ইরানে হামলা নিয়ে ইসরাইলের নানা পরিকল্পনা

মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতম

  • মোতালেব জামালী
  • ০৯ মার্চ ২০২১, ১৭:২৫

ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতম মনে করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে সক্ষম হয় তাহলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করবে। কাজেই নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে। এজন্য দেশটির বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই গোয়েন্দা প্রধান। তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরান ছাড়াও তুরস্ক-ইসরাইল সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ নিয়েও কথা বলেন।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সাথে বাইডেন প্রশাসনের আলোচনার ফলাফল যাই হোক না কেন তেহরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খোলা রাখতেই হবে বলে মত দেন মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতম। সাক্ষাৎকারে ড্যানি ইয়াতম বলেন, ইরান একবার যদি পরমাণু অস্ত্রের অধিকারি হয়ে যায়, তাহলে ইসরাইলকে অবশ্যই তার মাসুল দিতে হবে। ইসরাইলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। কাজেই ইরানকে আমরা কোন ভাবেই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হতে দিতে পারি না।

তার মতে ইরানকে থামিয়ে দিতে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণের পথই খোলা রাখতে হবে ইসরাইলকে। এর মধ্যে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পথটিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এটাকে আলোচনার বাইরে রাখা যাবেনা। তবে তা প্রথম পদক্ষেপ নাও হতে পারে। এটা সর্বশেষ পদক্ষেপও হতে পারে। বিবেচনায় রাখতেই হবে। যদি ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রশ্ন এসেই যায়, তখন যে উপায় অবলম্বন করা প্রয়োজন তার সবই করতে হবে। এরমধ্যে সামরিক ব্যবস্থা একটি।

এর আগে ইসরাইলের বর্তমান সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আভিভ কোচাভিও ইরানে হামলার হুমকি দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি তেল আবিব ভিত্তিক নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ষ্টাডিজ এর বার্ষিক সম্মেলনে ইসরাইলি সেনাপ্রধান বলেন, তার দেশ যদি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তা বাস্তবায়নে সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে সেনাবাহিনী। আগামী বছরের মধ্যেই আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।

এর আগে গত ১১ জানুয়ারি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এর সাথে ওয়াশিংটনে সাক্ষাৎ করেন ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োশি কোহেন। এর পরপরই সিরিয়ায় ইরানের একটি অবস্থানে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। এই হামলায় ৫৭ জন নিহত হন। মার্কিন গোয়েন্দারা এই হামলায় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে। এরপরই ইরানে হামলার এই হুমকি দেন জেনারেল আভিভ কোচাভি।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশে^র ৬টি শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানী ২০১৫ সালে ইরানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুয়ায়ী ইরান একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। যদিও ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে বের করে আনে। এরপর ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইরানের অর্থনীতি বড় ধরণের সংকটে পড়ে। কিন্তু এরপরও ইরান এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারি অন্য দেশগুলো চুক্তির প্রতি অটল রয়েছে। যদিও ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে না গিয়ে ২০১৯ সালে চুক্তির কিছু ধারা লংঘন করেছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরানের ৩দশমিক ৬৭ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কথা। কিন্তু তারা বর্তমানে তা ৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। আগামীতে এই হার ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার ও তাদের সমৃদ্ধ সেন্ট্রিফিউজগুলো পুনরায় সক্রিয় করার পরিকল্পনা করছে ইরান। সম্প্রতি ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ইরান প্রয়োজনে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার মাত্রা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করতে পারে। ইরানের এসব তৎপরতা নিয়েই উত্তেজনা বাড়ছে। বাড়ছে ইসরাইলের হামলার হুমকিও।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর ইরানের সাথে নতুন করে পরমাণু আলোচনা শুরু করার ঘোষণা দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় ইসরাইল। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতম মনে করেন, ইরান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে সমর্থন করবে ইসরাইল। যদিও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে বারাক ওবামার স্বাক্ষর করা চুক্তিতে যেমন ফিরে যাবেনা, তেমনি ভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিকেও গ্রহণ করবেনা। এই দুইয়ের মাঝামাঝি নতুন একটা অবস্থান নেবে যুক্তরাষ্ট্র। এটা হবে একটা নতুন চুক্তি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরুর বিষয়টি নিে অনেক কথা হলেও জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর এখনও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। আলোচনা শুরুর ব্যাপারে কে প্রথম পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হওয়ায় প্রক্রিয়াটি থেমে যায়।

তেহরান বলছে, ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর তিনি ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেন। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাইডেন প্রশাসনকেই আলোচনা শুরুর প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আগে উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর ইরানের পালা আসবে।

বিষয়টি নিয়ে এক মাসের বেশি সময় ধরে অচলাবস্থা চলার পর আলোচনায় বসার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় মিত্রদের মাধ্যমে ইরানের সথে একটা যোগাযোগ স্থাপন করে। এ থেকে বোঝা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে আলোচনায় আগ্রহী।

ইসরাইল ইরানে হামলার যতই হুমকি দিক না কেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার মেয়াদের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে কোন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্ট করতে দেবেন না। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অবনতি হোক তা তিনি চাইবেন না। ফলে ইসরাইলকে তিনি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রাখবেন বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা নির্বাচিত হবার পর থেকেই বলে আসছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে কোন যুদ্ধে জড়াতে চাননা তিনি। যুদ্ধ কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। তাই একথা বিশ^াস করা যায় যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের যুদ্ধবিরোধী শক্ত অবস্থানের কারণে ইসরাইল ইরানে হামলা চালানোর সাহস করবেনা।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তার দেশ কোনভাবেই পিছু হটবেনা। দরকার হলে ইরান বেসামরিক ব্যবহারের প্রয়োজনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার মাত্রা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তর রোধ চুক্তি বা এনপিটির অতিরিক্ত একটি ধারা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা পরিহার করেছে। এর অর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ পরমাণু সংস্থার পরিদর্শকরা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় প্রবেশের অধিকার পাবেন না।

মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতম তুরস্কের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক নিয়ে বলেন, দুই দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তুরস্ক ও ইসরাইলের উচিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উষ্ণ করা এবং তা আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। তিনি আশা করেন তুরস্ক ও ইসরাইল এটা প্রমান করবে যে সময়ের বিবর্তনে তাদের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে, আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এই সর্ম্পকের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিন ইস্যু একটি বড় ফ্যাক্টর।

ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ড্যানি ইয়াতম মনে করেন, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে যদি ফিলিস্তিনি নেতারা ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে পারেন তাহলে দুই রাষ্ট্র সমাধানের একটা পথ খুলে যাবে। তিনি আশা করেন, হামাস ও পিএলও নেতারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেন। গাজা ও পশ্চিম তীরে এই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তখন ইসরাইল গাজা ও পশ্চিম তীরের মানুষের একক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার টেবিলে বসে একটি সমাধানে পৌছতে পারবে। তখন দুই রাষ্ট্র সমাধানের একটা পথ বেরিয়ে আসবে। ইসরাইল দুই রাষ্ট্র সমাধান চায়, তিন রাষ্ট্র সমাধান নয় বলে মন্তব্য করেন ড্যানি ইয়াতম।

ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। র্পালামেন্ট নির্বাচন হবে ২২ মে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে ৩১ জুলাই ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হবে আগামী ৩১ আগষ্ট।

২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণকারি ফাতাহ আন্দোলনের সাথে হামাসের বিরোধ চলছে। কিন্তু গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দুই সংগঠনের নেতারা তুরস্কে বৈঠকে বসে ঐক্যবদ্ধ ভাবে পার্লাামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হন। গত ৩১ ডিসেম্বর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের সম্মতির কথা জানিয়ে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি দেন। ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে ২০০৫ সালে এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে ২০০৬ সালে। প্রায় ১৫ বছর পর এই তিনটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে।