মিয়ানমারে গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্ব মোড়লেরা বর্তমানে মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রেখেছে। কিন্তু এ ইস্যুটির ক্ষেত্রে মিয়ানমারের আস্থাভাজন মিত্র রাষ্ট্র চীন ও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু চীন ও ভারত কেউই এখনো অবধি মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের বিষয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি।
মিয়ানমারের দুই প্রতিবেশী পরাশক্তি চীন ও ভারতের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্বিচার গণহত্যা ও নিপীড়ন শুরু করে। জাতিসংঘের হিসাবেই এ সময় ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ জন্মভূমি রাখাইন ত্যাগ করে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এর ওপর এত বিপুল সংখ্যক ভিনদেশি মানুষ এসে আশ্রয় নেওয়ায় দেশটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এক মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের পরিণতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ বেশ কয়েকবার উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সূচীকে গ্রেফতার করা হয়। সূচীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ২০১৭ সালে রাখাইনে পরিচালিত গণহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। পাশাপাশি, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের আওতায় গড়া ট্রাইবুনালে তৎকালীন গণহত্যার সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা প্রমাণ হওয়ার পরও সূচী তাদের বিচারের জন্য কোনো ধরনের উদ্যেগ নেননি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এসব সামরিক অফিসারকে হস্তান্তর করার জন্য কোনো পদক্ষেপে তিনি সায় দেননি। মানবাধিকার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নেও সূচী কার্যকর কোনো উদ্যেগ নেননি। সবচেয়ে বড়ো কথা, তিন বছর আগে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যেও তিনি কোনো উদ্যেগ নিতে পারেননি।
রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়নকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিকভাবে এ ঘটনাকে গণহত্যা বলেই অভিহিত করা হয়েছে। এর পরপরই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বা তাদমাদাও নতুন করে নজরদারির আওতায় চলে আসে। বৌদ্ধ সন্যাসীরা রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা চালিয়েছিল তাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রমাণিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর দায়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এরই মাঝে অবরোধ আরোপ করেছে।
সেনা অভ্যুত্থানের পর ৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর সূচী এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অবিলম্বে বেসামরিক সকল নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবি করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদ সেই বিবৃতিতে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ স্থান পায়। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যরাষ্ট্র রাখাইন রাজ্যের উদ্ভুত পরিস্থিতির মূল কারন অনুসন্ধানের ওপর জোর দিচ্ছে। অনতিবিলম্বে এমন একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির দাবি করেছেন যাতে রোহিঙ্গারা স্বস্তির সাথে এবং স্বেচ্ছায় নিজ ভূখন্ডে ফিরে যেতে পারে।
চীন ছাড়াও রাশিয়া ও ভারত উভয়ের সাথেই মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। দেশটিতে চীনের বড়ো অংকের বিনিয়োগ রয়েছে। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় মিয়ানমারে চীন এ বিনিয়োগ করছে।
অভ্যুত্থানের পরও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যে স্বস্তিতে আছে তার পেছনে চীন ও ভারতের পৃষ্ঠপোষকতাকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পরপরই এক প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, “চীন মিয়ানমারের বন্ধু প্রতিবেশি রাষ্ট্র। আমরা আশা করি যে, মিয়ানমারের সকল পক্ষই তাদের ভিন্নমতকে সংযত করে সংবিধানকে সম্মুন্নত রাখবেন এবং আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়েই দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। চীনের এ দায়সারা বিবৃতির কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, বেইজিং নেইপিদোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তার ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করতে চায়।
২০১৭ সালে গণহত্যার পর যখন মিয়ানমার ইউরোপ ও আমেরিবার চাপের মুখে পড়ে, তখন চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদেও কোনো নিন্দা প্রস্তাব অনুমোদন করা যায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেস বরাবরই তাতমাদোকে জাতিগত সহিংসতা ও গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করে আসছেন। যদিও মিয়ানমার প্রশাসন সে অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান থেকে বিরত হওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব আনতে চেয়েছিল। কিন্তু চীন ও রাশিয়া তাতেও আপত্তি তোলে। এর বছরখানেক পর রোহিঙ্গা শরনার্থী বিষয়ক যেকোনো আলাপ থেকেও বেইজিং ও মস্কো বেরিয়ে যায়।
রাশিয়া ও চীনের মতো ভারতও মিয়ানমারের সাথে সমান্তরাল সর্ম্পক বজায় রাখে। সেনা অভ্যুত্থানের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এক বিবৃতিতে জানায়, আমরা উদ্বেগের সাথে মিয়ানমার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছি। ভারত সবসময়ই গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের যাত্রাকে সমর্থন করে এসেছে। আমরা আশা করি, আগামীতেও মিয়ানমারে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর লক্ষ্য রাখছি।
ভারতের এ রহস্যজনক আচরণের পেছনেও মূল কারণ হলো, জেনারেল মিন অং হ্লাই দিল্লির সাথে দীর্ঘদিন ধরেই সুসম্পর্ক ধরে রেখেছেন। নরেন্দ্র মোদির সরকার সূচীর বিকল্প হিসেবে তার সাথে আগাগোড়াই বেশ ভালো সম্পর্ক জিইয়ে রেখেছে। বিগত ৬ বছরে ভারতের সাথে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার মাত্রাও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মহল যতই চাপ দিক না কেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের এ দেশটি সহজে রোহিঙ্গাদেরকে আর ফিরিয়ে নিবে না। কক্সবাজারে চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এরই মাঝে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য আবাসন তৈরি করেছে। হাতিয়া উপজেলার ভাষানচর নামের ৪০ বর্গ কিলোমিটারের একটি দ্বীপে এ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি মধ্যম আয়ের দেশ কতদিন এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বহন করতে পারবে, তা একটি বিরাট প্রশ্ন।
অনেকে মনে করেন , মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে রাজিও হয় তাদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৪০ হাজারের বেশি হবে না। যারাও বা ফিরবেন, তাদেরকে হয়তো একটি বন্দি এলাকার মধ্যেই থাকতে হবে, অনেকটা কনসেনট্রেশন শিবিরের মতো। তাদের মৌলিক ও মানবাধিকারের অনেকগুলোই হয়তো আর কখনো পূরণ হবে না। চলাফেরাও সংকুচিত হয়ে যাবে এবং জীবনের বাকিটা সময় তাদেরকে হয়তো দুবির্ষহ ও বিভীষিকাময় কোনো আতংকের মধ্য দিয়েই পার করতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আরেকটি বড়ো কারণ হলো প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে চীন ও ভারতের মধ্যে লড়াই। ভারত মিয়ানমারকে বরাবরই চীনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছে। মিয়ানমারও এসব প্রচারনায় বিশ্বাস রেখেছে। আবার কিছু সমস্যাজনক ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষও মনে করে চীনই মূলত রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামীদেরকে উসকানি দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলেছে।
মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্বের অনেকে মনে করেন, চীন নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি এবং আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি বা আরসাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে। মিয়ানমার প্রশাসন রোহিঙ্গাদের এ দুটি সংস্থাকেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে।
গত বছর, ভারতঘেষা একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন যে, আরাকান আর্মির আর্থিক তৎপরতার ৯৫ শতাংশ অর্থই চীন থেকে আসে। ভারত আরো দাবি করছে যে, চীন এসব সংস্থাকে অস্ত্র দিয়েও সহায়তা করে। চীনের সাহায্য পাওয়ার কারণেই রোহিঙ্গা এ দুটো সংগঠনের কাছে এখন ৫০টি ম্যান পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং সারফেইস টু এয়ার মিসাইলও কার্যকর রয়েছে। রোহিঙ্গা বিরোধী এসব অপ প্রচারের কারণেও মিয়ানমার নীতি নির্ধারকরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আগ্রহ পাচ্ছে না।
গত বছরের জুন মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। তিনি দাবি করেন, এ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো টিকে আছে কারণ বড়ো কোনো এক পরাশক্তি তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি, তবে বিশ্লেষকরা নিশ্চিত যে জেনারেল মিন চীনের কথাই বলেছেন।
সত্য মিথ্যা, প্রচার ও প্রোপাগান্ডাকে ভিত্তি করে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর যে আচরণ ও পরস্পরবিরোধী ভূমিকা, মূলত সে কারণেই রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ও প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া আর সফল হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান এ প্রক্রিয়াকে আরো অনিশ্চিত ও দীর্ঘায়িত করবে- তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।