গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ভারতে চলছে কৃষক আন্দোলন। এই দীর্ঘ আন্দোলনে ২ ফেব্রুয়ারি কৃষক আন্দোলনের স্মরণীয় একটি দিন। এদিন পপ সুপারস্টার রিহান্না ভারতের কৃষক আন্দোলন বিষয়ে একটি টুইট বার্তা প্রকাশ করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রিহান্নার এ টুইট বার্তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে কোটি কোটি মানুষের কাছে শুধু কৃষক আন্দোলনের খবর পৌঁছেনি, বিশ্বজুড়ে কৃষকদের প্রতি সহমর্মিতাও তৈরি হয়। এ নিয়ে ভারত সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। পাল্টা মিডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিহান্নার রয়েছে ১০ কোটির বেশি ফলোয়ার। ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে রিহান্নার টুইট বার্তায় ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লাইক পড়ে প্রায় ১০ লাখ। তার টুইট বার্তা রিটুইট হয়েছে প্রায় ৪ লাখ। কমেন্ট পড়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজরের বেশি। এ টুইট রিটুইট করেছে বিশ্বব্যাপী আরো অনেকে স্টার ও সুপারস্টার।
রিহান্নার টুইট বার্তার পর বিশ্ব আরেকবার দেখল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ডিজিটাল মিডিয়া, ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, ডিজিটাল সংহতি, বিকল্প গণমাধ্যম এবং বিকল্প স্বাধীন গণমাধ্যমের ক্ষমতা। এক কথায় ইন্টারনেটের শক্তি।
রিহান্নার টুইট বার্তা কতটা শক্তিশালী আর প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমান পাওয়া গেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও কিছু বলিউড তারকার কড়া প্রতিক্রিয়া । রিহান্নার টুইট বার্তার কড়া সমালোচনা করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এ বিবৃতিকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন ক্রিকেট নায়ক সচিন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে ভারতের ক্রীড়াজগত আর বলিউডের অনেক তারকা ।
তাদের অনেকে তীব্র সমালোচনা করেছেন রিহান্না, গ্রেটা থুনবার্গসহ বিশ্বের যেসব সেলিব্রিটি কৃষক আন্দোলনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের অনেকে ভারতের এসব তারকাদের বিবৃতিকে সরাসরি কৃষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
এসব তারকা এতদিন পর্যন্ত কৃষকদের পক্ষে কোনো কথা না বলে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। এখন সরকারের পক্ষ নিয়ে তাদের দেয়া বিবৃতিতে ক্ষুব্ধ তাদের অগণিত ভক্ত। এ নিয়ে ইন্টারনেট জগতে কয়েক দিন পর্যন্ত ঝড় বইতে থাকে। বস্তুত রিহান্নার টুইট বার্তা বিষয়ে ভারতের সরকার এবং সেলিব্রিটিদের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতের কৃষক আন্দোলন বিশ্বব্যাপী আরো বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়ার সহায়তা করা হয়েছে। রিহান্না আর গ্রেটাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বিজেপি সমর্থক ভারতের অনেক গণমাধ্যমও।
ভারতে কৃষক আন্দোলন দমনে ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে সিএনএনের একটি খবরের লিঙ্ক প্রকাশ করে ২ ফেব্রুয়ারি টুইট করেন রিহান্না । রিহান্না টুইটে লেখেন, আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি না কেন। টুইটে রিহান্না ‘ফার্মারস প্রটেস্ট’ হ্যাশট্যাগ যুক্ত করেন। মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তার এ পোস্ট। কয়েক ঘণ্টা পর রিহান্নার এ টুইট বার্তা রিটুইট করেন পরিবেশ আন্দোলনকারী ১৮ বছর বয়সী বিশ্ব নন্দিত গ্রেটা থুনবার্গ। এরপর কৃষক আন্দোলনের প্রচারনা নতুন মাত্রা পায়।
