মুসলিম ভোটেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনি ফয়সালা


  • আলতাফ পারভেজ
  • ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:২৪

লোকসংখ্যার হিসাবে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হিস্যা মাত্র ৭-৮ শতাংশের মতো। কিন্তু এ মুহূর্তে রাজ্যটির দিকেই দেশের রাজনৈতিক মনোযোগ ছুটছে। খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী গত দুই মাসে দুইবার এসে গেছেন এ রাজ্যে। এ মাসে আসবেন আরেকবার। মার্চ-এপ্রিলেও তিনি এ রাজ্যে আসবেন।

ভোটের তারিখ ঘোষণা না হলেও পশ্চিমবঙ্গ এরইমধ্যে উত্তাল। কলকাতা থেকে দার্জিলিং- সর্বত্র শুরু হয়েছে প্রচার, জল্পনা-কল্পনা। উত্তেজনাও।

এ উত্তেজনায় প্রধান এক রসদ হয়ে উঠেছে রাজ্যের মুসলিম ভোট। বলাবলি হচ্ছে, মুসলিমদের ভোটেই বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যের ফয়সালা হবে এবার।

এ রকম প্রচারণার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দ্বিমুখী। ভোটে মুসলিমদের গুরুত্ব বেড়েছে তাতে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো ধর্মকে সামনে রেখে ভোটের মেরুকরণ ঘটাতে চাইছে। তাতে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিও মুসলিমদেরই বেশি।

২০১১ সালের হিসাবে ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা ১৪ ভাগ। কিন্তু কেন্দ্রীয় লোকসভায় মুসলিম সদস্য আছেন ২৭ জন। যা মোট সদস্যের মাত্র ৫ ভাগ। তবে পশ্চিমবঙ্গে এই চিত্র অনেকখানি আলাদা। এই রাজ্যে লোকসংখ্যায় তারা প্রায় ২৭ ভাগ। কাশ্মীর ও আসামের পর ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই মুসলিমদের হিস্যা বেশি। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও এ রাজ্যে তারা কিছুটা এগিয়ে।

স্থানীয় বিধানসভায় ৫৯ জন সদস্য আছেন মুসলিম। যা বিধানসভার সদস্যদের ২০ ভাগ। রাজ্যের অন্তত ৩টি জিলায় মুসলিমরা অ-মুসলিমদের চেয়ে বেশি। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের হাত থেকে রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা তৃণমূলের হাতে আসার পেছনে মুসলিম ভোটব্যাংকের পছন্দ পরিবর্তনের বড় ভূমিকা ছিল। এখন আবার এক দশক পর একই ভোটব্যাংকে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে চাইছেন দুই মুসলিম নেতা আব্বাস সিদ্দিকী এবং আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তাতে লাভ বিজেপিরই।

পরিস্থিতি বলছে, এবারের ভোটে সরাসরি যুদ্ধ হচ্ছে তৃণমূল এবং বিজেপির মাঝে। তৃতীয় জোট হিসেবে আছে কংগ্রেসে-বামপন্থীরা। কিছু আসনে লড়াই হতে পারে ত্রিমুখী।

রাজ্যে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেটা ছিল লোকসভার ভোট। তখনকার হিসাবে দেখা গেছে, তৃণমূল ও বিজেপির ভোটের ব্যবধান মাত্র ২-৩ ভাগ। তৃণমূল পেয়েছে ভোটের ৪৩ দশমিক ৩ ভাগ এবং বিজেপি পেয়েছে ৪০ দশমিক ৭ ভাগ। এরকম প্রবণতা চলতে থাকলে এবার যে এই দুই দলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে সেটাই সকলের অনুমান। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অনেক আসনেই রফা হবে অল্প ভোটে। বিধানসভায় প্রধান দলগুলোর আসনের ব্যবধান হতে পারে অল্প। এরকম ‘ক্লোজ-ম্যাচে’ সঙ্গতকারণেই ২৭ ভাগ মুসলিম ভোটারকে বিবেচনা করা হচ্ছে ফলাফল নির্ধারক হিসেবে।

