জো বাইডেনের নেতৃত্বে নতুন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর হোয়াইট হাউসের স্টাফ হিসেবে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ২০ জনই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। এ নিয়ে ইসরাইলের একটি থিংকট্যাংক দাবি করছে যে, মার্কিন প্রশাসনে ভারতীয় নাগরিকদের আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যে ইহুদিদের ভূমিকা রয়েছে। ইসরাইলি থিংকট্যাংকটি আরও দাবি করে, ইহুদিদের সাথে আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকদের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অনেকটা বেড়েছে এবং এক্ষেত্রে মার্কিন ইহুদি বলয়গুলো ব্যাপক সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
হোয়াইট হাউসের ১৭ জন স্টাফের বাইরে আরও তিনজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিককে প্রশাসনের অন্যত্র গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ড. বিবেক মূর্তিকে ইউএস সার্জন জেনারেল, ভানিতা গুপ্তাকে অ্যাটর্নি জেনারেল ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের অ্যাসোসিয়েট হিসেবে এবং উজরা জিয়াকে বেসামরিক নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস তো রয়েছেনই। কমলা অবশ্য নিজেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলার চেয়ে ব্ল্যাক আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ, তার মা ছিলেন তামিল ভারতীয় একজন নাগরিক।
মার্কিন প্রশাসনের এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে হঠাৎ করে ভারতীয় বংশোদ্ভুত নাগরিকদের এভাবে উঠে আসার নেপথ্যে ইসরাইলের সাথে ভারতের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে জিউয়িশ পিপল পলিসি ইন্সটিটিউট বা জেপিপিআই জানিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ইসরাইলের একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পেশাদার নীতি নির্ধারনী থিংক ট্যাংক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র এবং সকল বিভাগে যেভাবে ইহুদি জনগোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তার করে আসছে, ভারত ক্রমশ সেই স্থানটি নিতে চায়। আর এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদিরা তাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করছে। বিগত দুই যুগে মার্কিন ইহুদি গ্রুপগুলো ইহুদি জনগোষ্ঠী এবং ভারতীয় বংশোদ্ভুত নেতৃবৃন্দের মাঝে শক্তিশালী রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
জেপিপিআই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকেরা মার্কিন ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক ও অন্যান্য কর্মকান্ডকে ইতিবাচক হিসেবে মুল্যায়ন করে। অনেকক্ষেত্রে ইহুদি এসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে ভারতীয়রা নিজেদের জন্য অনুসরনীয় মডেল ও অংশীদার হিসেবেও বিবেচনা করে। ফলে ইহুদি সংস্থাগুলোও বেশ জোরের সাথেই ভারতের পাশে দাঁড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অনেকক্ষেত্রে তারা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কৌশলী সহায়তা প্রদান করেও এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
কংগ্রেসনাল ইন্ডিয়া ককাশ এখন কংগ্রেসের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক জোট। অন্যদিকে ইউএস ইন্ডিয়া পলিটিকাল এ্যাকশন কমিটি বা ইউসিনপ্যাক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের প্রথম এবং শীর্ষস্থানীয় লবিং গ্রুপ। কংগ্রেসনাল ইন্ডিয়া ককাশ এবং ইউসিনপ্যাকের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে আমেরিকান জিউয়িশ কমিটি এবং আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক এফেয়ার্স কমিটি তথা আইপ্যাকের দায়িত্বশীল ভূমিকা রয়েছে। একইসঙ্গে এই ইহুদি সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একটি হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন গঠনেও কার্যকর অবদান রেখেছে।
ইউসিনপ্যাক তার লবিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আইপ্যাকের নীতি ও কৌশলগুলোকেই অনুসরণ করে থাকে। প্রখ্যাত লবিস্ট জন নিউহাউস মনে করেন, আমেরিকান ইহুদিরা যেভাবে নিজেদের মাতৃভূমির জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখছে, ভারতীয়-আমেরিকানরাও একই মানসিকতা নিয়ে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের মার্কিন ভিত্তিক লবি হলো ওয়াশিংটনে কর্মরত একমাত্র লবি যা খুব শীঘ্রই ইসরাইলী লবির মতো পারদর্শিতা অর্জন করতে যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক ইহুদি ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী লোকজন এসব লবিস্ট গ্রুপকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকে। মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইহুদি ও ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যা এখন সর্বোচ্চ এবং অথনৈতিকভাবেও তারা বেশ শক্তিশালী।
সিলিকন ভ্যালিতে যতগুলো প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কাজ করছে তার মধ্যে ২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিকই ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক। অন্যদিকে, ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের আওতায় ২শটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারাই যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট এলিট শ্রেনীর বড়ো একটি অংশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। এই পুরো বিজনেস কাউন্সিলটাই ভারতীয় লবিস্ট ফার্মগুলোকে আর্থিক প্রণোদনার জোগান দিচ্ছে।
ইহুদি আমেরিকানদের মতো ভারতীয় আমেরিকানরাও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং তারা নিজেদের এজেন্ডার বিষয়ে খুবই সচেতন এবং যেকোনো মূল্যে নিজেদের পক্ষে ফলাফল নিয়ে আসার জন্যেও তারা বদ্ধপরিকর।
