পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি রাজনীতিকের উত্থান


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১২ মার্চ ২০২১, ১৪:০৮

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঝড়ো গতিতে আগমন ঘটেছে আব্বাস সিদ্দিকীর। এবারের ভোটে তিনি ‘কিং মেকার’ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বামপন্থী সিপিএমআই ও বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোটগতভাবে ভোটযুদ্ধে লড়াই করছে তার নতুন দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। এ রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আব্বাসের আছে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা। সংখ্যালঘু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মধ্যেও তিনি বেশ জনপ্রিয় বলে মনে করা হচ্ছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেড ময়দানে ছিল বামপন্থী ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক সমাবেশ। সেখান উপস্থিত ছিলেন আব্বাস সিদ্দিকী। ভারতের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ওই সমাবেশের সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তরুণ এই ইসলামি রাজনীতিক।

শুধু এই সমাবেশই নয়, গত চার বছরে তার জনপ্রিয়তা রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সমানে টেক্কা দিচ্ছে। তার যে কোনো সভায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে ছাড়িয়ে যায়। তাকে নিয়ে এখন আলোচনা সর্বত্র। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বহুল আলোচিত নাম পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। শুধু মুসলিম সমাজ নয়, আদিবাসী, দলিত, হিন্দু সকল স্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষকে এককাট্টা করে লড়াইয়ের কথা বলেন তিনি।

এককালের শক্তিশালী বামপন্থী ও কংগ্রেসের এ রাজ্যে ‘টিকে থাকার’ লড়াই এবারের বিধানসভা নির্বাচন। বিগত নির্বাচনগুলিতে এ রাজ্যে মুখথুবড়ে পড়েছে এই দুই শিবির। আব্বাস সিদ্দিকী সেই শিবিরে নয়া অক্সিজেন। রাজনীতিতে নবাগত হয়েও এবারের নির্বাচনের আগে বাম-কংগ্রেসের ব্রিগডে তিনিই হলেন ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’।

জোটের ব্রিগেড ময়দান থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে তীব্র আক্রমণ করেন আব্বাস সিদ্দিকী। তার কথায়, ‘মমতাকে জিরো করে দেখিয়ে দেব।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য চলাকালে ব্রিগেড ময়দানে প্রবেশ করেন আব্বাস সিদ্দিকী। সমর্থকদের উল্লাশের জেরে মাঝেমধ্যে বক্তব্য থামাতে হয় প্রদেশ কংগ্রেস নেতাকে। এ শুরু থেকেই ঝাঁঝালো বক্তৃতা রাখেন আব্বাস সিদ্দিকি। বাম নেতা মোহম্মদ সেলিম ও বিমান বসুকে 'ভালোবাসার মানুষ' বলে সম্বোধন করে বামদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘আমরা যা আসন দাবি করেছিলাম, তার অধিকাংশই মেনে নিয়েছেন তারা। তাই যেখানে যেখানে বামেরা প্রার্থী দেবেন, কথা দিচ্ছি বুকের রক্ত দিয়ে তাদের জেতাব।’

সবার কাছে ‘ভাইজান’ হিসেবে পরিচিত আব্বাস সিদ্দিকী হুগলি জেলার ফুরফুরা শরীফের আলেম। তিনি ফুরফুরা শরীফ দরবার পরিবারের একজন সদস্য। পীরবংশের সন্তান। ফুরফুরা শরীফের প্রথম পীর আবু বকর সিদ্দিকী পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি হলেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। ফুরফুরা শরীফের ছোট হুযুর পীর জুলফিকার আলির নাতি। আব্বাস সিদ্দিকীর বাবার নাম পীরজাদা আলি আকবর সিদ্দিকী। ফুরফুরা শরীফের আর এক আলোচিত নাম পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকীর ভাতিজা আব্বাস।

ভারতের ™ি^তীয় বৃহত্তম মুসলিম তীর্থভূমি’ ফুরফুরা শরীফের পীরজাদাদের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকীর জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে বলে মনে করা হচ্ছে। তার সমর্থকদের দাবি সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ রয়েছে। ছোটো থেকেই অন্যের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত করতেন। জাত ধর্ম বিচার না করে বন্ধুদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি।

আব্বাস সিদ্দিকীর ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে এম.এ পাস করেছেন। পড়াশোনা শেষ করেই ধর্মীয় সভা বা ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন আব্বাস। সেই সভা থেকে যুব সমাজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন তিনি। এভাবে অল্প বয়সেই তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ে।

ওয়াজ মাহফিলে তিনি রাজনৈতিক খোঁজখবর ও ব্যাখ্যার কথাও বলতে থাকেন। একইসঙ্গে কীভাবে গরীবরা বঞ্চিত হচ্ছেন সেই কথাও তুলে ধরেন তিনি।

২০১৬ সালে ফুরফুরা শরিফ আহলে সুন্নাতুল জামাত নামে এক অরাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। ২০১৯ সালে ফুরফুরা ‘নলেজ সিটি’-রও ভিত্তি স্থাপন করেন তিনি। ২০১৯ সালেই বিতর্কিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা সিএএ নিয়ে যখন দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয় তখনই এর বিরোধিতা শোনা যায় সিদ্দিকির গলায়। তখন থেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে রাজনীতিতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন এই ধর্মীয় নেতা।

এবারের বিধানসভা ভোট যতই এগিয়ে আসতে থাকে ধীরে ধীরে রাজনীতি নিয়ে নিজের বক্তব্যে তেজ বাড়াতে থাকেন আব্বাস সিদ্দিকী। রাজ্যের ও কেন্দ্রের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সমালোচনায় সরব হন তিনি। গত ২১ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ নামে আত্ন প্রকাশ করে। রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে যান ‘ভাইজান’। এবারের ভোটে তার দলই ফ্যাক্টর হতে চলেছে বলে ঘোষণা করেন তিনি।

ফুরফুরার সিদ্দিকী পরিবারে আব্বাসই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি আলেম পরিচয় সঙ্গে নিয়েই পা রেখেছেন রাজনীতির আঙিনায়। ইসলামি নেতা হলেও আব্বাস সিদ্দিকী ঘোষণা করেছেন দলিত, তফশিলিসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নই হবে তা রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য। তার দলের সভাপতি হলেন আদিবাসী নেতা সিমল সরেন।

এবারের নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করছেন আব্বাস সিদ্দিকী। কয়েকটি ছোট ছোট আঞ্চলিক দলও তার সঙ্গে রয়েছে। রাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপিকে পরাস্ত করাই তার প্রথম লক্ষ্য। মমতার আমলেও রাজ্যের অবহেলিত মুসলিমদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

বামপন্থীরা আব্বাস সিদ্দিকীর দলকে ৩০ আসন এবং কংগ্রেস তাকে ৭ আসন ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচনে অন্তত ৩৭ আসনে লড়বেন তার প্রার্থীরা। আব্বাস সিদ্দিকীর চাওয়াও ছিল ৪০টি মত আসন।

আব্বাস সিদ্দিকীর প্রার্থী তালিকাতেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ রয়েছে। বামপন্থিরাও বলেছেন, আব্বাস সিদ্দিকীর দল আইএসএফ ‘সাম্প্রদায়িক’ নয়।

সব ধর্মের মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করলেও আব্বাস সিদ্দিকীকেও সাম্প্রদায়িক এবং বিজেপির হাতের পুতুল বলে সমালোচনা করছে রাজ্যের প্রগতিশীল দাবিদার একটি অংশ। অথচ চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে তারা পারত পক্ষে মুখ খোলেন না। পশ্চিমবঙ্গে কখনোই বিজেপি ক্ষমতায় ছিল না। ছিল সেক্যুলার ও বামপন্থীরা। কিন্তু মুসলিমদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আব্বাস সিদ্দিকী ধর্মনিরপেক্ষ নয় বলে তোপ দেগেছে বিজেপি-তৃণমূল। তবে তার মন্তব্য, তিনি রাজনীতি করতে এসেছেন সকলের জন্য। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের সেবার উদ্দেশে। তাদের হাতে অধিকার, চাকরি, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা তুলে দিতে। তার কথায়, ধর্মনিরপেক্ষ বলতে আমি বুঝি, আমি আমার ধর্মকে মানব, অপরের ধর্মকে ঘৃণা করব না।

আব্বাস সিদ্দিকী বলেছেন, তিনি কোনও একটি বিশেষ ধর্মের জন্য রাজনীতি করেন না। রাজ্যের গরিব ব্রাহ্মণ, বিভিন্ন ধর্মের দরিদ্র ধর্মগুরুরাও আছেন তার সঙ্গে। তাদর সবার জন্যই তিনি রাজনীতি করছেন।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান এবং বীরভূমের মতো বেশ কয়েকটি জেলার যথেষ্ট জনপ্রিয় আব্বাস সিদ্দিকী। এসব জেলার পাশাপাশি মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপর ও নদীয়াতেও বিপুল সংখ্যক মুসলিমের বাস। পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগ মুসলিম। বিধানসভার ২৯৪ আসনের মধ্যে অন্তত ১০২টিতে জয় পরাজয়ের নির্ধারক মুসলিমরা।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হবে ২৭ মার্চ। করোনা মহামারির কারণে এবার আট দফায় ভোটগ্রহণ করা হবে। আগামী ২৯ এপ্রিল ভোটগ্রহণ শেষ হবে এবং ফল প্রকাশ করা হবে আগামী ২ মে।

ভারতের আরো কয়েকটি রাজ্যের মত এ রাজ্যের মুসলিমরাও রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এ নির্বাচনে আব্বাস সিদ্দিকী সাফল্য পেলে তার প্রভাব হতে পারে সুদুরপ্রসারী। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন শক্তি হিসেবে উঠে আসা আইএসএফ ও তার প্রতিষ্ঠাতা সকলের প্রিয় ‘ভাইজান’ কতটা সাফল্য পান, তার উত্তর মিলবে ২ মে।