গ্রেটা থুনবার্গ তার টুইট বার্তায় ব্যবহার করেন একটি টুলকিট যাতে রয়েছে কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য। গ্রেটা থুনবার্গের টুইট প্রকাশের পর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এফআইআর দায়ের করে ভারতীয় পুলিশ। ভারতীয় পুলিশের দাবি গ্রেটার বিরুদ্ধে নয় বরং তার টুলকিট বিষয়ে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ তদন্ত করে দেখছে গ্রেটা থুনবার্গের এ পোস্টের সাথে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র জড়িত রয়েছে কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিসের ভাগ্নী মিনা হারিস কৃষকদের বিরুদ্ধে হামলা এবং ইন্টারনেট বন্ধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হামলার শিকার হয়েছে। রিহান্নার টুইটের পর ভারতের কৃষকদের আন্দোলন আর্ন্তজাতিক পরিসরে অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কৃষক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেন বারবাডোস-আমেরিকান তারকা রিহান্না। পপ সুপার স্টার আর অভিনেত্রীর পাশপাশি তিনি এখন যেন কৃষক আন্দোলনেরও তারকা।
অপর দিকে রিহান্না এবং গ্রেটা থুনবার্গের টুইট ঘিরে কৃষক আন্দোলন নিয়ে ভারত সরকার জড়িয়ে পড়েছে এক জটিল আবর্তে। ২ ফেব্রুয়ারি রিহান্না ও গ্রেটা থুনবার্গের টুইটের পর দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতি শেষে ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট প্রোপাগান্ডা’, ‘ইন্ডিয়া টুগেদার’ শীর্ষক ট্যাগ যুক্ত করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বিবৃতিতে রিহান্না বা গ্রেটা কারো নাম না নিয়ে সেনসেশনাল সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলিব্রিটি এবং অন্যদের হ্যাশট্যাগ ও মন্তব্যকে অসত্য আর দায়িত্বহীন আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে বলা হয় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল আন্দোলনকারীদের বিপথগামী করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এ স্বার্থান্বেষী মহল ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়েরও চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর টুইট বার্তায় লিখেছেন ভারতকে লক্ষ্য করে উদ্দেশমূলক প্রচারণা সফল হবে না।
বিবৃতিতে কৃষি আইনের পক্ষে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে বলা হয় সামান্য কিছু কৃষক এর বিরুদ্ধে রয়েছে। অথচ ভারতের একটি গণমাধ্যমে এ আন্দোলনকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ভারতের কৃষি আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিদের সমর্থনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন ভারতের অনেক সেলিব্রিটি। রিহান্না ও গ্রেটার টুইটের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে তাকে সমর্থন করে শচিন টেন্ডুলকারসহ অনেকে টুইট করেছেন। এ তালিকায় আরো যুক্ত রয়েছেন, বিরাট কোহলি, রবি শাস্ত্রী, শেখর ধাওয়ান, সুরেশ রায়না, অনিল কুম্বলে, ইরফান পাঠান, রোহিত শর্মা, মনোজ তিওয়ারি, সাবেক টেনিস তারকা সোমদেভ দেবারম্যান এবং হারদিক পান্ডা, মনিকা বাত্রা, পিটি উশা ।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ইন্ডিয়া টুগেদার এবং ইন্ডিয়া এগেনস্ট প্রোপাগান্ডা নামে হ্যাশট্যাগ যুক্ত করেছেন অনেক তারাকা তাদের পোস্টে তা যুক্ত করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হ্যাশট্যাগ যোগ করে শচিন টেন্ডুলকার তার টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ভারতের সার্বভৌমত্বের সাথে কোনো আপোস নেই। বাইরের শক্তি দর্শক হতে পারে কিন্তু অংশগ্রহনকারী নয়। ভারতীয়রা জানেন ভারতকে এবং ভারত বিষয়ে তাদেরই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আসুন জাতি হিসেবে আমরা একতাবদ্ধ থাকি।’
রবি শাস্ত্রী, বিরাট কোহলি, অনিল কুম্বলেসহ অন্যরা একে ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে ভারতই এ সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম আশা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।
বিরাট কোহলি তার টুইট বার্তায় লিখেছেন, আসুন আমরা মতভেদের এ সময় সবাই একতাবদ্ধ থাকি। কৃষকরা আমাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার বিশ্বাস শান্তি বজায় রাখতে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব পক্ষের মধ্যে একটি সুন্দর সমাধান পাওয়া যাবে।
বিরাট কোহলি তার টুইট বার্তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হ্যাশ ট্যাগ ইন্ডিয়া টুগেদার যুক্ত করেছেন।
