাপড়া হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই কাশ্মিরে এই অস্ত্র বিরতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলে বিষেøষকরা মনে করেন। তাদের মতে, বিরোধপূর্ণ সীমান্ত থেকে সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ভারত তাদের কিছু সৈন্যকে সরিয়ে নিলেও সীমান্ত সংঘাত নিয়ে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে চীনকেই বেশি ভয় করছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সিনিয়র সাউথ এশিয়া এসোসিয়েট মাইকেল কুগলম্যান বলেন, ‘চীনের ব্যাপারে নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে অধিক মনোযোগ দেয়ার প্রতি গুরুত্ব দিতেই ভারত পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে চাইছে।’ দুই দেশের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা কাশ্মিরে আকস্মিক অস্ত্র বিরতির এই ঘোষণা দেয়ার পর এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের পক্ষ থেকে কোন মন্তব্য করা হয়নি। কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় অস্ত্র বিরতির ব্যাপারে গত কয়েক বছরের মধ্যে দুই পক্ষের পারস্পারিক সমঝোতার ও সহযোগিতার এমন নজির আর নেই বললেই চলে।এই অস্ত্র বিরতিতে পাকিস্তান ও ভারত যে সব বিষয় শান্তি বিনষ্ট ও সহিংসতার পথকে উসকে দেবে সেগুলো আমলে নিয়ে তা সমাধানের কথা বলা হয়েছে।

২০০৩ সালের নভেম্বরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় এই অস্ত্র বিরতির সমঝোতা হয়েছিল। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অস্ত্র বিরতির ঘোষণার দু’দিন পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক টুইটে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় পুনরায় অস্ত্র বিরতি কার্যকরের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, এখন শান্তিপূর্ন পরিবেশ সৃষ্টি ও তা বজায় রাখার দায়িত্ব ভারতের উপর বর্তাবে। কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘদিনের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভারতকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভারতের বক্তব্য হচ্ছে, পাকিস্তানের উগ্র গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রন রেখা পার হয়ে এসে জম্মু-কাশ্মিরে অনুপ্রবেশ করে সেখানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এসব গ্রুপের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন রয়েছে। পাকিস্তান বরাবরই ভারতের এই দাবি অস্বীকার করে আসছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলা চলছে।

এর ধারাবাহিকতায়ই দুই বছর আগে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর বালাকোটে বিমান হামলা চালায় ভারত। নয়াদিল্লি দাবি করেছিল , সেখানে পাকিস্তানী জঙ্গি গোষ্ঠি জয়স-ই-মোহাম্মদীর জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পারিচালিত হচ্ছিল। বিমান হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ভারতের দাবি এই গ্রুপটি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে আধাসামরিক বাহিনীর একটি গাড়ী বহরে আত্মঘাতি হামলা করে ৪০ জওয়ানকে হত্যা করেছিল। এর পর থেকেই কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দু’পক্ষের সেনাদের মধ্যে মধ্যে প্রায়ই গুলি বিনিময় হতো।

সেই পরিস্থির অবসান ঘটিয়ে আকস্মিক ভাবেই আবারো স্থায়ী অস্ত্র বিরতির ঘোষণঅ দেয়া হলো। পুনরায় এই অস্ত্র বিরতি ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল গত কয়েক মাসে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে পাকিস্তানের সাথে একটি সমঝোতায় পৌছেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে কে এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। কেননা অজিত দোভালের পাকিস্তানী প্রতিপক্ষ মুঈদ ইউসুফ বলেছেন, তিনি অস্ত্র বিরতি পুন:প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন না। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন ত এখনো রহস্যাবৃত।

অস্ত্র বিরতির সিদ্ধান্তটি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে এসেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা পাকিস্তানের অত্যন্ত ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী দেশটির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির বিষয়ে সব সময়ই হস্তক্ষেপ করে থাকে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া গত ২ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, ‘সব ক্ষেত্রেই শান্তির হাত প্রসারিত করার এখনই সময়। পাকিস্তান একটি শন্তিপ্রিয় দেশ যারা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমরা পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে অঙ্গিকারাবদ্ধ।

ভারত ২০১৯ সালের আগষ্ট মাসে একতরফাভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার ১৮ মাস পর পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের কাছ থেকে এ ধরণের বক্তব্য আসলো।

কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় স্থায়ী অস্ত্র বিরতি পুন:প্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্ত সমগ্র দক্ষিন এশিয়ার জন্যই একটি বড় অগ্রগতির খবর। কেননা, কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের কারণে অনেক সামরিক-বেসামরিক প্রাণহানি ঘটেছে। অস্ত্র বিরতি স্থায়ী হলে তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।

অস্ত্র বিরতির সমঝোতার পর এখন দুই দেশই পরস্পরের রাজধানীতে হাইকমিশন চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা একতরফাভাবে বাতিল করার প্রতিবাদে পাকিস্তান ভারত থেকে তার হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতও একই পদক্ষেপ নেয়। এখন সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবারো তা চালু করা সময়ের ব্যাপারে মাত্র। দ্রুতই দুই দেশ আবারো পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কে ফিরে যাবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।