মালয়েশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং গণতন্ত্র চুরির জন্য তিন ব্যক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে। এরা হলেন, বর্তমান অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন, তার সিনিয়র মন্ত্রী আজমিন আলী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ।
আনোয়ার ইব্রাহিম যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন সেজন্য মুহিউদ্দিন ও আজমিন আলী নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। ২০২০ সালের এ ঘটনা মালয়েশিয়ায় শেরাটন মুভ নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে আকস্মিক পদত্যাগ করে আনোয়ারবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের পথ সুগম করে দেন। মাহাথির মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, মাহাথির কখনও আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চাননি।
মুহিউদ্দিন ইয়াসিন এবং আজমিন আলীর শেরাটন মুভ অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়েছে। দেশটি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। মহিউদ্দিন ইয়াসিন মালয়েশিয়ায় বর্তমানে একজন অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তার অনির্বাচিত শাসনের বিরুদ্ধে কেউ যেন চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে সেজন্য তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জনস্বাস্থ্যের অজুহাতে গত এক বছর ধরে জরুরি অবস্থা জারি করে সংসদ স্থগিত রাখা হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির ঘটছে। মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ায় বর্তমানে যে সরকার রয়েছে তাকে অনেক ব্যাকডোর গভমেন্ট বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মালয়েশিয়ায় ২০২০ সালের রাজনৈতিক অভ্যুত্থান বা শেরাটন মুভ এর মূল হোতা ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিন এবং তার সিনিয়র মন্ত্রী আজমিন আলী। তাদের পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার কৌশলের কারনে ২২ মাসের পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। মালয়েশিয়ায় তখন যে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটে এ জন্য অনেকে দায়ী করেন মহাথীর মোহাম্মদকে। আনোয়ার ইব্রাহিম মাহাথির মোহাম্মদকে সরাসরি বিশ্বাস ঘাতক কুচক্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
২০২০ সালের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সাথে মাহাথির মোহাম্মদ কতটা জড়িত ছিলেন তা নিয়ে মালয়েশিয়ায় এখনো বিতর্ক রয়েছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে মাহাথির তার উত্তরসুরী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিমকে দেখতে চাননি। আর আনোয়ার ইব্রাহিমকে ঠেকানোর জন্য তার সরকারের লোকজনের ষড়যন্ত্র তিনি জানতেন না এটাও অনেকে মানতে রাজি নন। তিনি এ ষড়যন্ত্র বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি বরং তার হঠকারী পদত্যাগের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদেরই সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
তবে মজার বিষয় হলো আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় বসতে না দেয়া বিষয়ে যে দুই ব্যক্তি সরকারে থেকে ষড়যন্ত্রের নেতৃত্বে দেন তাদের একজন মহাথীরের ঘণিষ্ঠ এবং আরেকজন আনোয়ার ইব্রাহিমের ঘণিষ্ঠ। এ দুইজন হলেন মুহিউদ্দিন ইয়াসীন ও আজমিন আলী।
আজমিন আলীকে একদিন মহাথীর মোহাম্মদই আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আনোয়ার ইব্রাহিম তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর আজমিন আলী মহাথীরের আমনো দল পরিবর্তন করে আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআর দলে যোগ দেন।
আনোয়ার ইব্রাহিম ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সালে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আজমিন আলীকে তিনি তার প্রাইভেট সেক্রেটারি নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে আজমিন আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআর দলের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আজমান আলী আনোয়ারের পিকেআর দল পরিবর্তন করে আবার মহাথীরের নতুন দল বারসাতুতে যোগ দেন। ফিরে যান মহাথীরের কাছে। মহাথীর তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এরপর আনোয়ার ইব্রাহিম ও আজমান আলীর মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত পর্যায়ে গড়ায়।
অপরদিকে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নাজিব রাজাকের অধীনে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। এরপর মুহিউদ্দিন ইয়াসীন মহাথীরের নতুন দল বারসাতুর প্রেসিডেন্ট হন। এর আগে তিনি আমনোর ডেপুটি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পাকাতান সরকারে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মাহাথির।
পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন সরকার চারটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এর মধ্যে একটি দল বারসাতু। এ দলের চেয়ারম্যান ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। প্রেসিডেন্ট মুহিইদ্দীন ইয়াসিন। আরেকটি দল পিকেআর। এর প্রেসিডেন্ট আনোয়ার ইব্রাহিম। ডেপুটি প্রেসিডেন্ট আজমিন আলী। অপর দুটি দল হলো আমানাহ এবং ড্যাপ। পাকাতান হারাপান জোট ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৬০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জয় লাভ করে।