মার্কিন প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্যক্তিদের এমন জয়জয়কারের পেছনে আরেকটি বড়ো কারণ হলো ওয়াশিংটনের নীতি নির্ধারকদের সাথে তাদের সখ্যতা। যে সকল ভারতীয় নাগরিকেরা কয়েক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসতি গড়েছিলেন আজ তাদের সন্তানেরাই ক্যাপিটল হিলে অসংখ্য সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সান্নিধ্যে ইন্টার্ন বা স্টাফ মেম্বার হিসেবে কাজ করছে।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিভেশ কাপুর মনে করেন, গোটা ক্যাপিটল হিলই ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় নাগরিকদের আধিপত্য এখন সর্বত্র। বিশেষত, শিক্ষা, মিডিয়া এবং প্রভাবশালী অন্যন্য সেক্টরেও ভারতীয়দের রাজত্ব এখন চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে, ওয়াশিংটন স্টেটের কংগ্রেসম্যান প্রমিলা জয়পালও স্বীকার করেন যে, ওয়াশিংটনে অনেক সিনেটর ও রিপ্রেসেন্টিটিভদের সাথে সহকারী হিসেবে বর্তমানে ভারতীয় আমেরিকান নাগরিকেরা বেশ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
ধারণা করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বৈধভাবেই ৩২ লাখ ভারতীয় নাগরিক বসবাস করছে যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ। এই ভারতীয় নাগরিকেরা শিক্ষিত এবং তাদের উপার্জনের মাত্রাও অন্যন্য যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি। ভারতীয় যেসব নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নাগরিকের কলেজ ডিগ্রি রয়েছে।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চীন, জাপান, কোরিয়া বা ফিলিপাইনের নাগরিকদের মাঝে এত সংখ্যক ডিগ্রীধারী ব্যক্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে যত ইহুদি বসবাস করে তাদের ৬০ শতাংশ গ্রাজুয়েট শেষ করেছে। অর্থাৎ ইহুদিরা শিক্ষাখাতে অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও ভারতীয়দের তুলনায় পিছিয়েই রয়েছে। ভারতীয়রা শিক্ষাখাতে এগিয়ে থাকায় তাদের পারিবারিক পরিসরে উপার্জনও বেশি। মাঝারি আয়ের ভারতীয় নাগরিকদের পারিবারিক উপার্জন এখন গড়ে ৮৮ হাজার ডলার, যা এশিয়ার অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক বেশি। সাধারণভাবে মার্কিন নাগরিকদের গড় আয় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিকদের আয় প্রবাসী নাগরিক তো বটেই এমনকী গড়পড়তার মার্কিন নাগরিকদের তুলনায়ও অনেক বেশি।
যদিও ভারতীয়রা মার্কিন মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ, কিন্তু উচ্চমানের পেশাগুলোতে ভারতীয়দের আধিপত্যই বেশি। দেশটির মোট প্রকৌশলীর ৩ শতাংশ ভারতীয়, আইটি সেক্টরে কর্মরতদের মধ্যে ৭ শতাংশ ভারতীয় আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ডাক্তারদের মধ্যে শতকরা ৮ জনই ভারতীয় বংশোদ্ভুত।
সিলিকন ভ্যালিতে ভারতীয়দের সফলতা চোখে পড়ার মতো। বিগত দুই দশকে, সিলিকন ভ্যালিতে ভারতীয় অভিবাসীদের বিনিয়োগ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল অবধি ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমান ছিল ২৫ শতাংশ। কিন্তু ২০১২ সালে এসে এ বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশ। অথচ একই সময়ে চীনা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমান ১২দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে ৫দশমিক ৪ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে শুধু চীন নয়, বরং সকল দেশের অভিবাসীদের মধ্যে সিলিকন ভ্যালিতে বিনিয়োগের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে।
মার্কিন ইহুদিদের মতো ভারতীয় আমেরিকানরাও এখন মার্কিন রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করছে। ডোনার, ভোটার বা প্রার্থী- সকল রূপেই ভারতীয় বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিকদের দেখা মিলছে। ১৮ শতকে চীন থেকে নাগরিকদের মার্কিন নাগরিকদের প্রবেশ সীমিত করার পর থেকেই ভারত এর ষোলআনা সুযোগকে কাজে লাগায়। যুক্তরাষ্ট্রও তখন ভারতের ওপর নির্ভর করেছিল কেননা তারা চীনের তুলনায় ভারত থেকে কম মজুরিতে শ্রমিক পাচ্ছিলো। বিশেষ করে, পাঞ্জাব থেকে সে সময়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিল।
ভারতের মধ্যে পাঞ্জাবের লোকেরাই মার্কিন মাটিতে প্রথম পা ফেলে। তবে, এসব পাঞ্জাবি নাগরিকদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত এবং শ্রমিক ধরনের। ১৯৪৬ সাল অবধি এই নাগরিকদের এবং তাদের সন্তানদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে গুজরাটি ব্যবসায়ীরাও যুক্তরাষ্টে ্র প্রবেশ করতে শুরু করে।
৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র আর সাবেক সেভিয়েতের মধ্যে কোল্ড ওয়ার চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদেরকে উদার ও গনতন্ত্রের পতাকাবাহী হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে, ১৯৬৫ সালে দেশটির অভিবাসন আইনটিকে উম্মুক্ত করা হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র পেশাদার ও দক্ষ লোকদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের সুযোগ দেয়া হয়। ভারত তখন থেকেই সুযোগটিকে লুফে নেয়।
ইতিহাসবিদ বিজয় প্রসাদের তথ্যনুযায়ী, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের অসংখ্য মেধাবী ও সম্ভাবনাময় তরুন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। সে সময়ে আনুমানিক ২০ হাজার বিজ্ঞানী, ৪০ হাজার প্রকৌশলী এবং ২৫ হাজার ভারতীয় ডাক্তার আমেরিকায় চলে যায়। তারা সকলেই ছিল শিক্ষিত এবং ইংরেজিতে পারদর্শী।
আর তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে বর্তমানে ৩২ লাখ ভারতীয় নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে, নিজেদের অবস্থান সংহত করছে। আজকের সময়ে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেই শুধু নয়, দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদেও এমন একজন চলে এসেছে যিনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক। হতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ভারতীয় বংশোদ্ভুত কাউকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদেও দেখা যাবে।