বাইডেন প্রশাসনের কাছে ভারতের গুরুত্ব

-

  • মেহেদী হাসান
  • ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:২২

ট্রাম্প শাসনামলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক চরম তিক্ত আকার ধারণ করে। এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প সরাসরি অভিযোগ করতেন, ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করলে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে চীনে পরিণত করবে। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে বলা হতো, যদি ট্রাম্প জয়লাভ করে তবে বলা হবে, এর পেছনে রাশিয়ার হাত ছিল। আর যদি বাইডেন জয় লাভ করে তাহলে বলা হবে, এর পেছনে চীনের হাত রয়েছে। বাইডেনের জয়ের পর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পকের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে ভারতের সঙ্গে দেশটির সর্ম্পক কোন মাত্রায় পৌঁছাবে।

অনেকে আশাবাদী, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের তীব্র বিরোধ বাইডেন আমলে কমে আসতে পারে। আর চীন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উন্নতি অবনতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট-ভারত সম্পর্কের ব্যারোমিটার। কারণ, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনিত মানে এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়া।

এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার আর মিত্র রাষ্ট্র ভারত। অনেকের মতে, নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জয়লাভের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব অনেক কমে যাবে। কারণ, চীন বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আর বাইডেন প্রশাসনের নীতি এক হবে না। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব কমছে না।

এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলের গুরুত্ব এবং এ অঞ্চল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ও নীতি এর প্রধান কারণ। এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চল বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন আগের মতই গুরুত্ব ও কৌশল অব্যাহত রেখেছে। আর সে কারণে ভারতকে তার পাশে রাখা অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন দায়িত্ব গ্রহনের তিন দিনের মাথায় এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের সব মিত্র ও বন্ধু দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং এ অঞ্চল নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন।

অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেন অস্টিন ইতোমধ্যে অগ্রাধিকার তালিকায় প্রথমে স্থান দিয়েছেন চীনকে। এ ছাড়া ইউরোপের মিত্রদের সঙ্গেও আলোচনার এজেন্ডায় রয়েছে চীনের নাম।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন দায়িত্ব লাভের তিন দিনের মাথায় ফোনে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে। ফোনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে ভারতের ভূমিকা এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের একত্রে কাজ করার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেন। ২৯ জানুয়ারি দুই মন্ত্রীর ফোনালাপ বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। একই দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কথা বলেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশীর সঙ্গে।

এন্টনি ব্লিনকেন ভারত ও পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার আগে বাইডেন প্রশাসন আরো দুটি উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে। বাইডেন প্রশসানের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান ২২ জানুয়ারি কাবুলে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর ২৮ জানুয়ারি এন্টনি ব্লিনকেন কথা বলেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গে।

২৭ জানুয়ারি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্ট অজিত দোভাল কথা বলেন, জেক সুলিভানের সঙ্গে। একই দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিন ফোন করেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে।

এসব ফোনলাপ থেকে এটি পরিষ্কার যে, বাইডেন প্রশাসন এ অঞ্চলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং এর কেন্দ্রে রয়েছে ভারত। কংগ্রেস অর্থায়নে ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিস এর অনলাইন আলোচনায় ২৯ জানুয়ারি জেক সুলিভান বলেন, নতুন প্রশাসনের কছে সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো চীন, আফগানিস্তান এবং ইরান। আর যে কোনোভাবেই হোক ভারত হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডার।

সুলিভান বলেন, ইরান পরমানু অস্ত্র নির্মানের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ফিসাইল ম্যাটেরিয়াল অর্জনের জন্য কাছ থেকে কাছে চলে আসছে। আমাদের প্রথম দিককার জটিল একটি অগ্রাধিকার হলো ইরানের সঙ্গে পরমানু অস্ত্র বিষয়ে একটি সমাধানে পৌছানো।