এই রাজ্যের জেলাগুলোর মাঝে কেবল উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ ও মালদায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই তিন জেলা মিলে বিধানসভার আসন আছে ৪৪টি। মোট আসনের ১৫ ভাগ সেটা। এর বাইরে অন্তত সাতটি জেলা আছে যেখানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোট হিস্যা ২৫ ভাগ কিংবা তার বেশি। বিধানসভায় এসব জেলার আসন আছে আরও ১২৫। এভাবে প্রায় দশটি জেলার দেড় শতাধিক আসনে মুসলিম ভোটাররা ফলাফলকে প্রভাবিত করার অবস্থায় আছে।

২০১১ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের আস্থার জোট ছিল বামফ্রন্ট। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল তারা। কিন্তু তাদের ক্ষমতার শেষলগ্নে দেখা গেল তিন দশকের শাসনেও তারা মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রত্যাশিত উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। এতে মুসলিম ভোটারদের পছন্দ স্থানান্তরিত হয় মমতার তৃণমূলের দিকে। এই অদল-বদল কীভাবে ঘটছে সেটা পশ্চিমবঙ্গের গত দুটি লোকসভা নির্বাচনের ভোট বিশ্লেষণ করলেই টের পাওয়া যায়। ‘লোকনীতি’ নামের একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকালে এই রাজ্যে মুসলিম ভোটের ৪০ ভাগ পেয়েছিল তৃণমূল। ২০১৯ সালে সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে ৭০ ভাগ। অর্থাৎ সময় যত গড়াচ্ছে রাজ্যের মুসলিম ভোট তৃণমূলকেন্দ্রীক হয়ে গেছে। এর বিপরীতে হিন্দুভোটও ক্রমে বিজেপিমুখী হচ্ছে।

২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল হিন্দুভোটের ২১ ভাগ। ২০১৯-এ, পরের নির্বাচনে পেয়েছে ৫৭ ভাগ।

একই সংস্থার অন্য আরেক জরিপে দেখা গেছে, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনকালে তৃণমূল ৩৫ ভাগ মুসলিমদের ভোট পেয়েছিল। পরের বিধানসভায় এই হিস্যা বেড়েছে ৫১ ভাগ।

এসব তথ্য থেকে দুটি বার্তা মেলে। পশ্চিমবঙ্গে ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটছে। তাতে করে তৃণমূলের জন্য মুসলিমদের ভোট বাড়তি মূল্যবান হয়ে উঠেছে। সেটা আবার হিন্দু-মুসলিমে রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়চ্ছে।

অতীত পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট মুসলিম ভোট বেশি পেলেও এবার মমতার জন্য সংখ্যালঘু ভোট কমার চ্যালেঞ্জ ঐ দুই তরফ থেকে আসেনি। খোদ মুসলিম কমিউনিটির ভেতর থেকে এসেছে। ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি নতুন একটা দল করেছেন। আবার হায়দ্রাবাদের আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর দল নিখিল ভারত মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন বা ‘মিম’ আব্বাস সিদ্দিকির ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’-এর সঙ্গে জোট করে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে অংশ নেবে। এই দুই মুসলিমপ্রধান দল যদি জোট বেঁধে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রার্থী দেয় তাহলে তৃণমূলের জন্য বিষয়টা উদ্বেগের।

আব্বাস সিদ্দিকি এবং আসাদউদ্দিন ওয়াইসি উভয়ে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সমাজে সুপরিচিত। আব্বাস জনপ্রিয় বাংলাভাষী ধর্মভিরু মুসলিম যুবকদের মাঝে। আদিবাসী কিছু মানুষকেও তিনি দলে টানছেন। অন্যদিকে ওয়াইসির আবেদন আছে শহুরে উর্দুভাষী উচ্চবিত্ত মুসলিম সমাজে এবং মালদা-মুর্শিদাবাদে। গত মাসে উভয়ে এঁরা ফুরফুরা শরীফে বৈঠক করেছেন।

ওয়াইসি বরাবরই ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের বঞ্চনায় প্রতিবাদী। এতে এই জনগোষ্ঠীর তরুণদের কাছে তাঁর ইতিবাচক পরিচিতি আছে। যার প্রমাণ মিলেছে গত নভেম্বরে বিহারের পূর্ণিয়া-কিষাণগঞ্জ অঞ্চলের মুসলিমপ্রধান এলাকায় তাঁর মনোনীত ৫ প্রার্থীর নাটকীয় বিজয়ে। তাতে সেখানে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট-বিরোধী বিজেপি জোটেরই লাভ হয়। প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গেও মুসলিমপ্রধান দলগুলো কী একই রকম ভূমিকাই রাখবে? বিজেপিবিরোধীদেরই ক্ষতি করবে তারা?

ফুরফুরার পীরজাদা কিংবা হায়দ্রাবাদের ওয়াইসি আলাদা বা জোটগতভাবে নির্বাচন করে পশ্চিমবঙ্গে আসনের হিসাবে কোন সফলতা পাবে কি নাÑ সর্বশেষ বিধানসভা বা লোকসভার ভোটের হিসাব থেকে সেরকম অনুমান করা শক্ত। খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। কিন্তু এদের প্রার্থীরা সর্বত্র কিছু ভোট পাবেই। বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে এদের জোট হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। আব্বাসকে বাম-কংগ্রেস জোট পেলে উভয়ের তাতে ভোট বাড়বে। এর কিছু অবশ্যই থাকবে তৃণমূলের ঘাসফুল মার্কা থেকে ছুটে যাওয়া মুসলিম ভোট। তাতে লাভ পদ্মফুল মার্কার। যে মার্কার সংগঠকরা সরকার গড়ুকÑ সেটা অনেক মুসলিমই দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ৫-৬ বছরের নানান ঘটনাবলীর কারণে চাইবে না। কিন্তু ঘাসফুল থেকে ২-১ ভাগ ভোট কমা আর পদ্মফুলের দিকে ২-১ ভোট বাড়ায় আসনের হিসাবে ভূমিকম্প ঘটাবে। আব্বাস সিদ্দিকির পৃথক নির্বাচন মানেই তৃণমূলের প্রায় দুই ডজন সিট অনিশ্চয়তায় পড়া। আবার আব্বাসের পৃথক নির্বাচনে মালদার মতো জেলায় বাম-কংগ্রেসের মুসলিম ভোটেও টান পড়তে পারে।

তাহলে আব্বাস সিদ্দিকি ও আসাদউদ্দিন ওয়াইসি কী বিজেপি বিরোধিদের ভোট কাটতেই নামছেন? এরকম প্রশ্ন আছে ভোটের বাজারে। যদিও ঐ দুই নেতা এসব গুজবকে তৃণমূলের প্রচার বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের মত, মুসলিমদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা দরকার। তৃণমূল তাদের জন্য বিশেষ কিছু করেনি। সময় এসেছে নিজদের বিশ্বাসের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার।

আব্বাস সিদ্দিকি ও ওয়াইসির বিরোধিতা ভোটের হিসাবে মমতার জন্য উদ্বেগের হলেও প্রচারণায় তৃণমূলের জন্য সেটা ভালোই হচ্ছে। এতে মমতাকে আর আগের মতো মুসলিম-বান্ধব বলে গাল দিতে পারছে না বিজেপি।

তৃণমূলের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষকদের দাবি, সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ যাই করুণÑ রাজ্যজুড়ে সাধারণ মুসলিমরা বিজেপি রুখতে ঘাসফুলে ছাপ না দিয়ে উপায় নেই। মমতাই কেবল অমিত শাহর সামনে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাহস করে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের কোন দলকে মুসলিমরা বড় অংকে ভোট দিয়েছেÑ এমন নজির নেই। বরং সবসময়ই এই সম্প্রদায় ধর্মনিরপেক্ষ কোন বড় দলকে ভোটযুদ্ধে বেছে নিয়েছেÑ শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি হিসেবে। এবার অবশ্য হিসাবটি আর সেরকম সরল নেই।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক