কাতার এখন বিশ্বে প্রধান মধ্যস্থতাকারী

-

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৪:০৪

উপসাগরীয় ক্ষুদ্র দেশ কাতার বিশ্বে নতুন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কাতারকে এখন বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় মধ্যস্থতাকারী দেশ। মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশের সংকটে দেশটি সৎ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। দোহার দূতিয়ালিতে বিবদমান পক্ষের মধ্যে বহু ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কাতার নিজেকে বিশ্বে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তুলে ধরার জন্য তৎপর হয়েছে। আফগানিস্তানে শান্তির জন্য তালেবান এবং আমেরিকার মধ্যে মীমাংসা আলোচনা এখন চলছে দোহায়। সম্প্রতি সুদানে সংকট নিরসনে কাতার মধ্যস্থতা করেছে। লেবাননে এবং ইয়েমেনেও কাতার এ ধরণের ভূমিকা রাখছে। এবার আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে পরমাণু চুক্তি এবং সৌদির সঙ্গে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে কাতার।

২০১৫ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি পুনর্বহাল করার জন্য কাতার মধ্যস্থতা করছে বলে জানিয়েছেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুররহমান আল থানি। তিনি এলক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইরান বিষয়ক বিশেষ দূত রবার্ট মলি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আবার ইরানের সঙ্গে চৃক্তিতে ফিরতে চাইছেন। তবে এ নিয়ে এখনও ঐকমত্যে পৌছাতে পারেনি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র।

কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তার দেশ ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচষ্টো চালাচ্ছে।

নিরপেক্ষ শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে কাতার এর আগে লেবানন, সুদান ও ইয়েমেনে বিবদমান পক্ষকে চুক্তিতে উপনীত হতে সহায়তা করেছে। মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর দোহায় এসব পক্ষের বৈঠক আয়োজনে কাতার বিপুল অর্থ খরচ করছে। শান্তি স্থাপনকারী দেশগুলোতে কাতার অর্থ সহায়তাও দিয়েও পাশে দাড়াচ্ছে।

আফগান শান্তি চুক্তির আগে কাতার দারফুরে শান্তিচুক্তি, লেবাননে গৃহযুদ্ধের অবসান ও জিবুতি-ইরিত্রিয়ার সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রেখেছে। শান্তিচুক্তির পর এসব দেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে কাতার।

তবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কাতার মৈত্রী স্থাপন করতে সক্ষম হলেও তার প্রতিবেশীরাই হয়ে উঠেছিল তার বড় শত্রু। তাদের অন্যতম হলো সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাইরাইন।

তিন বছর ধরে যেসব কারণে সৌদি আরব এবং আরও দুটি উপসাগরীয় দেশ কাতারকে একঘরে করেছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল দোহার সাথে তেহরান এবং আঙ্কারার ঘনিষ্ঠতা।

সম্প্রতি সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা যখন সেই অবরোধ তুলে নেয়, কাতার তখন পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে তুরস্ক এবং ইরানের সাথে তার সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।

কাতার এখন সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের খোলাখুলি পরামর্শ দিচ্ছে তারা যেন ইরানের সাথে বিবাদ জিইয়ে না রেখে আপোস মীমাংসার উদ্যোগ নেয়। প্রয়োজনে সেই মীমাংসায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিচ্ছে কাতার।

সম্প্রতি কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল থানি আমেরিকার ব্লুমবার্গ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ইরানের সাথে মীমাংসায় বসার জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে আহ্বান জানান।

ক্ষমতাধর এই কাতারি মন্ত্রী বলেন, উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর জোট জিসিসির সদস্যরাও এখন ইরানের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক। তিনি বলেন, কাতার আশা করছে বাস্তবেই এই মীমাংসা আলোচনা হবে।

তারও সপ্তাহখানেক আগে সন্ত্রাস-দমন এবং বিরোধ নিরসন বিষয়ক কাতার সরকারের বিশেষ দূত ড. মুতলাক আল খাতানি দোহায় এক সম্মেলনে বলেন, সৌদি আরবের সাথে ইরান এবং তুরস্কের বিরোধ মেটাতে কাতার মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত।

কাতারের এই প্রস্তাব নিয়ে ইরানের কাছ থেকে ইতিবাচক কথা শোনা গেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ গত ২০ জানুয়ারি তেহরানে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে কাতারের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছন। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে আলাপ আলোচনায় ইরান সবসময় আগ্রহী।

পরে জারিফ টুইট করেন, ‘আমার ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল থানির এই প্রস্তাবকে আমি স্বাগত জানাই। আমরা সবসময় বলে আসছি এই অঞ্চলের সঙ্কটের সমাধানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন । শুধু তাহলেই এই অঞ্চল সমৃদ্ধ হবে, স্থিতিশীল হবে এবং বাইরের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হবে।

সৌদি আরবের কাছ থেকে কাতারের এই প্রস্তাব নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো কথা শোনা যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেভাবে সৌদি বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন তাতে রিয়াদ এ ধরনের আলোচনায় নিশ্চয়ই আগ্রহী হবে । বাইডেন ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে ফিরলে সৌদি শাসকরা আরও বেকায়দায় পড়বে।

লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি মনে করেন, ইরান মুখে স্বাগত জানালেও সৌদি আরবের সাথে কোনো মীমাংসা বা দেন-দরবারের কোনো আগ্রহ বা প্রয়োজন তাদের নেই। যে দেন-দরবার, মীমাংসার জন্য ইরান এখন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তা আমেরিকার সাথে। ইরান জানে আমেরিকার সাথে মীমাংসা হলে সৌদি আরব এবং অন্য আরব দেশগুলোকে তা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে এবং সেই পথে হাঁটতে হবে।

সামি হামদির মতে, ২০১৫ সালে ইরানের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল সেটি শুধুমাত্র ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত ছিল না। বরঞ্চ ইরানের শক্তি এবং প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তারই একরকম স্বীকৃতি ছিল ঐ চুক্তি।

তিনি বলেন, ইরাকে সরকার এবং নিরাপত্তাবাহিনী সহ সর্বক্ষেত্রে এখন ইরানের ব্যাপক প্রভাব। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। লেবাননে, সিরিয়ায় ইরানের অনুগামীরা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। আমেরিকা এই বাস্তবতা বুঝতে পারছে এবং মনে করছে ইরানের সাথে এক ধরণের বোঝাপড়ার হয়ত বিকল্প নেই। ইরাকে গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা ইরানের সাথে এক ধরণের আপোস করেই চলছে।

সৌদি আরব মনে করে ইরানের সাথে আমেরিকার যে কোনো বোঝাপড়ার অর্থই হচ্ছে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস। কিন্তু জো বাইডেন নির্বাচনের আগে এবং জেতার পর একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন ইরানের সাথে ২০১৫ সালের চুক্তি পুনর্বহালে তিনি আগ্রহী। তিনি মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থের জন্য এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প।

বাইডেন পররাষ্ট্র এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগে যেসব লোক নিয়োগ করেছেন তাদের অনেকেই ইরানের সাথে করা ২০১৫ সালের চুক্তি প্রণয়নের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

সামি হামদি বলেন, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সংলাপ হবে না। বরং এটা হবে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে এবং সেদিকেই পুরো মধ্যপ্রাচ্যের এখন নজর।

তিনি বলেন, কাতার সেটা জানে এবং এ ধরনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে তারা আমেরিকা এবং বাকি উপসাগরীয় দেশগুলোকে এই বার্তা দিচ্ছে যে ইরানের সাথে আমেরিকার বোঝাপড়ার যে কোনো উদ্যোগে তাদের পরিপূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

আমেরিকার সাথে চুক্তি মানেই ইরানের সুবিধা এবং সৌদি আরবের অসুবিধা। কাতার এবং আরো সব ছোট ছোট উপসাগরীয় দেশগুলো ভেতরে ভেতরে চায় সৌদি আরবের শক্তি এবং প্রভাব যেন কমে। কারণ তাহলেই তারা সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এমনকি আমিরাতও এখন অনেক ব্যাপারে সৌদি আরবের ব্যাপারে বিরক্ত। সৌদিদের তোয়াক্কা না করেই তারা ইয়েমেনে নিজেদের অনুগত বাহিনী তৈরি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক মেহরান কামরাভা তার এক গবেষণা প্রবন্ধে লিখেছেন – উপসাগরীয় ক্ষুদ্র এই দেশটি ক্রমে বিশ্বের অন্যতম একটি মধ্যস্থতাকারী দেশ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এর পেছনে আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন এবং মর্যাদার সাথে টিকে থাকার চেষ্টাই প্রধান উদ্দীপনা হিসাবে কাজ করছে। সেই সাথে রয়েছে কাতারের রাজ-পরিবারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিগত আগ্রহ।

তিনি লিখেছেন, নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি কাতারের তৈরি হয়েছে। প্রচুর সম্পদ থাকায় সহজে তারা এ ধরনের সুবিধা তৈরি করে দিতে পারে। পয়সার কারণে শান্তির প্রতিদান হিসাবে প্রয়োজনে আর্থিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়াও কাতারের পক্ষে সম্ভব।

সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে গোপন যোগাযোগ প্রধানত হয়েছে ওমানের মাধ্যমে। ২০১৫ সালের ইরানের সাথে চুক্তির সময়ও যোগাযোগের যোগসূত্র ছিল ওমান। অনেক বৈঠক হয়েছ মাসকাটে। অনেক সময় দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ও হয়েছে ওমানের মধ্যস্থতায়।

সামি হামদি মনে করেন, কাতার হয়তো ওমানের সেই ভূমিকা নিয়ে নিতে আগ্রহী। ওমানের প্রয়াত সুলতান কাবুস এ নিয়ে যতটা পারদর্শী ছিলেন, সে ব্যাপারে নতুন শাসককে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এই সুযোগে কাতার হয়তো ভাবছে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম এখন তারা হতে পারে।

আমেরিকানদের এবং ইরানিদের মধ্যে বসার ব্যবস্থা করতে কাতার সক্ষম হলে সেটা হবে তাদের জন্য বড় মর্যাদা। বাকি মধ্যপ্রাচ্যকে কাতার দেখাতে পারবে তারা আমেরিকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি মিত্র।