আফগানিস্তান বিষয়ে সুলিভান বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি দোহা চুক্তিতে তিনটি শর্ত ছিল। সেগুলো হলো সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তালেনবানদের সম্পর্ক বন্ধ করতে হবে। সন্ত্রাস বন্ধ করে যুদ্ধ বিরতি কার্যকরে সহযোগিতা করতে হবে । আর তৃতীয়টি হলো প্রকৃত অর্থেই আফগান সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় অংশ নিতে হবে। আমরা এখন যেটা করছি তা হলো তালেবানরা এ তিনটি শর্ত মানছে কি না তা কঠোরভাবে নজরদারি করা। আর এর ভিত্তিতে আফগানিস্তানে আমাদের সৈন্যদের উপস্থিতি এবং কূটনীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে চায় এবং এ জন্য তারা দায়ভার চাপাতে চায় তালেবানদের ওপর। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের ‘আফগান স্টাডি গ্রুপ’ এক প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। ভারতও চায় না আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করুক। কিন্তু এ নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

আফগানিস্তান থেকে আগামী মে মাসের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা না হলে ‘ভয়াবহ যুদ্ধের’ হুমকি দিয়েছে তালেবান। সম্প্রতি ওয়াশিংটনকে এই গোষ্টী হুমকি দিয়ে বলেছে, তাদের সঙ্গে মার্কিন সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার করা না হলে ‘ভয়াবহ যুদ্ধ’ এবং ‘সংঘর্ষের ভয়ঙ্কর বিস্তার’ ঘটবে।

চীন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুলিভান তার পূর্বসুরীদের মতই বলেছেন, মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের কথা। তবে সুলিভান নতুন একটি তথ্য প্রকাশ করেছেন। তা হলো ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে যেসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার তালিকায় রেখেছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন ইস্যু। চীনের বিরুদ্ধে বানিজ্য আর প্রযুক্তি অপব্যবহার ইস্যুতে ইউরোপকে সঙ্গে নিয়ে আগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

এটা এমন এক জটিল পটভূমির বিরুদ্ধে যা এন্টনি ব্লিনকেন বলেছেন জয়শঙ্করকে। এই আলোচনাতেও চীনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশল বিষয়ে পূর্বের সরকারের নীতি কতটা অগ্রাধিকার পাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর জাপান মিলে কুয়াদ বিষয়ক যে আলোচনা ট্রাম্প প্রশাসন শুরু করেছেন তার শেষ পরিনতি কী হবে তাও দেখার বিষয়।

এন্টনি ও জয়শঙ্করের ফোনালাপ বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী কৌশলগত অংশীদারিত্ব যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, আর পিপল টু পিপল যোগাযোগকে এর ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে দুই মন্ত্রী শান্তি, নিরাপত্তা বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের বিষয়ে একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলার আগে এন্টনি এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশলে ভারতকে তার পাশে রাখতে চাইবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সর্ম্পক একটি সীমার মধ্যে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররা চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধে নিজেদের জড়ানোর বিষয়ে অনাগ্রহী। এন্টি চায়না ব্লক এর ধারণা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল।

বাইডেন প্রশাসন তার ইউরোপীয় মিত্রদের অবস্থানকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিবেন। ট্রাম্প যেভাবে ইউরোপকে উপেক্ষার নীতি নিয়েছিলেন সে পথে কখনই হাটবেন না বাইডেন। ইউরোপ চীনের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সংঘাতের বিরুদ্ধে। ফলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ অনেকটা কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভারতের জন্য আরেকটি সঙ্কট হচ্ছে দেশটিতে গনতান্ত্রিক প্রতিষ্টানগুলো দূর্বল হয়ে পড়ছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসন সঙ্কুচিত হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদি রাজনীতিকে ধারণ করে একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মোদি। বাইডেন প্রশাসন শুধু মোদির মতো অন্য শাসকদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা ভারতের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে।

ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের উত্থান অপ্রতিরোধ্য। চীনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যার ঘটনাকে ভারত দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আলাদা ঘটনা হিসেবে ম্যানেজ করতে পেরেছে। এখন ভারতকেও চীনের সঙ্গে বিরোধ কমিয়ে আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যদি উন্নতির দিকে অগ্রসর হয় তবু তা ভারতের আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই।