সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন পথে হাঁটার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেন যুদ্ধে সহযোগিতা বন্ধের পরই জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে কোনো ইস্যুতে যুবরাজ বিন সালমান নয়, সরাসরি বাদশাহর সাথেই সম্পর্ক রক্ষা করতে আগ্রহী। অলিখিত বাদশাহ হয়ে ওঠা যুবরাজের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। প্রশ্ন উঠেছে, এর ফলে এমবিএসের জন্য কি হোয়াউট হাউসের দরজা বন্ধ হয়ে গেল?
বিগত চার বছর সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য হোয়াইট হাউসের দরজা সব সময়ই খোলা ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান না হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দরবারে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই খাতির পেয়েছেন। বিপুল সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান ক্রাউন প্রিন্সই মূলত সৌদি আরবের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিন সালমানকে সেভাবেই মূল্যায়ন করত, জো বাইডেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই ধারায় ছেদ পড়তে যাচ্ছে। যুবরাজকে বাদশাহর মর্যাদা দিতে রাজি নন জো বাইডেন।
সম্প্রতি হোয়াইট হাউস এক ঘোষণায় জানিয়েছে তারা সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ককে পুণর্মূল্যায়ন করতে যাচ্ছে। আর সেটির প্রথম পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে সম্ভবত ক্রাউন প্রিন্সকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবেই মূল্যায়ন করা হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা হিসেবে তাকে বিবেচনা করবে না বাইডেন প্রশাসন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কোনো ইস্যুতে আর তার ডাক পড়বে না হোয়াইট হাউসে।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প যুগে যে খাতিরটা পেতেন এমবিএস সেটিও আর থাকবে না। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তারা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে রাষ্ট্র প্রধানের যোগাযোগেই আগ্রহী, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সব বিষয়ে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সাথেই ডিল করবেন। কূটনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় কাউন্টার পার্ট-টু-কাউন্টার পার্ট।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি অনেকটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সুরেই বলেছেন, প্রেসিডেন্টের কাউন্টার পার্ট হচ্ছে বাদশাহ সালমান এবং আমি আশা করি উপযুক্ত সময়ে তিনি তার সাথে কথা বলবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক থাকলে হয়তো এমবিএস সরাসরি ডিল করতে পারবেন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সাথে। কারণ সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এখন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ট্রাম্প যুগে হোয়াইট হাউসে অতিথির মর্যাদা পাওয়া বিন সালমানের জন্য সেটি বড় অপমানই বলতে হবে।
জো বাইডেন তার নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই যেসব কথা বলে আসছেন তারই ধারাবাহিকতায় সৌদি যুবরাজের বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত। বাইডেন সৌদি আরবসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচনের আগেই বলেছেন, তিনি ট্রাম্পের পথে চলবেন না। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিয়মতান্ত্রিক হবেন।
ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর গত কয়েক বছরে বিন সালমানের একটি মিশ্র ইমেজ তৈরি হয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে। প্রতিবেশী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন জায়েদের সাথে মিলে তিনি এ অঞ্চলের জন্য যে ভিশন ঠিক করেছেন, তাতে উপসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক আধুনিকায়নের পরিকল্পনা থাকলেও গণতন্ত্রায়নের কোনো পরিকল্পনা নেই।
এমবিএস ও তার মিত্ররা চাইছে মধ্যপ্রাচ্যকে শক্তিশালী রাজ শাসনের মধ্যে রেখেই পশ্চিমা ধাচে গড়ে তুলতে। যেখানে একক আধিপত্য থাকবে আরব শেখদের। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় আরবি ভাষাকে এড়িয়ে জায়গা করে দিচ্ছেন ইংরেজীকে। সৌদি সরকারের যে নতুন পরিবেশ বান্ধব মেগাসিটির কাজ শুরু হয়েছে সেটির নাম দেয়া হয়েছে দ্যা লাইন।
এরপরও সৌদি আরবের নাগরিকদের মাঝে ক্রাউন প্রিন্সের জনপ্রিয়তা একেবারেই কম নয়। কারণ দেশটির অনেক সেক্টরে তিনি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। গোড়া সমাজব্যবস্থা থেকে সৌদিদের তুলে আনার তার এই প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপীও প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সাথে সংযোগ তাকে বিশ্বজুড়ে অপরাধী হিসেবেও তুলে ধরেছে। ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেট ভবনে জামাল খাশোগিকে হত্যার পর লাশ গোপন করে সৌদি আততায়ীরা। সিআইএ থেকে জাতিসঙ্ঘ- সবাই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের এমবিএসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আবার বেশ কয়েকজন নারী অধিকার কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে দেশটিতে। পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই নারীদের সব ধরনের কাজের অনুমতি দেয়ার বিষয়ে তাদের অনেকে কথা বলেছিলেন। যেটিও এমবিএসকে পশ্চিমাদের চোখে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এছাড়া সালমান আল আওদাহ, ওমর আল মুকবিলসহ বেশ কয়েকজন ইসলামিক স্কলারের ওপরও ধরপাকড় চালানো হয়েছে, যারা সৌদি সরকারের ইসলামিক মূল্যবোধের বিরোধী কাজের সমালোচনা করেছিলেন।
বিন সালমানের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্তটি ছিল ইয়েমেনে সামরিক অভিযানে। যদিও ইয়েমেন যুদ্ধের প্রধান কারিগর তিনি নন। হুথি বিদ্রোহীরাই দেশটিতে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়, তারা সরকারকে উৎখাত করে রাজধানী সানা দখল করে নেয়। আর হুথিদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে ইরান। স্বাভাবিক ভাবেই সৌদি আরব তার দক্ষিণ সীমান্তে ইরানের মিত্রদের সহ্য করতে চাইবে না। ইরাকের সাথে তাদের উত্তর সীমান্ত এলাকাটিও এখন ইরানি সমর্থনপুষ্টদের নিয়ন্ত্রণে। এসব কারণেই যুবরাজ ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন, যদিও তাতে তিনি সফল হতে পারেননি।
ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে দেশটি পৌছে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতিতে। ২০ মিলিয়ন মানুষ এখন ক্ষুধা আর অপুষ্টির শিকার। তার ওপর হুথি বিদ্রোহীরা ড্রোন ও মিসাইলের সাহায্যে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরবে। হুথিদের ওপর সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলার ছয় বছর পার হয়ে গেলেও এখনো সেই যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত বড় সাফল্য বলতে সংযুক্ত আরব আমিরাত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সেকোত্রা মুক্ত করেছে।
শুরু থেকেই ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে সব রকমের সহযোগিতা দিয়েছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সৌদি যুবরাজের সম্পর্ক ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। ডোনাল্ড ট্রাাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সাথে এমবিএসের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরব ইয়েমেন যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহযোগিতা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই সর্ম্পকের কারনে খাশোগি হত্যা ও নারী অধিকার কর্মীদের গ্রেফতারের ঘটনাগুলোও ট্রাম্প প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করেছে।
কিন্তু ট্রাম্পের পরাজয়ে পাশার দান উল্টে গেছে। ঝানু রাজনীতিক জো বাইডেন তার ভোটারদের দেখাতে চান যে, তিনি ট্রাম্পের মতো অদ্ভুত নীতিতে চলবেন না। যুবরাজকে পাত্তা না দিয়ে তিনি সৌদি আরবের সাথে সব ব্যাপারে বাদশাহ’র সাথেই যোগাযোগ রাখতে চান। সৌদি বাদশাহর সাথে পদমর্যাদা ও বয়স দুই দিক থেকে জো বাইডেন সমপর্যায়ের, যে কারণে তিনি সেটিই অনুসরন করতে চান বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
জো বাইডেনের জন্য এই পদক্ষেপের পথে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। কার্যত সৌদি আরবের দৈনন্দিন সরকার পরিচালনার কাজটি যুবরাজই করে থাকেন। বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারণে বাদশাহর পক্ষে প্রতিদিন দাফতরিক কাজ করা সম্ভব নয়। হয়তো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তিনি হাজির থাকেন, কিন্তু তার প্রতিনিধি হিসেবে দৈনন্দিন কাজগুলো যুবরাজই করে থাকেন।
বাইডেন যে পুরোপুরি এমবিএসকে এড়িয়ে চলতে পারবেন সেটিও স্পষ্ট করে বলার সুযোগ নেই। আবার সব কিছু ঠিক থাকলে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই বিন সালমানকে বাদশার গদিতে দেখা যেতে পারে, সেক্ষেত্রে বাইডেনকে তখন ঠিকই তার উদ্দেশ্যে অভিনন্দন বার্তা পাঠতে হবে কিংবা তার সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। আবার যুবরাজকে না হয় এড়িয়ে চলা গেল; কিন্তু ওয়াশিংটন চাইলেই কি রিয়াদকে বাদ দিয়ে চলতে পারবে?
মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদের প্রভাব কাজে লাগিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে, তাই বাইডেন এমবিএসকে সাইডলাইনে পাঠাতে চাইলেও সৌদি আরবকে লাগবেই। উপসাগরীয় অঞ্চল ও সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সৌদি আরবের একটি প্রভাব রয়েছে, কারণ এই দেশটিতেই অবস্থিত মুসলিমদের পবিত্র দুটি মসজিদ, এই দেশটিই নবী মুহাম্মাদ সা. এর জন্মভূমি। এখান থেকেই বিকশিত হয়েছে ইসলাম।
এছাড়া সৌদি আরবের রয়েছে অঢেলপ্রাকৃতিক সম্পদ। বৈশ্বিক তেল বাজারের ওপরও দেশটির প্রভাব অনেক।যে কারণে হোয়াইট হাউসের সাথে সৌদি রাজপ্রাসাদের সম্পর্ক থাকবে উভয় পক্ষের স্বার্থেই।সেটি বিবেচনায় রেখেই হয়তো হোয়াইট হাউস বলেছে, সৌদি আরবের প্রতি তাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বরাবরের মতোই। ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে ছোড়া মিসাইলগুলো ঠিকই মার্কিন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দিয়েই ধ্বংস করা হবে।
কিন্তু মাঝখান থেকেএমবিএসের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য একটা ধাক্কা হয়ে এলো বাইডেনের এই অনীহা। সৌদি যুবরাজকে হয়তো অনিচ্ছ সত্ত্বেও সেটি মেনে নিয়েই চলতে হবে যতদিন না বাদশাহর গদিতে বসার সুযোগ না আসবে তার সামনে।