মিয়ানমারে চীন-রাশিয়ার খেলা : ছিটকে পড়ছে ভারত


  • মোতালেব জামালী
  • ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৫৯

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এ অঞ্চলের কৌশলগত রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে দেশটিতে ভারত ও চীনের ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর ভারত প্রথমে নীরব থাকলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সূর মিলিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। অপরদিকে চীনসহ আসিয়ানের দেশগুলো সেনা অভ্যুত্থানের কোনো নিন্দা করেনি।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কঠোর নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনা এবং অং সান সুচি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। ভারতও তাদের বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুর মিলিয়ে মিয়ানমারে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার আহবান জানিয়েছিল।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নয়, বরং চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে যে মৃদু প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, ভারতেরও উচিত ছিল তাদের মতো একই পথ অনুসরণ করা। তাতে ভারতেরই সুবিধা বা লাভ হতো। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণ করতে গিয়ে ভারত যে বিষয়টি ভুলে গেছে তাহলো, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদিতা হচ্ছে বিশ^জনীন বা সার্বজনীন মূল্যবোধ। যার জন্য ভারতকেও জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হতে পারে। ওয়াশিংটনের নব্য রক্ষণশীলদের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করাটা সার্বিকভাবে ভারতের স্বার্থ কোনভাবেই রক্ষা করবে না।

ভারতের বিশ্লেষকদের মতে, ওয়াশিংটন ডিসি’র ক্যাপিটল হিলে গত ৬ জানুয়ারির ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের দাঙ্গার পর যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের তেজি ঘোড়ার পিঠে আরোহনের মর্মার্থই বুঝতে পারেনি ভারত সরকার। ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পর ন্যাটো জোটে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। সেটা সামাল দিতেই যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ইস্যু তুলেছে। এই ইস্যু ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলোকে খুব সহজে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেনা। এবং যুক্তরাষ্ট্র সেই ইস্যুটিই সামনে নিয়ে এসেছে।

ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভালো করে না বুঝেই যুক্তরাষ্ট্র , জাপান ও অষ্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করে বিবৃতি দিয়েছে। অন্য দিকে চীন ও আসিয়ান ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। তারা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি অনুধাবন করেই মিয়ানমারের বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আসিয়ানের রাষ্ট্রদুতদের সাথে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারপর যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান থেকে বিবৃতি দিয়েছে।

মিয়ানমারের বাস্তব পরিস্থিতি খুবই জটিল। চীন বিগত বছরগুলোতে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। দু’পক্ষের মধ্যে অনেক গভীর বিশ^াস ও আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির সাথেও সুচির দলের অনেক ভারো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

চীন সুচি’র যে বিষয়টি নিয়ে খুবই সন্তষ্ট ছিলো তা হচ্ছে তিনি পশ্চিমা বিশে^র সমর্থন চাইলেও দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে আপোষহীন। চীন চায় তার প্রতিবেশি দেশগুলো সব সময়ই এই নীতি অনুসরণ করুক। চীন সুচি’র প্রতি এতোটাই সন্তষ্ট যে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাত বার সুচি’র সাথে বৈঠক করেছেন। চীনের ষ্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই অভ্যুত্থানের আগে গত ১২ জানুয়ারি মিয়ানমার সফরকালে সুচি’র সাথে বৈঠক করে তার সরকারের প্রতি চীনের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, সুচির দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের সাথে কাজ করতে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৈঠককালে তারা চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প এগিয়ে নিতে সম্মত হন। এছাড়াও তারা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর বিআরআই এর আওতায় চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সুচি’র সাথে বেইজিং এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চীনের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। কিন্তু তা সত্বেও চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যাবেনা। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেয়াটা এখন চীনের জন্য একটা দায়িত্বই হয়ে উঠেছে।

চীন মিয়ামারের সেনাবাহিনীর পক্ষে দাড়ানোয় সুচি’র রাজনৈতিক জীবন অনেকটাই জটিলতা ও অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেলো। সুচি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুল করেছেন। এসব ভুলের খেসারত তাকে এখন দিতে হবে। তিনি তার প্রতি অনুগত লোকজনের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের দক্ষতা ও সততা কতটুকু আছে তা তিনি বিবেচনা করে দেখেননি। এছাড়া সরকারের লোকজনের মধ্যে দুর্নীতিও বেড়ে গিয়েছিল। সুচি’র নেতৃত্বের ধরণও ছিল অনেকটা স্বৈরাচারি কায়দার। সমালোচক ও বিরোধীদের দমনে তার সরকার নিবর্তনমূলক আইন করেছিল। তাদেরকে জেলে ঢুকাতেও তিনি দ্বিধা করতেন না।

মিয়ানমারের অর্থনীতির বেশ কিছু ক্ষেত্রে সুচির কোন নিয়ন্ত্রন ছিলনা। বিশেষ করে মিয়ানমার ইকোনোমিক হোল্ডিংস লিমিটেড, মিয়ানমার ইকোনোমি কর্পোরেশন এবং বেশকিছু বেসরকারি কোম্পানীর উপর তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিলনা। এসব প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানী ছিল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সরকারে নিয়ন্ত্রনের বাইরে থেকে এগুরো স্বাধীনভাবে কাজ করতো।

সুচি’র সবচেয়ে বড় ভুল ছিল রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে সেনাবাহিনীর পাশে দাড়ানো। তার ধারণা জন্মেছিল যে, তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনা দিয়ে সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ খারিজ করে দিতে সক্ষম হবেন। এ কাজটি করতে গিয়ে তিনি পশ্চিমা বিশে^র সমর্থন হারান। এরপর থেকে সুচি’র বিশ^ ছোট হয়ে আসে এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পথ আরো সহজ হয়ে উঠে।

সেনাবাহিনী এটা আন্দাজ করে নিয়েছিল যে, তারা ক্ষমতা দখলের পর পশ্চিমা বিশ^ সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কি ধরণের এবং কতটুকু প্রতিক্রিয়া হবে। তারা স্পষ্ট ভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহনের শুরুতে তাদের অভ্যন্তরীন সমস্য মোকাবেলা করতেই ব্যস্ত থাকবে। মিয়ানমার ইস্যু বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির তালিকার শীর্ষ দশে যে থাকবেনা তা মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা ভালোভাবেই জানতেন। সেই সুযোগটাই তারা নিয়েছেন।

তবে মার্কিন কংগ্রেস কোনভাবেই সামরিক অভ্যুত্থান মেনে নেবেনা। মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপ, সাহায্য কমিয়ে দেয়া, জেনারেল ও তাদের কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনে বাইডেন প্রশাসনের উপর চাপ দেবে। কিন্তু এর ফলে যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছেড়ে দেবে সে প্রত্যাশা না করাই ভাল। বরং মিয়ানমারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের যে সামান্য নিয়ন্ত্রণ ছিল সেটাও থাকবে না।

যুক্তরাষ্ট্র এখন কোনপথে হাটে সেটাই দেখার বিষয়। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিল রিচার্ডসন পরামর্শ দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এখন উচিত সুচিকে বাদ দিয়ে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নতুন মুখ খোজা। এমন নেতৃত্ব বের করতে হবে যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব পোষণ করবে।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যে, পশ্চিমা সংস্থাগুলো বিক্ষোভ করার জন্য মিয়ানমারের যুবকদের প্রতি আহবান জানাচ্ছে। ঠিক যেভাবে হংকং ও থাইল্যান্ডে বিক্ষোভ দারা বেধেছিল। বিক্ষোভকারিরা যাতে সংগঠিত হতে না পরে সেজন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকার ফেসবুক ও ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করেছে। ভূ রাজনীতির অন্য খেলোয়াড়রাও বসে নেই।

মিয়ানমারের বিষয়ে রাশিয়ার ভূমিকার প্রতিও নজর দেয়া প্রয়োজন। মিয়ানমারের উপর প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে পরাশক্তি গুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশে এক ধরণের লড়াই চলছে। ২০১৫ সালে রাশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরের পর শুধু মিয়ানমারে নয়, ভারত মহাসাগরেও রাশিয়ার উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। রাশিয়া মিয়ানমারের বড় সামরিক অংশিদারে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে রাশিয়ার একটি সার্ভিসিং সেন্টার রয়েছে। গত মাসে রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোমিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, মিয়ানমার এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ধারণা করা হচ্ছে , রাশিয়া মিয়ানমারে যে কোন আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীকে সহায়তা দেবে। তারা মিয়ানমারের সাথে নিয়মিত তথ্য বিনিময় করছে। মিয়ানমারের প্রায় ৬০০ সেনা কর্মকর্তা রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং অন্তত ৬ বার রাশিয়া সফর করেছেন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সার্গেই শোগিন মিয়ানমার সফরকালে সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেছেন, মিয়ানমারের যে কোন কঠিন সময়ে রাশিয়া আমাদের পাশে দাড়িয়েছে, সমর্থন দিয়েছে। এই সফরকালে মিয়ানমারে রাশিয়ার সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।

এখন এটা স্পষ্ট হয় উঠছে যে, মিয়ানমারে পশ্চিমা বিশে^র প্রভাব চীন ও রাশিয়া রাখতে চাইছেনা। চীনের মতো রাশিয়াও মনে করে যে, পশ্চিমা বিশ^ আঞ্চলিক নিরাপত্তায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ বিষয়টি মাথায় রেখে দিল্লির মিয়ানমার ইস্যুটি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। কিন্তু ভারত এখন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে পশ্চিমা বিশ্বের কৌশল বাস্তবায়ন করবে না চীন ও রাশিয়ার সাথে সমন্বয় করে চলবে।