তুরস্ক-মিসর বৈরিতার অবসান হচ্ছে?


  • মোতালেব জামালী
  • ১৬ মার্চ ২০২১, ১২:১৫

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে দুই বৈরী দেশ তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্ক আবার উষ্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে মতবিরোধ ও বৈরিতা চলে আসছে অনেক দিন ধরেই। এখন তুরস্ক গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে মিসরের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে দুই দেশই লাভবান হবে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরের একই এলাকায় তুরস্ক, মিসর ও গ্রিসের সমুদ্রসীমা রয়েছে। এই এলাকাটি গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ। এই গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন নিয়ে গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে মারাত্মক বৈরিতার সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রের গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ ওই এলাকাটি তুরস্ক ও গ্রিস উভয় দেশই দাবি করে থাকে। আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে তুরস্কের সাথে মিসরের বিরোধের কারণে মিসর তুরস্কের শত্রু দেশ গ্রিসের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক গড় তোলে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রেও মিসর ও গ্রিস একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে।

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলেত কাভুসোগলু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তুরস্ক ও মিসর এমন একটি পয়েন্টে একমত হতে পারে যেখানে সমুদ্রসীমা নিয়ে দু’পক্ষই একটি চুক্তিতে পৌছতে পারে। এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় গিয়ে পৌছবে।

সম্প্রতি মিসর পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তাদের এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন (ইইজেড) এর যে ম্যাপ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় যে, ঐ অঞ্চলটি গ্রিসের চেয়ে তুরস্কের সমুদ্রসীমার সাথেই বেশি সম্পর্কিত। এ কারণে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন নিয়ে তুরস্ক মিসরের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে গ্রিসের চেয়ে তুরস্কের সাথে একটি সমঝাতায় আসাটাই হবে মিসরের জন্য লাভজনক।

কিন্তু তুরস্কের সাথে আঞ্চলিক নানা ইস্যুতে বিরোধ থাকার কারনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসি তুরস্কের প্রস্তাব তাৎক্ষনিকভাবে গ্রহন করেন নি। এমনকি তুরস্কের সাথে মতানৈক্যের কারণে মিসর পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তার এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন (ইইজেড) এর অধিকারও ত্যাগ করতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিলো।

২০১৩ সালের আগষ্টে মিসরের গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে ক্ষমতা সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাতহ আল সিসি দখল করার পর তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বাড়তেই থাকে।

মিসরীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা জাওবা মসে করেন ‘তুরস্কের প্রস্তাব গ্রহন না করে মিসর একটি বড় ভুল করেছে। কিন্তু‘ কায়রোতে ক্ষমতার বলয়ে জেনারেল সিসির চারপাশে থাক লোকজনের চাপের মুখে সিসি হয়তো এখন এটা অনুধাবন করতে পারছেন যে, মিসরের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শুধু গ্রিস ও অন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে নয়, তুরস্কের সাথেও এক ধরণের অংশীদারিত্বে আসতে হবে মিসরকে।

অনেক বিশ্লেষক আশা করেছিলেন পূর্ব ভূমধ্যসাগরের অফশোরে ও লেভান্ত বেসিনে পাওয়া বিশাল গ্যাসের মজুদ এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু গ্রিসের তুরস্কবিরোধী কঠোর অব¯’ানের কারণে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বরং পুরো অঞ্চল জুড়েই নানা সমস্যা তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরীপ বিভাগের সমীক্ষা অনুযায়ী লেভান্ত বেসিনে ১২২দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে। এখন নিজ নিজ এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন থেকে এই গ্যাস আইনগত ও শান্তিপূর্ণভাবে উত্তোলন করার জন্য উপকূলীয় এলাকার দেশগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন নীতিমালা ও সমঝোতা থাকা প্রয়োজন।

সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে চুক্তির পর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে এই আভাষই পাওয়া যাচ্ছে যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের গ্যস অনুসন্ধান ও উত্তোলন নিয়েও আঙ্কারা ও কায়রো পরস্পরের দিকে ক্রমশ:ই কূটনৈতিক সমঝোতার দিকে এগিয়ে আসছে। এই সমঝোতা হয়ে গেলে বর্তমানে বৈরি সম্পর্কের এই দুই দেশের জন্যই অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগের দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। হামজা জাওবা মনে করেন , তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে প্রবল রাজনৈতিক মতবিরোধ সত্ত্বেও দুই দেশের পরস্পরের দিক এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান এর আগে মিসরের নেতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘কায়রো ও আঙ্কারার মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধকে কেন্দ্র করে মিসরের নেতাদের উচিত নয় দেশটির জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে গ্রিসের সাথে কোন চুক্তি করা। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিসর ও গ্রিসের মধ্যে চুক্তি আমাদেরকে ব্যথিত করেছে। কেননা আমাদের সাথে মিসরের সম্পর্ক গ্রিসের সাথে মিসরের সম্পর্কের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা নিয়ে আলোচনা করা উচিত, ভাবা উচিত।

হামজা জাওবা মনে করেন, মিসরের গোয়েন্দা সংস্থা প্রেসিডেন্ট সিসিকে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারে। এ ধরণের পরামর্শ দেয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত: আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠা তুরস্কের সাথে মিসরের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দীর্ঘ দিনের বিরোধ জিইয়ে রাখা উচিত হবেনা।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইসরাইল ও গ্রিসের উপর নির্ভর করাটা মিসরের জন্য মোটেও কাম্য হতে পারেনা। বরং তুরস্কই মিসরের জন্য নির্ভরযোগ্য অংশিদার হতে পারে। জাওবার মতে, অন্যদিকে তুরস্কের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ তুরস্কের উচিত নয় মিসরকে হাতছাড়া করা। সিসি একদিন ক্ষমতায় থাকবেন না, কিš‘ মিসর দেশ হিসেবে টিকে থাকবে।

তুরস্ক ইতিমধ্যেই মিসরের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তার রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা জানিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন গত বছর অক্টোবর মাসে বলেছিলেন, আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে মিসর যদি ইতিবাচক মনোভাব পোষন করে ও সে অনুযায়ী কাজ করে সে ক্ষেত্রে তুরস্ক চুপ করে বসে থাকবেনা, অবশ্যই ইতিবাচক সাড়া দেবে।

তুরস্কের প্রতি সিসির ইতিবাচক মনোভাবের আরেকটি কারণ হচ্ছে উপসাগরীয় অঞ্চলের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও স্বেছাচারি শাসকদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতিবাচক মনোভাব। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে তুরস্ক-কাতার জোটের সাথে সৌদি, আমিরাত ও মিসর ব্লকের প্রবল উত্তেজনার সৃস্টি হয়েছিল। এমনকি এক পর্যায়ে কাতারের উপর অবরোধও আরোপ করেছিল সৌদি ব্লক। কিন্তু ট্রাম্পের আমলের শেষ দিকে উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা কমে এসেছিল এবং কাতারেরসাথে সৌদি-আমিরাত ব্লকের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

বর্তমানে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে খুবই রাজনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে প্রকাশ করা গোয়েন্দা নথিতে দেখা গেছে যে, যুবরাজ সালমান তার সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে আটক ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের হুমকির মুখে রয়েছে সৌদি আরব ও আমিরাত।

হামজা জাওয়াব মনে করেন, এই পরিস্থিতির কারনে সৌদি আরব ও আমিরাত তুরস্কের জন্য বড় কোন সমস্যা হবে না। একই কারণে সৌদি আমিরাত ব্লক মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসির উপর তাদের নিয়ন্ত্রণও বজায় রাখতে পারবেনা। আর এমনটা হলে মিসর তার পররাষ্ট্র নীতি নতুন করে সাজাবে। তখন তারা নিজেদের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করবে, সৌদি ও আমিরাতের পক্ষ হয়ে লড়বেনা। তুরস্কের দিকে মিসরের ঝুকে পড়ার সম্ভবত: এটাই প্রধান কারণ।

সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকান্ডের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ করার পর এর নিন্দা জানাতে সিসির প্রতি আহবান জানিয়েছিল সৌদি আরব। কিন্তু সিসি তা করেননি। এতে সিসির প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন সৌদি যুবরাজ বিন সালমান।

এ ঘটনা থেকে ধারণা করা হচ্ছে , এখন থেকে জেনারেল সিসি মিসরের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করবেন, সৌদি ও আমিরাতের স্বার্থে নয়। এতে করে মিসরের সাথে সৌদি আরব ও আমিরাতের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, অন্যদিকে সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে পারে তুরস্কের সাথে। এতে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতেও আসবে বড় ধরনের পরিবর্তন।