বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় তুর্কি টিভি সিরিজ ‘দিরিলিস : আরতুগ্রুল’ দেখে ইসলাম গ্রহণ করেছেন ৬০ বছর বয়সী এক মার্কিন নারী। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ছোট্ট একটি শহরে বসবাসরত এই নারী ৬ সন্তানের জননী। তিনি তার আসল নাম ও কোন শহরে বসবাস করেন, তা প্রকাশ করতে চাননি। তিনি আগে ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টান ছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তিনি খাদিজা নাম ধারণ করেছেন।
ধর্মান্তরিত এই নারী বলেন, আরতুগ্রুল টিভি সিরিজে একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে ইসলামের যে শিক্ষার কথা তুলে ধরা হয়েছে, তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তুরস্কের সরকারি টিভি চ্যানেল টি আর টি ওয়ার্ল্ড ছাড়াও নেটফ্লিক্সে ‘দিরিলিস : আরতুগ্রুল’ সিরিজটি প্রচারিত হয়।
বর্তমান তুরস্ক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আনাতোলিয়া নামে পরিচিত ছিল। ওই সময়ের একটি মুসলিম ওগাজ তুর্কি গোত্রের টিকে থাকার লড়াই সিরিজের মূল উপজীব্য। কায়ী নামে পরিচিত এই গোত্রের লোক সংখ্যা ছিল মাত্র ২০০০। গোত্রটি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে খ্রিষ্টান বাইজেনটাইন, আগ্রাসনকারি মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এ জন্য তাদেরকে অনেক নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। তাদেরই টিকে থাকার লড়াই-সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে এই টিভি সিরিজে।
এতে ঐ সময়ে তুর্কিদের জীবনধারা ও অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানিয়া খেলাফত পূর্ববর্তী তুরস্কের ইতিহাস অত্যন্ত প্রানবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সিরিজের উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র হলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুফি সাধক ও দার্শনিক ইবনে আরাবী। তিনি সিরিজের প্রধান চরিত্র আরতুগ্রুল গাজীর আদর্শিক গুরু। তার শিক্ষাই আরতুগ্রুলের জীবনকে গঠন করেছে এবং জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইবনে আরাবী টিভি সিরিজে যে সংলাপ গুলো বলেছেন, সেগুলোর মাধ্যমে ইসলামের মহান শিক্ষাকে অত্যন্ত চমৎকার ভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ইবনে আরাবীর বলা কথা বা সংলাপগুলো মার্কিন ঐ নারীকে এতোটাই অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছে যে তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেন।
খাদিজা তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে বলেন, ইতিহাসের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ থেকেই তিনি সিরিজটি দেখা শুরু করেন। এবং এর প্রথম দিন থেকেই এটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি ‘উত্তেজিত’ হয়ে পড়েন। কেননা যে ইতিহাস সিরিজে তুলে ধরা হচ্ছিল সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সিরিজের একটি চরিত্র ইসলামের যে আদর্শের কথা তুলে ধরেন তাতে তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন।
ইসলামের প্রতিটি দিক সম্পর্কে এই নারী ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে তার কোনো পরিচয় ছিলো না। এতে আল্লাহ, ইসলাম, শান্তি, ন্যায় বিচার এবং নির্যাতিতদের সহায়তা করার ব্যাপারে যেসব কথা বলা হচ্ছিল সে সম্পর্কে তার কোন ধারনাই ছিলনা।
খাদিজা বলেন, তিনি দ্রুতই এই সিরিজের একজন ভক্ত হয়ে যান। কিন্তু সিরিজের সব চরিত্রকে ছাপিয়ে তার কাছে মূখ্য হয়ে উঠেন ইবনে আরাবী। আন্দালুসিয়ান এই পন্ডিত ও সুফি সাধকের ইসলামের আলোকে জ্ঞানগর্ভ কথা সব দর্শককেই অনুপ্রাণিত করেছে। এই সিরিজের দর্শকদের চিন্তার দরোজা খুলে দিয়েছে। খাদিজার ভাষায়, এই সিরিজটি আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
তিনি বলেন ‘ইবনে আরাবীর কথা বা সংলাপগুলো শুনে অনেক সময় আমার কান্না চলে আসত। তিনি ছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র। আমি সিরিজটির মধ্যে একেবারে ডুবে যাই এবং সবগুলো পর্ব চারবার করে দেখেছি। আমি প্রায়ই খেলা ভুলে যেতাম এবং অনলাইনে নজর রাখতাম সিরিজের চরিত্রগুলো সম্পর্কে কে কি বলছে তা জানার চেষ্টা করতাম। আমি ইসলাম ও অটোমান সাম্রাজ্য সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম।
সিরিজের চরিত্রগুলোর মধ্যে যে নৈতিক মূল্যবোধ দেখানো হয়েছে সেটা তার হৃদয় জয় করেছে। তিনি মনে করেন পুরো সিরিজটি দেখা ছিল তার জন্য একটি সংকেত। তিনি বলেন, আমি যে ধর্ম পালন করতাম সে সম্পর্কে আমার মনের মধ্যে যে সব প্রশ্ন জাগতো সে সবের উত্তর আমি সিরিজটি দেখার পর পেয়ে গেলাম। সব কিছুই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো।
খাদিজা বলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এ সম্পর্কে আরো জানার জন্য আমি পড়াশোনা শুরু করলাম। পবিত্র আল কোরানের একটি ইংরেজী অনুবাদের কপি সংগ্রহ করে আমি পড়তে থাকলাম। এরপর আমি আমি স্থানীয় একটি মসজিদে গেলাম। সেখানে থাকা লোকজন আমাকে দেখে বিস্মিত হলো। কিন্তু সেখানে ‘সহৃদয়’ মুসলমানদের মঙ্গে আমার দেখা হলো। কিভাবে নামাজ পড়তে হয় তা তাদের কাছ থেকে আমি শিখে নিলাম। এর পর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এই বাক্য পড়ে আমি মুসলিম হয়ে গেলাম। কিন্তু এজন্য তাকে কম ত্যাগ ম্বীকার করতে হয়নি।
খাদিজা এখন তার মাথা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখেন। তিনি বলেন, তার ছোট সন্তান একদিন তাকে বলেছে যে, তুমি তো মুসলমান হয়ে গেছো। তবে অন্য সন্তানেরা তার নতুন ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন করেনি।
নিজের বন্ধুদের সম্পর্কে খাদিজা বলেন, তারা মনে করে আমার ‘ব্রেইনওয়াশ’ করা হয়েছে। আমি ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তারা আর আমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিয়েছে। আমিও তাদেরকে কোন কিছু বুঝাতে যাইনা। আমি তো তাদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কখনো কিছু বলিনা। কাজেই তাদেরও উচিত নয় আমার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কোন কিছু বলা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো।
এখন খাদিজার পরিকল্পনা হচ্ছে তুরস্ক সফর করা। সেখানে কোন কোন স্থানে ‘দিরিলিস : আরতুগ্রুল’ সিরিজের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে সেসব স্থান তিনি দেখতে চান। এছাড়া সিরিজে যেসব যেসব চরিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে তারা কোথায় বসবাস করতেন, কোথায় তাদের কবর দেয়া হয়েছে সেসব স্থানেও তিনি যেতে চান।
খাদিজা বলেন, ‘এমনকি আমি তুরস্কে চলে যাওয়ার কথাও ভাবছি। যদি করোনা মহামারি শেষ হয়ে যায় তাহলে আগামী জুন মাসেই আমি তুরস্ক সফরের পরিকল্পনা করছি। তুরস্ক সফরের কথা ভাবতেই আমার চোখে পানি চলে আসে। খাদিজা বলেন, তিনি আরতুগ্রুলের কবর জিয়ারত করতে আগ্রহী যার সন্তান অটোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেছিলেন।
খাদিজার জীবনের এই পরিবর্তন তিনি অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করেন। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই আরো একটি দিন আমাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়ার জন্য। এই জীবনটা যে কতো সংক্ষিপ্ত তা তো মানুষ জানেনা। সবার প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে একটাই, ভুল জিনিস নিয়ে পড়ে থেকে তাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। তুমি কি খাচ্ছ , তুমি কি পরিধান করছ, তোমার কেমন গাড়ী আছে সেটাই তো জীবন নয়।একটি টেলিভিশন সিরিজ খাদিজার জীবনের দর্শন বদলে দিয়েছে।