কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে চরম মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে চাকরির বাজারে। আর্থিক মন্দার কারণে ২০২০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর চাকরির বাজারে কোভিড-১৯ মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপসাগরীয় দেশগুলোতে আনুমানিক ১৫ কোটি ৪০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করেন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে শুধুমাত্র সৌদি আরব থেকেই ২ লাখ ৫৭ হাজার প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে তাদের দেশে ফিরে গেছেন।
চলতি বছর আরও এক কোটি ২০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবেন বলে সৌদি আরবের পরিসংখ্যান বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ওমানের জাতীয় পরিসংখ্যান কেন্দ্রের হিসাবে দেখানো হয়েছে, দেশটি থেকে শুধুমাত্র গত বছর জুলাই মাসেই ৪৫ হাজার প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে গেছেন।
কুয়েতের দৈনিক আল কাবাস পত্রিকায় জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শেষ তিন মাসে দেশটি থেকে ৮৩ হাজার ৫০০ বিদেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়ে তাদের দেশে ফিরে গেছে। করোনা ভাইরাস আঘাত হানার পর কুয়েতের সরকারি খাতে কর্মরত হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিককে ছাটাই করা শুরু হয়।
অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনেও বিদেশি শ্রমিকদেরকে ব্যাপক হারে ছাটাই করা হয়েছে। সেখানে বহু দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গেছে, অফিসগুলোও খালি হয়ে গেছে। আরব আমিরাতে ২০২০ সালে জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ৯ শতাংশ। গত এক বছরে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি ভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে আমিরাতের অর্থনীতিই কোভিড-১৯ এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও অন্য দেশগুলোর অর্থনীতির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তার ঘটার পর উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে বড় ধরণের সংকট তৈরি হয়। তাদেরকে রাখা হবে নাকি বিদায় করে দেয়া হবে তা নিয়ে এসব দেশের সরকারগুলো একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায়। কাতারের জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয়ের স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের গবেষণা বিষয়ক সহযোগি পরিচালক জাহরা বাবর বলেন, কোভিড-১৯ আঘাত হানার পর এসব শ্রমিকের বেতন কমানো হয়েছে, আবার মাসের পর মাস বেতনও দেয়া হয়নি। কিন্তু চাকরি হারানোর পর দেশে ফিরে গিয়ে তারা কিভাবে দীর্ঘমেয়াদে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করবেন তা নিয়েই সবাই শংকিত। কারণ দেশে গিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন হয়ে দাড়াবে তাদের জন্য।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে একসময় জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। তখন এসব দেশ বিদেশি শ্রমিক আমদানী করতো। বিশেষ করে নির্মান, স্বাস্থ্য, গৃহকর্ম, আতিথেয়তাসহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর শ্রমিক আমদানি করা হতো। তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে অর্জিত অর্থ থেকে এসব শ্রমিকের বেতন দেয়া হতো।
তেল ও গ্যাস রপ্তানীর মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করায় অল্প কয়েক দশকেই উপসাগরীয় দেশগুলো অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। এর ফলে এসব দেশে বিদেশি শ্রমিকদের সংখ্যাও হু হু করে বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাতারে মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৮৩ শতাংশ ও কুয়েতে ৭০ শতাংশই ছিল বিদেশি শ্রমিক। কেবলমাত্র সৌদি আরব ও ওমানে বিদেশি শ্রমিকদের তুলনায় স্থানীয়দের সংখ্যা ছিল বেশি। এই সংখ্যা সৌদি আরবে ছিল ৭০ শতাংশ এবং ওমানে ছিল ৬০ শতাংশ।
বিদেশি শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উপসাগরীয় দেশগুলোর শহুরে জীবন যাত্রায় বিশেষ করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপটে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় জনগন ও বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। এসব দেশের সরকারগুলোও বিদেশি বিনিয়োগ ও ভোক্তা আকর্ষণে তৎপর হয়ে উঠে।
ব্রুকিংস দোহা সেন্টারের গবেষণা পরিচালক নাদের কাব্বানি বলেন, ‘আপনি যদি অতিরিক্ত অফিস, আবাসিক এলাকা ও খুচরা কেনা-বেচার অধিক জায়গা তৈরি করেন, তাহলে সেগুলো পূরণ করার লোকজনও তো লাগবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কাদেরকে দিয়ে এসব শুন্যস্থান পূরণ করবেন? এর নিশ্চিত উত্তর হচ্ছে -বিদেশি শ্রমিক।’
