আফ্রিকার দেশে দেশে ইরানের হামলার পরিকল্পনা!


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৭:৪৩

আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে ইরানের হামলার কয়েকটি পরিকল্পনা সম্প্রতি ভণ্ডুল হয়ে গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইরানি গোয়েন্দাগিরির নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব তথ্য নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এতে ইরানের গোয়েন্দা সক্ষমতার একটি চিত্র পাওয়া যায়।

ইথিওপিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি ১৫ সদস্যের একটি সেলের সন্ধান পায়। বলা হচ্ছে, তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসে হামলা চালাতে চেয়েছিল। গোয়েন্দারা বেশ কিছু অস্ত্র ও বিস্ফোরকও উদ্ধার করে। তাদের দাবি, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় একটি বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছেন তারা।

তবে হামলা পরিকল্পনার পেছনে কারা, তার বিস্তারিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেনি ইথিওপিয়ার কর্মকর্তারা। শুধু একমাত্র ক্লু ছিল ১৬তম ব্যক্তির গ্রেফতার। আহমেদ ইসমাইল নামের ওই ব্যক্তি সেলের প্রধান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় তাকে সুইডেন থেকে গ্রেফতার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল ইরান। এজন্য গত শরতে আদ্দিস আবাবায় গুপ্তচর সেল নিয়োগ দেয় ইরানি গোয়েন্দারা। তারা আমেরিকা ও ইসরাইলি দূতাবাস সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিল।

ইথিওপিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, আদ্দিস আবাবায় ইরানের এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার দেশগুলোতে নমনীয় টার্গেটে হামলা চালানো। এর মাধ্যমে ইরান সাম্প্রতিক সময়ে তাদের একজন শীর্ষ বিজ্ঞানী ও একজন জেনারেলকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। ইসরাইলি গোয়েন্দাদের হাতে গত নভেম্বরে নিহত হন পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ। এছাড়া বছর খানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় মারা যান জেনারেল কাসেম সোলায়মানি।

পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে পেন্টাগনের আফ্রিকা কমান্ডের গোয়েন্দা পরিচালক রিয়ার এডমিরাল হেইদি কে বার্গ বলেছেন, ইথিওপিয়া থেকে ১৫ জনের সেল এবং সুইডেন থেকে তাদের মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতারের ঘটনাটি ইরান কেন্দ্রিক। ইথিওপিয়া ও সুইডেন ওই পরিকল্পনা নস্যাতে একযোগে কাজ করেছে বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন অ্যাডমিরাল বার্গ।

ইরান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, এটা ইহুদিবাদী বৈরি গণমাধ্যমের ছড়ানো ভিত্তিহীন অভিযোগ। আদ্দিস আবাবায় ইরান দূতাবাসের একজন নারী মুখপাত্র বলেন, ইথিওপিয়া বা আমিরাত এসব ইস্যুতে ইরানের হস্তক্ষেপের কোনো অভিযোগ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্ততায় গত সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ক্ষিপ্ত হয় ইরান। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক।

ইথিওপিয়া এখন পর্যন্ত গ্রেফতারদের মধ্যে মাত্র দুজনের নাম প্রকাশ করেছে। কেন ওই হামলা পরিকল্পনায় ইরানের দিকে আঙ্গুল তোলা হচ্ছে না, তার কারণ জানাতে অস্বীকার করেছেন ইথিওপিয়া পুলিশের একজন মুখপাত্র। তবে একাধিক কূটনীতিক জানিয়েছেন, ইথিওপিয়া হচ্ছে আফ্রিকার কূটনৈতিক রাজধানী। সেখানে আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তর অবস্থিত। বড় শক্তিগুলো এ নিয়ে প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ুক, তা চায়নি দেশটি।

ইথিওপিয়ার জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা জানিয়েছে, সুদানের খার্তুমে আমিরাতি দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা করছে ইরান নিয়োজিত আরেকটি দল। সুদানের একজন কর্মকর্তাও একথা নিশ্চিত করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ইথিওপিয়ায় ওই গ্রেফতারের পেছনে দক্ষিণ আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে হত্যায় ইরানের ব্যর্থ পরিকল্পনার ঘটনাও যুক্ত। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম পলিটিকো এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আমেরিকা ও সুদানের কর্মকর্তারা তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ নিয়ে কথা বলেছেন।

তবে ইথিওপিয়ার ওই গ্রেফতার এবং হামলা পরিকল্পনায় ইরানের ভূমিকা এখনো রহস্যঘেরা। ইথিওপিয়ার পুলিশ এখনো ওই ১৫ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দেয়নি। তাদের দুজনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতারদের মধ্যে অন্তত তিনজন ইরানি নাগরিক।

ইথিওপিয়ায় ওই গ্রেফতারের ঘটনা এমন সময় ঘটল যখন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তিতে ফের ফেরার পরিকল্পনা করছে। বাইডেন প্রশাসন বারাক ওবামা আমলের চুক্তিটি আবার পুনর্বহাল করতে চায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে চুক্তিটি বাতিল করেন। বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়াতে ইরানি গোয়েন্দা মন্ত্রী সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা শিগগিরই প্রত্যাহার না হলে তারা পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে ফেলবেন।

আফ্রিকা কমান্ডের অ্যাডমিরাল বার্গ ইথিওপিয়ায় গ্রেফতারের ঘটনায় ইরানের ভূমিকা নিয়ে অনেক তথ্য দিলেও ওয়াশিংটনের সামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা এ নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে ইসরাইলি কর্মকর্তারা আবার এ ঘটনাটির জোর প্রচারে নেমেছেন। এর মাধ্যমে তারা ওয়াশিংটন ও তেহরানের সম্ভাব্য সমঝোতাকে ভণ্ডুল করতে চাইছেন এবং দেখাতে চাইছেন যে ইরানকে বিশ^াস করা যায় না।

বাস্তবতা হচ্ছে ইরানের মধ্যে হয়তো প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করছে। জেনারেল সোলায়মানি ও ফাখরিজাদেহ হত্যার জবাব দিতে এখনো কার্যত কিছুই করতে পারেনি ইরান। শুধু সোলায়মানি হত্যার পর আমেরিকার ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল ইরান। সেটা তেমন বড় কিছু ছিল না।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফরেন পলিসি এক্সপার্ট অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, বাইডেন যখন পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে চাচ্ছেন তখন ইরান কেন আমিরাতকে লক্ষ্যবস্তু করতে চায় তা কৌতুহলের বিষয়। তবে অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের শত্রুর তালিকায় আরব আমিরাত উপরে আছে।

ইথিওপিয়ায় আমিরাতের দূতাবাসে হামলা পরিকল্পনার সময়টিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় টাইগ্রেতে যুদ্ধ চলছে। এ সময় ইথিওপিয়ার পুরো নজর সেদিকে। ফলে সেখানে হামলা চালানো সহজতর।

ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের গবেষক ও সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা ব্রুস রিডেল মনে করেন, আফ্রিকায় এ ধরনের অভিযানের জন্য সহজক্ষেত্র। আর ইথিওপিয়া তো গত নভেম্বর থেকেই যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত।

ইথিওপিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ইরানের এ ধরনের পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়। নব্বইয়ের দশকে সুদানের সামরিক শাসক ওমর আল বশিরের সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। পরের দশকে ইরিত্রিয়ায় মোতায়েন করা হয় ইরানি রণতরী।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৯ সালে সুদানি ট্রাকে গাজা উপত্যকায় অস্ত্রশস্ত্র পাঠায় ইরান। ইসরাইল আগেভাগে তা জেনে ফেলে এবং তাতে বিমান হামলা চালায়। তবে হর্ন অফ আফ্রিকার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে শীতল হয়েছে আর উষ্ণ হয়েছে ইসরাইল ও আমিরাতের।

আরব আমিরাতের মধ্যস্ততায় ২০১৮ সালে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি হয়। বর্তমানে ইরিত্রিয়ার বন্দরে মোতায়েন রয়েছে আমিরাতের রণতরী। ইথিওপিয়া ও ইসরাইলের মধ্যেও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

সম্প্রতি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োসি কোহেন ইথিওপিয়া সফর করেন। ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলছেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইরানের তৎপরতা সম্পর্কে তারা সেখানকার বন্ধু দেশগুলোকে গোপনীয় তথ্য দিয়ে থাকে।

২০১২ সালে কেনিয়ায় ১৫ কেজি বিস্ফোরকসহ দুই ইরানিকে গ্রেফতার করা হয়। তারা সেখানে ১৫ বছরের সাজা খাটছেন। কেনিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ছিলেন ইরানের রিভ্যুলিউশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের সদস্য। তাদের আইনজীবী বলেছেন, কেনিয়ায় তাদেরকে ইসরাইলি গোয়েন্দারাও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

এর চার বছর পরে ২০১৬ সালে কেনিয়ায় ইসরাইল দূতাবাসের ভিডিও করার সময় দুই ইরানি নাগরিককে গ্রেফতার করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তারা ছিলেন কূটনীতিকদের গাড়িতে। ইরান বলছে, তারা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক।

জর্জিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতে ইরানি গুপ্তচরদের হামলার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করার কথা বলা হয়েছে এসব দেশের পক্ষ থেকে। গত ৪ ফেব্রুয়ারির বেলজিয়ামের একটি আদালত একজন ইরানি কূটনীতিককে ২০ বছরের জেল দিয়েছে। তিনি ২০১৮ সালে ফ্রান্সে ইরান বিরোধীদের সমাবেশে বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

সেই ব্যর্থ পরিকল্পনা ও ডেনমার্কে আরেকটি ঘটনায় ২০১৯ সালে ইরানের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ইরানি সেই গোয়েন্দা সংস্থাটিই ইথিওপিয়ায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল।

ওয়াশিংটন ইন্সটিউটের ইরানি সশস্ত্র বাহিনী বিশেষজ্ঞ ফারজিন নাদিমি মনে করেন, আফ্রিকায় এসব তৎপরতার মাধ্যমে ইরান হয়তো বাইডেন প্রশাসনকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। আর সেটা হচ্ছে ইরানের সঙ্গে দ্রুত চুক্তিতে না ফিরলে বিপদ আছে।