তুরস্ক রাশিয়ার সহযোগিতায় প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর মারসিনে আক্কুয়ু নামে পরিচিত এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ১০ মার্চ তুরস্ক ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা পরমাণু কেন্দ্রের তৃতীয় চুল্লিটি স্থাপন করেন।
তুরস্কের এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দুই দেশের মধ্যে ২০১০ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির ৮ বছর পর ২০১৮ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রথম চুল্লিটি চালু করা সম্ভব হবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন। অন্য ইউনিটগুলো ২০২৬ সালের মধ্যে চালু করা সম্ভব হতে পারে। নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে তুরস্ক পারমাণবিক জ¦ালানি উৎপাদনকারী দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নেবে।
পারমাণবিক জ¦ালানি উৎপাদনে আক্কুয়ু পরমাণু কেন্দ্রটি তুরস্কের প্রথম উদ্যোগ। জাপানের মিৎসুবিসি কোম্পানীর সাথে দ্বিতীয় পরমাণু স্থাপনাটির কাজ কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী প্রদেশ সিনোপ এ করার আলোচনা চুড়ান্ত করেছিল তুরস্ক। কিন্তু ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এখন তুরস্ক যদি নতুন কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে পারে তাহলে চলতি বছরই এটির কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চার চুল্লি বিশিষ্ট তৃতীয় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনাও করছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ¦ালানি কর্মকর্তা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য নয়, বরং দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্যই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
আক্কুয়ু পরমাণু স্থাপনাটির মূল মালিকানা রাশিয়ার রোসাটম জ¦ালানি কোম্পানীর। আর তুরস্কের আক্কুয়ু কোম্পানী হচ্ছে স্থানীয় লাইসেন্সধারী ও পরিচালনাকারি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৩৫ বিলিয়ন কিলোওয়াট ঘন্টা বা কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই পরিমান হবে তুরস্কের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রায় ৫০ বছর সেবা প্রদান করবে।
পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় চুল্লি স্থাপন উপলক্ষে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই পরমাণু স্থাপনাটিকে ‘তুরস্ক-রাশিয়া সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন মস্কো থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এই প্রকল্পকে ‘দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বূর্ণ উদ্যোগ’ বলে অভিহিত করেন।
সিনোপ প্রদেশে ৪৫০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে তুরস্ক ও জাপান সরকারের মধ্যে ২০১৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর মিৎসুবিসি হেভি ইন্ডাষ্ট্রির এর নেতৃত্বে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। কিন্তু গত বছরের মার্চে মিৎসুবিসি কোম্পানী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ থেকে সরে যায়। এরমধ্যে রাশিয়ার সাথে পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রটির বড় ধরনের অগ্রগতি হলো
আক্কুয়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে তুরস্কের পরমাণু জ¦ালানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এর মাধ্যমে জ¦ালানি সরবরাহের জন্য বিদেশি সরবরাহকারিদের উপর তুরস্কের নির্ভরতা কমে আসবে। এছাড়া এসব প্রকল্প কেবল জ¦ালানির চাহিদা পূরণের জন্যই ব্যবহার করা হবে, তুরস্কের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ননপ্রোলিফারেশন পলিসি এডুকেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক হেনরি ডি সকোলস্কি বলেছেন, আক্কুয়ু পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী এই প্রকল্পে সব অর্থই সরবরাহ করবে রাশিয়া। এর ফলে রাশিয়ার উপর তুরস্কের নির্ভরতা আরো বাড়বে। তিনি বলেন এটি একটি বড় বিনিয়োগের প্রকল্প। আরো কম খরচে অন্য বিনিয়োগকারির মাধ্যমে প্রকল্পটি করার সুযোগ থাকলেও তুরস্ক সেটি গ্রহন না করে কেন শুধু রাশিয়ার উপরই নির্ভর করছে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।
মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কই একমাত্র দেশ নয় যারা পরমাণু জ¦ালানি উৎপাদনে আগ্রহী। সৌদি আরব, জর্ডান, মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ইসরাইলের কাছে অনেকগুলো পরমাণু অস্ত্রের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইরানও পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ইসরাইল ও অন্য কিছু দেশ অভিযোগ করে আসছে।
আঞ্চলিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে তুরস্ককে। হেনরি ডি সকোলস্কি মনে করেন, তুরস্কের প্রতিবেশিরা খুবই বিপজ্জনক। সেখানে লোকজন লড়াই করছে। এ কারণে তুরস্কের পরমাণু কেন্দ্রও হামলার টার্গেট হতে পারে।
মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালিয়ে তুরস্কের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লির সাথে সংযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হতে পারে যে কোন সময়। ধ্বংস করে দেয়া হতে পারে এর জেনারেটরগুলো ও পরমাণু নিয়ন্ত্রণ কক্ষসহ অন্য সব যন্ত্রাংশ ও স্থাপনা। এ ধরণের হামলা তুরস্কের লোকজনকে উদ্বিগ্ন করে তুলবে। কেননা এতে পরমাণু তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে যা চেরনোবিল বা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
তুরস্ক সরকার দেশটির কুর্দি বিদ্রোহীদের সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পিকেকে কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তার পরও তুরস্কে পিকেকে’র হামলা বন্ধ হয়নি। অব্যাহতভাবে তারা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকের এই সংঘাতে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, উত্তর ইরাকে পিকেকে’র ঘাটি রয়েছে। তারা সেখানে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে ড্রোন বানাচ্ছে বলে খবর এসেছে। এই ড্রোন দিয়ে তুরস্কের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে।
সিরিয়া এবং পূর্ব ভূমধ্য সাগরেও বিরোধে জড়িয়েছে তুরস্ক। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা যেমন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন স্থাপনায় ক্ষেপনাত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, ঠিক তেমনি ভাবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সমর্থক সিরিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেস ও অন্যান্য সংগঠন তুরস্কের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে বলে হেনরি ডি সকোলস্কি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
২০ বিলিয়ন ডলার নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে আক্কুয়ু পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। এতো বিশাল ব্যয়ের একটি প্রকল্প কতটুকু সম্ভাবনাময় হবে তুরস্কের জন্য তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। রয়েছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠাও।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই এ নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেননা এই এলাকাটি ভূমকম্প প্রবন। এছাড়া কিছু সমালোচক পরিবেশ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আবার কিছু বিশ্লেষক প্রকল্পটি সমথর্নও করছেন। ইস্তাম্বুল ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস এন্ড ফরেন পলিস ষ্টাডিজ এর পরিচালক সিনান উলজেন মনে করেন, পরমাণু দুর্ঘটনার ঝুকি সব সময়ই থাকে। কখন কোথায় দুর্ঘটনা ঘটবে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেনা। যেটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদেরকে সব সময়ই উত্তম ও সফল উদাহরণের দিকে তাকাতে হবে।
তুরস্কে যেটা নির্মাণ করা হচ্ছে সেটা নতুন প্রজন্মের এবং খুবই উচ্চ প্রযুক্তির। সিনান উলজেন বলেন, আক্কুয়ু পরমাণু কেন্দ্রটির ঝুকি কতটুকু আছে তা নিয়ে অনেক গবেষণা করা হয়েছে। ড্রোন হামলা চালিয়ে এই স্থাপনার কোন ক্ষতি করা যাবেনা। এছাড়া রোসাটম হচ্ছে রাশিয়ার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা নিশ্চয়ই এব্যাপারে সচেতন রয়েছে।
যদিও তুরস্ক বার বার বলে আসছে যে, কেবলমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই এই পরমাণু কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে, কিন্তু অনেকে মনে করেন, তুরস্ক এই কেন্দ্রে ইউরনিয়াম সমৃদ্ধ করবে। এই সন্দেহের কারণ হচ্ছে তুরস্ক ও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘদিনের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক সম্প্রতি আরো জোরদার হয়েছে।
পাকিস্তান তুরস্ককে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে গোপনে সহযোগিতা দিচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। অন্যদিকে এ বছরের শুরুতে কাজাখস্তানের সাথেও তুরস্কের সামরিক সহযোগিতার চুক্তি হয়েছে। কাজাখস্তান বিশে^র ইউরেনিয়ামের মোট চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে।
সম্প্রতি ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার এক বৈঠকে পাকিস্তানের সাথে সামরিক সহযোগিতার চুক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তুরস্কের একজন উর্ধতন জ¦ালানি কর্মকর্তা বলেন, আইএইএ’র নিয়মের মধ্যে থেকেই শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য বিশেষ করে রেডিয়েশন প্রযুক্তি ও ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য পরমাণু বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হবে।
তিনি জানান, তুরস্ক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি, ব্যাপক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি, রাসায়কি অস্ত্র সনদ ও জীবানু অস্ত্র সনদে স্বাক্ষরকাাির একটি দেশ। এছাড়া ব্যালেষ্টিক মিসাইল বিস্তার রোধ চুক্তিতেও তুরস্ক স্বাক্ষর করেছে। কাজেই তুরস্ক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবেনা বলে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন তুরস্কের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আকাক্সক্ষা আছে। তুরস্ক সে পথে এগিয়ে যাচ্ছে।