মাহাথির মোহাম্মদ ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন উমনো এর অধীনে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি দল ত্যাগ করে বারসাতু দল গঠন করেন। মাহাথির মোহাম্মদ আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে জোট গঠনের শর্ত ছিল জয়লাভ করলে প্রথম ২ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন মাহাথির। এরপর ক্ষমতা তুলে দেবেন আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে। শর্ত অনুযায়ী মহাথীর মোহাম্মদের ২ বছর দায়িত্ব পালনের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ২০২০ সালের মে মাসে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের ২ বছর পূর্তির সময় ঘনিয়ে আসায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পাকাতান হারাপান প্রেসিডেনশিয়াল কাউন্সিল বৈঠকে বসে। এই বৈঠকে মাহথীরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নির্ধারনের দাবি তোলা হয় ।
মাহথীরের দলে বারসাতুর বৈঠকের একটি অডিও টেপ ফাঁস হয়। তাতে শোনা যায় বারসাতুর যুব প্রধান সৈয়দ সাদিক এবং পিকেআর এর ডেপুটি প্রেসিডেন্ট আজমান আলী মহাথীরকে সতর্ক করছেন এই বলে যে, যদি তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নির্ধারণ করে দেন তাহলে তিনি একজন খোড়া প্রধানমন্ত্রীতে পরিণত হবেন।
আজমিন আলীর নেতৃত্বে ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেরাটন হোটেলে জড়ো হয় মহাথিরের দল বারসাতু, আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পিকেআরের বিদ্রোহী অনেক এমপি। তারা সেখানে নতুন একটি কোয়ালিশসন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। এ ঘটনা শেরাটন মুভ হিসেবে পরিচিতি পায়।
ওই দিন সন্ধ্যায় আজমিন আলী পিকেআর বিদ্রোহী সদস্যদের নিয়ে দেখা করতে যান মালয়েশিয়ার রাজার সাথে। তার সাথে যোগ দেন বারসাতু প্রেসিডেন্ট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন, আমনো নেতা জাহিদ হামিদি, পাস নেতা হাদি আওয়াং সহ অন্য আরো কয়েকটি দলের নেতৃবৃন্দ। মালয়েশিয়ার রাজার সাথে তাদের এ বৈঠকের উদ্দেশ্য আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রীত্ব প্রতিরোধ করা এবং নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠন করে অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করা।
রাতে আনোয়ার ইব্রাহিম তার বাসায় বসে ঘোষণা দেন তার দলে বিশ্বাস ঘাতকতার ঘটনা ঘটেছে। জবাবে আজমিন আলী জানান, তিনি মহাথীর মোহাম্মদকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি আনোয়ার ইব্রাহিম দেখা করেন মহাথিরের সাথে। নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্পর্কে কিছু জানা নেই বলে জানান মাহাথির। এরপর আনোয়ার ইব্রাহিম তার দলের নেতা আজমিন আলীসহ দলের অন্য বিদ্রোহীদের বরখাস্ত করেন।
ওই দিন বিকালেই মহাথীর মোহাম্মদ পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। একই সাথে তিনি পদত্যাগ করেন বারসাতু দলের চেয়ারম্যান পদ থেকেও। এরপর দলের প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন সরকার থেকে বারসাতু দলের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। অপর দিকে আজমিন আলী আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআর দলের ১১ জন এমপি নিয়ে সমর্থন প্রত্যহার করেন পাকাতান হারাপান সরকার থেকে। ফলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন। এভাবে পতন ঘটে পাকাতান হারাপান সরকারের।
বারসাতু দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য সমর্থন জানানো হয়। এতে সমর্থন যোগায় আজমিন আলীর নেতৃত্বে পিকেআর দলের ১০ জন বিদ্রোহী এমপি। এ ছাড়া আমনো, পাস, মালয়েশিয়ান চাইনিজ কংগ্রেস, মালয়েশিয়ান ইন্ডিয়ান কংগ্রেসসহ আরো বিভিন্ন দল সমর্থন দেয়। এভাবে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন মালয়েশিয়ার অষ্টম প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন।
আজমিন আলী বর্তমানে মুহিউদ্দিন সরকারের শীর্ষ চার মন্ত্রীর একজন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে। আর মূলত তিনিই পালন করছেন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব যদিও মুহিউদ্দিন এ পদ শূণ্য রেখেছেন।
বারসাতু দলের সুপ্রিম কাউন্সিল সদস্য ওয়ান সাইফুল ওয়ান জানিয়েছেন, মাহাথির মোহাম্মদ তার উত্তরসুরী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিমকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাননি আর এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অনড় । যদিও তিনি মালয়েশিয়ানদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ২ বছর পর আনোয়ার ইব্রাহিমের হতে ক্ষমতা তুলে দেবেন।
মহাথীর মোহাম্মদের সাবেক উপদেষ্টা সিনেটর মোহাম্মদ জাহিদ আরিফ বলেন, তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাননি। জাহিদ বলেন, আমি শেরাটন মুভের মাস্টারমাইন্ড ছিলাম না তবে আমি আনোয়ার ইব্রাহিমকে ঠোকনোর যে উদ্যোগ তাতে জড়িত ছিলাম। আর এতে আমার প্রতি আর্শীবাদ ছিল মহাথীর মোহাম্মদের।
ফাঁস হওয়া আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায় মহাথিরের পদত্যাগের পর আনোয়ার ইব্রাহিম যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন সেজন্য মহাথিরের দল বারসাতু যাতে ভূমিকা পালন করে সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেননি তিনি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের আগে তিনি পাকাতান হারাপানের সাথেও কোনো আলোচনা করেননি।
আনোয়ার ইব্রাহিম মাহাথিরকে ষড়যন্ত্রকারী এবং বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পিকেআর এর পক্ষ থেকে দেশের বর্তমান রজনৈতিক সংকটের জন্য মহাথীরকে দায়ী করেছেন। এমনকি আনোয়ার ইব্রাহিম যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারেন সেজন্য এখনো তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে দলটি।