অনিল কুম্বলে তার টুইট বার্তায় লিখেছেন বিশ্বের সর্ববৃহত গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে ভারত তার অভ্যন্তরীন বিষয়ে উপযুক্ত সমাধান বের করতে সক্ষম। কুম্বলেও তার টুইটে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দুটি ট্যাগ যুক্ত করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দুটি ট্যাগ যুক্ত করে রবি শাস্ত্রী লিখেছেন, ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষকরা দেশের ইকো সিস্টেমর মেরুদন্ড। এটা একটা অভ্যন্তরীন বিষয়। আমার বিষয় এটা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে।
সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি বিজেপি এবং তৃনমুল কংগ্রেসের টানা পড়েনের মধ্যে রয়েছেন। ফলে নিজে টুইট না করলেও সচিন এবং কুম্বলের টুইটকে রিটুইট করেছেন তিনি।
রিহান্না, গ্রেটাসহ বিদেশী সেলিব্রিটিদের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনের বিরুদ্ধে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বিবৃতিকে সমর্থন করে বলিউড যেসব তারকা টুইট করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, করন জোহর, অক্ষয় কুমার, সুনিল শেঠি, অজয় দেবগন, একতা কাপুর, অনুরাগ শ্রীভাস্তব, কৈলাশ খের।
ইন্ডিয়া টুগেদার এবং ইন্ডিয়া এগেনস্ট প্রোপাগান্ডা হ্যাশট্যাগ যুক্ত করে বলি তারাকারা লিখেছেন ভারতের জনগনের উচিত অর্ধ সত্য তথ্যে মনোযোগ না দিয়ে সরকার কৃষক আন্দোলনের সমস্যা সমাধানে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে মনোযোগ দেয়া। বলিউড পরিচিত তারকাদের মধ্যে সবচেয়ে আক্রমনাত্মক ভূমিকা নিয়েছেন কঙ্গনা রানাউত। কঙ্গনা রানাউত আন্দোলনরত কৃষকদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে টুইট করেছেন। তার এ টুইট বাতিল করেছে টুইটার কর্তৃপক্ষ।
প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের কর্মসূচীতে মারা যায় এক কৃষক। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে ভারতের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে পুলিশের গুলিতে এই কৃষক নিহত হয়েছে। পুলিশ দাবি করছে ট্রাক্টর উল্টে মারা গেছে। এ খবর নিয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এফআইআর দায়ের করা হয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায়ও ভারতজুড়ে গণমাধ্যম অঙ্গনে তীব্র প্রতিকৃয়া চলছে।
ভারতের অগণিত কৃষক মাসের পর মাস তাদের ক্ষেত খামার ছেড়ে তাবু টানিয়ে বাস করছেন রাস্তায়। তাদেরকে রাজধানী দিল্লিতে প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্য দিল্লির চারদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছে ভারত সরকার। দিল্লিকে দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। কৃষকদের ঠেকাতে আট স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনীকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের সীমান্তের সাথে তুলনা করেছে।
কৃষক আন্দোলন দমনে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ভয়ভীতির অভিযোগ, মিডিয়া সেন্সরশিপ, ইন্টারনেট বন্ধকরন, সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনার পর রিহান্নাদের সংহতিতে ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে আন্দোলন।
ভারতের চাপে টুইট কর্তৃপক্ষ কৃষক আন্দোলনের সমর্থনকারী ও এর সাথে জড়িত অনেকের টুইট একাউন্ট বাতিল করেছে। এ অবস্থায় রিহান্নার টুইট বারুদে আগুন ধরানোর অবস্থা সৃষ্টি করে। রিহান্নার টুইটকে শুধু কৃষকদের প্রতি সংহতি নয় বরং ইন্টারনেট বন্ধের মত সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কার্যকর প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর থেকে ভারতজুড়ে আন্দোলন করছে কৃষকরা। তারা নতুন কৃষি আইন বাতিল চাচ্ছে। কারন কৃষকদের বিশ্বাস নতুন আইনের ফলে কৃষকদের আয় কমে যাবে। কৃষকরা বড় ব্যবসায়ী এবং করপোরেট সংস্থার কাছে অসহায় হয়ে পড়বে। কৃষি পন্যের বাজারে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের প্রবেশের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। কৃষকদের এই আন্দোলন এখন ভারতের গন্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করছে।