যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে অঞ্চলটি কয়েক দশক ধরে যুদ্ধ ও সংঘাতে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে। এখন ওই অঞ্চল ছাড়তে চায় ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে এখন স্থান পাচ্ছে উদীয়মান চীন এবং রাশিয়া।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার ক্ষমতায় বসার এক মাস না পেরুতেই বিষয়টি সবার নজরে পড়েছে। এ নিয়ে এখন আর লুকোচুরির কিছু নেই। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরাইল। কিন্তু নজির ভেঙে বাইডেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন ক্ষমতার বসার তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পর।
তিনি ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। সাত দশকের ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে সৌদি আরবের ডিফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের খুনে চরিত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ফাঁস করে দিয়েছেন। ক্ষমতায় বসার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন।
বাইডেনের একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং সাবেক ঊর্ধতন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা পলিটিকো গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাইডেনের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অঞ্চলগুলোর তালিকা লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন যে মধ্যপ্রাচ্য এখন আর শীর্ষ তিনের মধ্যেও নেই। প্রথমে আছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল বা চীন, এরপরে ইউরোপ এবং এরপর পশ্চিম গোলার্ধ। বৃহৎ শক্তি চীন ও রাশিয়ার উত্থানে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে বাইডেনের এ অবস্থানে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলই খুশি।
বাইডেনের আরেকজন উপদেষ্টা বলেন, ইচ্ছে করেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে আর জড়ানো হচ্ছে না। বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের বদলে অন্যান্য বৈশি^ক ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিতে চান। বাইডেনের আগের শাসকরাও এ চেষ্টা করেছিলেন, তবে সফল হতে পারেননি। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক নির্ধারকরা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে অপ্রয়োজনীয় রকমের মাথা ঘামায়। বাইডেনের জন্যও একথা সত্য।
বাইডেনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সর্ম্পক অম্লমধুর। তিনি ১৯৯১ সালে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। তবে সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির প্রভাবশালী চেয়ারম্যান পদে থাকার সময় তিনি ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসনের পক্ষে প্রস্তাব পাসে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। পরে অবশ্য তিনি সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য প্রচারকালে বাইডেন ইরাককে ভেঙে শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের জন্য তিনটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ার করে দেন যে এ প্রস্তাব কার্যকর হলে রক্তপাত আরও বাড়বে। এখন এ ধরনের জটিল পরিস্থিতি তাকেই সামলাতে হবে।
ট্রাম্পের চুক্তি অনুসারে তিনি আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবেন কিনা তা স্পষ্ট করেননি। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে মার্কিন সৈন্যরা সেখানে থেকে যাচ্ছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি আফগানিস্তানে সেনা বাড়ানোর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পেন্টাগন এখন বলছে, সেখান থেকে রাতারাতি সেনা সরিয়ে নিলে শূন্যতা তৈরি হতে পারে। আফগানিস্তানে বর্তমানে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়ড অস্টিন সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সেনা কমানোর সম্ভাবনা কম। প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনিও মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে চান না। সম্প্রতি তিনি তিনজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনই চীনা বিশেষজ্ঞ। শুধু পেন্টাগনের নিয়োগেই মধ্যপ্রাচ্য অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ যায়নি, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে নিয়োগেও একই ব্যাপার ঘটেছে। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ কমেছে।
বাইডেন যে মধ্যপ্রাচ্যকে কম গুরুত্ব দিতে চান সেটার প্রমাণ মিলেছে ইসরাইলকে অগ্রাধিকার তালিকার একদম পেছনে রাখার মাধ্যমে। নেতানিয়াহুকে তিনি ফোন করেছেন ক্ষমতায় বসার ২৪ দিন পর। সৌদি বাদশাহ ও ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন আরও পরে। মিশর, তুরস্ক, আমিরাত, কাতার ও অন্যদের ব্যাপারেও হোয়াইট হাউসের কোনো তাড়া নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি সময়, মনযোগ ও সম্পদ বিনিয়োগ করায় চীন ও রাশিয়ার উত্থানের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেনি। এখন সময় এসেছে ভুল শোধরানোর। তবে একথাও সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে পুরোপুরি বিদায় নিতে পারবে না। কোনো বড় ধরনের সংকট দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাবেই।
মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেটের সীমাবদ্ধতাও একটি বড় কারণ। আমেরিকার পরমাণু অস্ত্রেও সম্ভারকে আধুনিক করার জন্য দরকার শত শত কোটি ডলার। এ পরিস্থিতিতে চীনের উত্থান রুখতে মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ দিতেই হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আল কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের মত জঙ্গিগোষ্ঠীকে এক নাম্বার শত্রুু বলে বিবেচনা করে না। তাদেও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে চীনকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোকেও গুরুত্ব দিতে চান বাইডেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই দুটো মিত্রকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে স্থায়ী ঘাঁটিতে সেনা রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন দেশে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে। এতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুকি কমবে বলে সেনা কমান্ডাররা আশা করছেন।
সম্প্রতি ভিয়েতনামের বন্দর পরিদর্শন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী। চীন ও ভিয়েতনাম দুটোই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হলেও সমুদ্র সীমা নিয়ে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ রয়েছে। যুদ্ধেও জড়িয়েছে দুই দেশ। চীনকে সামাল দিতে মার্কিন সেনা কমান্ডাররা এখন ছোট ছোট দলে সেনাদেরকে ভাগ করে এসব দেশে মোতায়েন করতে চান।
বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার আগ থেকেই পেন্টাগন এসব নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। গত ডিসেম্বরেই মার্কিন সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক মিলি সেনা মোতায়েন নিয়ে সনাতনী চিন্তা পরিহার করে নতুন করে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হলে চীনকে মোকাবিলা করতে হবে। কৃত্রিম গোয়েন্দা ও রোবটের মত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর ভবিষ্যত রূপরেখা তুলে ধরে সেনা প্রধান মার্ক মিলি বলেছিলেন, ‘ ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রই হবে উত্তম। ক্ষুদ্র একটি বাহিনী হবে প্রায় অদৃশ্য । প্রতিপক্ষ তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হবে। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুওে বেড়াবে। এ ধরনের বাহিনীই টিকে থাকতে সক্ষম হবে।
এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েন নিয়ে প্রায় একই কথা বলেছেন নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়ড অস্টিন। তার ভাষায় : ইন্দো -প্যাসিফিকে চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের দরকার সহিষ্ণুতা ও বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েন । সেনা অভিযান নিয়েও নতুন ধারণা দরকার। উত্তর মেরু বা আর্কটিকে রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন অস্টিন।
তিনি বলেন, আর্কটিক অঞ্চলটি ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং আগ্রাসী আচরণ নিয়ে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন। অনুরূপভাবে এ অঞ্চলে চীনের অভিপ্রায় নিয়েও তার যথেষ্ট উদ্বেগ আছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিলেও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে তার বিশাল বিশাল সামরিক ঘাটি পরিত্যাগ করছে না। অবশ্য তার এখনকার কৌশল ঘূর্ণায়মান ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী মোতায়েনের ওপর জোর দেওয়া। সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
মার্কিন সেনাবাহিনী ‘আর্কটিক ক্যাপাবল বিগ্রেড’ নামের একটি বাহিনী তৈরি করছে। কারণ মেরু অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছে বৃহৎ শক্তিগুলো। এখানে বৃহৎ শক্তিগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। সেকথা মাথায় রেখেই মার্কিন বিমানবাহিনী সম্প্রতি প্রথমবারের মত নরওয়েতে বি-ওয়ান নামের দূরপাল্লার বোমারু বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, রাশিয়ার পাশেই অবস্থান নরওয়ের।
চীনও নিজেকে আর্কটিকের দেশ বলে মনে করে থাকে। তাছাড়া এশিয়া ও প্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তা প্রদর্শনে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র যাতে তাইওয়ানে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেজন্য সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, স্বায়ত্বশাসিত পর্বতসঙ্কুল তাইওয়ানে এক সময় পূূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তাইওয়ান নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এতে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। দুটি পরমাণু দেশের মধ্যে যুদ্ধে লাখ লাখ আমেরিকান মারা যেতে পারে।
চীন পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বা কমানোর কোনো চুক্তিতে সই করেনি। বেইজিং তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায় রাশি রাশি টাকা ঢালছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা এখন তাই চীনকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করছে।