কোভিড-১৯ মহামারির কারনে উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। বিশ্বে জ্বালানীর চাহিদা কমে গেছে। কমছে তেল ও গ্যাসের দাম। এর বিরুপ প্রভাবে অফিস-আদালত, শপিংমল ও অ্যাপার্টমেন্ট গুলো এখন ফাকা পড়ে আছে। আর একই সঙ্গে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘সামাজিক চুক্তি’ও ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে উঠছে বলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বিদেশি শ্রমিকদের ওপর।
কাতারের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের গবেষণা বিষয়ক সহযোগি পরিচালক জাহরা বাবরের মতে, উপসাগরীয় এসব দেশের স্থানীয় অধিবাসীরা কর্মসংস্থান, গৃহায়ন, শিক্ষা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা লাভ করে গড়ে উঠেছে। এতদিন এসব কিছুই তারা সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমানে পেয়ে আসছে। কিন্তু এখন সামাজিক চুক্তিতে টানাপোড়েন বা একটা সংকট তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সরকার ও নাগরিকদের মধ্যেও আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।
ব্রুকিংস দোহা সেন্টারের গবেষণা পরিচালক নাদের কাব্বানিও মনে করেন, এখন নাগরিকরা তাদের শাসকদের বলতে পারে যে, তোমরা আমাদেরকে এই এই সুযোগ সুবিধা দিতে চেয়েছ, কিন্তু এখন আমরা তা পাচ্ছিনা। এর ফলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। একটা সময়ে গিয়ে তারা এই পরিস্থিতির জন্য বিদেশি শ্রমিকদের দোষারোপ করতে পারে।
উপসাগরীয দেশগুলোর মধ্যে এধরণের ঘটনার একটি বড় প্রমান হতে পারে কুয়েত। এ দেশটি এই অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি উন্মুক্ত। নিয়মিত পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। এছাড়া দেশটিতে রয়েছে শক্তিশালী গণমাধ্যম। কানাডিয়ান বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও কুয়েত সিটি ভিত্তিক উদ্যোক্তা জিওফ্রে মার্টিন মনে করেন, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে সামাজিক সংকট বা অস্থিরতা যে প্রকট হয়ে উঠছে প্রমান পাওয়া যাচ্ছে কুয়েতে। কেননা এ দেশটিতে অনেক বেশি বাক স্বাধীনতা থাকায় মানুষ তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে জানাতে পারছে। দেশটির নাগরিকরা এখন প্রকাশ্যেই বিদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করছেন যা করোনা মহামারির আতঙ্ককেও ছাপিয়ে উঠেছে।
গত বছরের মার্চ মাসে যখন কোভিড-১৯ মহামারির সুত্রপাত হয় তখন কুয়েতের সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য সাফা আল হাশেম প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ আমাদেরকে সমাজকে বিদেশি শ্রমিক মুক্ত করার সুযোগ এনে দিয়েছে।’ এরপর গত বছর আগষ্ট মাসে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কুয়েতের শতকরা ৬৫ শতাংশ নাগরিক দেশটিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য বিদেশি শ্রমিকদের দায়ী করেছেন। মাহবোলাসহ কুয়েত সিটির যেসব জেলায় বিদেশ শ্রমিক বেশি সেসব জেলা সরকার লকডাউন করে রাখলেও এসব শ্রমিকের বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর এই অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
লকডাউনের কারণে কুয়েতে অবস্থানরত এসব শ্রমিক একদিকে যেমন তাদের কর্মস্থলে যেতে পারছেনা অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা জালের মধ্যেও তাদেরকে রাখা হচ্ছেনা। জিওফ্রে মার্টিন জানান, অবরুদ্ধ এসব এলাকায় খাদ্য সামগ্রী বিতরণের সমবায়ভিত্তিক কোন দোকান-পাটও নেই। তিনি নিজের উদ্যোগে এসব শ্রমিকের মধ্যে জরুরি খাদ্য সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করেন।
বর্তমান পরিস্থিতর মধ্যেই কুয়েত সরকার বিদেশি শ্রমিকদের জন্য ২০২০ সালে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পার্লামেন্টে একটি বিল পাশ করেছে। নয়াদিল্লিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আঞ্চলিক ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ সাবরিনাথ নাইর জানান, কুয়েতে ভারতের প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক আছে। যদি বিদেশি শ্রমিকদের কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তাহলে ভারতের এই ১০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮ লাখকেই দেশে ফিরে আসতে হবে।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। দেশটির প্রায় এক কেটি ৮০ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছে। ২০১৯ সালে রেমিটেন্স থেকে ভারতের আয় হয়েছিল ৮২ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ ভারতের মোট জিডিপির ২-৩ শতাংশ। অন্যদিকে নেপালের জিডিপির ২৮ শতাংশই আসে রেমিটেন্স থেকে। এই রেমিটেন্স আস বন্ধ হয়ে গেলে সব দেশই অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা শুধু উপসাগরীয় বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক বৈরি পরিস্থিতির কবলে পড়েছেন। তারা একদিকে কর্মস্থলে যেতে পারছেন না, অন্যদিকে তাদের বাসায় পর্যাপ্ত পরিমানে খাদ্য সাগ্রীও নেই। ফলে তাদেরকে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে।