সেই মিসর এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:২৬

এক দশক আগে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর মিসরে আবার অগ্রগতি ঘটবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে মিসর এখন শাসন করছে মোবারকের চেয়েও বড় এক স্বৈরাচার। আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির শাসনে মিসর কোথায় চলেছে, আলজাজিরায় এক নিবন্ধে তারই বিস্তারিত তুলে ধরেছেন খ্যাতিমান সাংবাদিক ও লেখক খালেদ দিয়াব।

এক দশকের ঝঞ্জাময় বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের পর মিসর দৃশ্যত ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে বর্বর সামরিক স্বৈরশাসকের খাদে পড়েছে। এই অসম সংঘাতে মিসরের জনগণ সেইসব লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যারা আইনের ঊর্ধ্বে। এতে আইনের ঊর্ধের লোকেরাই জয়ী হচ্ছেন। যারা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তাদের ভাগ্যে জুটেছে হুমকিÑধামকি, নিপীড়ন, কারাবাস, সমাজচ্যুত ও গুমের শিকার হওয়া এমনকি নির্বাসন।

ফলে মানুষের মধ্যে এই ধারণাই দৃশ্যত বদ্ধমূল হয়েছে যে বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। অনেকে তো আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে তাদের দুর্দশা এবং দেশের অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য বিপ্লবীদেরকেই দায়ী করছেন। তবে তাদের এই দৃষ্টিভংগী ভুল অথবা সংকীর্ণ।

এটা সত্য যে ২০১১ সালে মিসরের বিপ্লবের আশু লক্ষ্য ছিল স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উৎখাত করা। সেটা অর্জিত হয়েছিল। তবে বিপ্লবীরা সরকার পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়, ব্যবস্থার পরিবর্তন তো দূর-অস্ত। মোবারকের পতনের পর সেনারাই দেশটি শাসন করেন।

আসলে মিসরের বিপ্লবই শুধু ব্যর্থ হয়নি, মিসর রাষ্ট্রটিই ব্যর্থ হয়েছে। বিপ্লবের আগে থেকেই কয়েক দশক ধরেই মিসর ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছিল। অথচ এক সময় মিসর ছিল আঞ্চলিক হেভিওয়েট এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম গতিশীল, উন্নত ও আধুনিক সমাজ।

তার পরের দুর্ভোগ থেকে মিসরকে রক্ষার জন্য ২০১১ সালের বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। বরং এটা ছিল মিসরকে রক্ষায় শেষ মরিয়া চেষ্টা। এটা আরও ছিল নাগরিকরে রুটিরুজি, স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য চূড়ান্ত আশাবাদী আবেদন। মিসর যে মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই বিদ্যমান। বলতে গেলে কোনো রাষ্ট্রই সুশাসনের টেকসই মডেল অনুসরণ করছে না।

এমনকি যেসব উপসাগরীয় দেশে তেমন বিক্ষোভ হয়নি সেখানেও বর্বর শাসন ও বিপুল সম্পদের মাধ্যমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়েছে। তবে উপসাগরীয় দেশগুলো জন অসন্তোষ, অসমতা ও বিচ্ছিনতাবোধে আক্রান্ত অভিবাসী নামের সক্রিয় টাইমবোমার ওপর বসে আছে।

২০১১ সালে বৃদ্ধ হোসনি মোবারকের পঞ্চম মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে ছিল । সেটা ছিল মিসর সরকারের জন্য একটি বিপজ্জনক বছর। তিউনিসিয়ায় তার আগে বিপ্লব না হলেও মিসরে সেটা ঘটতই। কারণ দেশটি ছিল ব্যর্থ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু সরকার তা অস্বীকার করছিল এবং ক্ষমতায় আকড়ে থাকতে ছিল বদ্ধপরিকর। তবে কিভাবে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো গেমপ্ল্যান তাদের ছিল না। ২০১১ সালে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মিসরীয়রা। কিন্তু ভয়ানক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কাও ছিল।

মিসর রাষ্ট্রটা রাজনৈতিকভাবে স্থবির হয়ে পড়েছিল। দুর্নীতি মহামারিতে পর্যুদস্ত ছিল দেশটি। অযোগ্য নেতৃত্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক দুর্বৃৃত্তায়ণ গ্রাস করেছিল দেশটিকে। এ অবস্থার মধ্যেই বিশাল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় ২০০৮ সালে মিসরের প্রশংসা করে বিশ^ব্যাংক একে ‘সেরা সংস্কারক’ বলে আখ্যায়িত করে। আসলে তা ছিল বিভ্রান্তিকর ও মরীচিকা।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অলিগার্কদের মত মিসরীয় ধনকুবেররা সস্তায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিনে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তাদের জন্য ছিল ট্যাক্স হোলিডে বা কর অবকাশ সুবিধা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কোনো ট্যাক্সই দিতে হতো না। ছিল ব্যাপকভিত্তিক কর ফাঁকি, অর্থ পাচার এবং স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ।

ধনীদের আরও ধনী করা এবং তাদের সম্পদ রক্ষা করা ছাড়া রাষ্ট্র কার্যত অন্য কোনো দায়িত্বই পালন করতো না। এতে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন মিসরীয়রা। ১৯৫২ সালে বিপ্লব ও সেনা অভ্যুত্থানের পর মিসরের লাখ লাখ মানুষ যে আর্থিক সুবিধা নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করছিল তা তিরোহিত হয়ে যায়। মিসরের কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার জায়গা দখল করে অনাহার ও অবহেলা।

স্কুল ও বিশ^বিদ্যালয়গুলো তহবিল সংকটের কারণে অপ্রয়োজনীয় কারখানার মত বেহুদা বিষয় শিক্ষা দিতে থাকে। এখান থেকে ডিগ্রিধারীরা মার্জিত জীবন এবং স্বাধীনতা ও মর্যাদার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের ভাগ্যে জুটত নির্মম শ্রমবাজারের শোষণ ও বেকাররত্বহীনতা।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে সম্পদের অপ্রতুলতা এতোটাই প্রকট হয়ে পড়েছিল যে লাইফ সাপোর্টও বন্ধ করে দেওয়া হতো। গরীব রোগীরা হাসপাতালে এতোটাই দুর্দশায় পড়তো যে তারা যতটা খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে ঢুকতেন তার চেয়ে আরও খারাপ শরীর নিয়ে বের হতেন।

মোবারকের আমলে শুধু ধনীরাই আরও সম্পদশালী হতো। সেখানে কিছুটা হলেও সামাজিক গতিশীলতা বা সোশ্যাল মবিলিটি ছিল। সেখানে একটি বিকাশমান পেশাজীবী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। অনেক বিলাসবহুল শপিং মল ও হাউজিং এস্টেটও গড়ে ওঠে।

সমস্যা ছিল জনসংখ্যার বেশিরভাগই পেছনে পড়ে ছিল। তাদের আরও অতি দরিদ্র হওয়া ঠেকাতে রাষ্ট্রের কোনো সুরক্ষা জাল ছিল না। এক সময় যেসব সেবা রাষ্ট্র প্রদান করতো তা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, এমনকি অনেক সরকারি জায়গাও।

কথিত নব্যউদারের ভেজাস্বপ্নে মিসরে একটি জংলী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যার আইনপ্রণেতা ছিলেন ধনীরা। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং এমনকি অনেক সময় বেঁচে থাকার মত মৌলিক অধিকারের কোনো গ্যারান্টি ছিল না। মর্যাদা ও নিরাপত্তা আপনাআপনি পাওয়া যেত না, সেগুলো সামাজিক সংযোগ ও অর্থ দিয়ে অর্জন করে নিতে হতো। কোটি কোটি মিসরীয়দের কাছে রাষ্ট্রের একমাত্র ভূমিকা ছিল সর্বতোভাবে একটি নিপীড়ক যন্ত্রের। মিসরে সাধারণত ভয়াবহ সন্ত্রাস ছিল না। জননিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল সরকারের গুণ্ডারা। সমাজকে গ্রাস করেছিল বকশিশ সংস্কৃতি।

যা অনুমান করা হয়েছিল তার আগেই জনগণ এসব বিষয় বুঝতে সক্ষম হয়। তবে আক্ষরিক অর্থেই সরকার এসব সমস্যা অস্বীকার করে বসে। তারা দেয়াল লিখন পড়তে ব্যর্থ হয়। শরীরটাকে বাঁচানোর জন্য তারা মাথা এগিয়ে দিয়েছিল। পরে তারা জনগণকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এর মাধ্যমে তারা জনগণের বিদ্রোহ দমন করতে চেয়েছিল ।

মোবারকের পতনের পর ২০১২ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। তিনি ছিলেন পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এক বছর পার না হতেই তার সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মদতে বিক্ষোভ হয়। এরপর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। জেলেই তিনি মারা যান।

আমেরিকার ডিগ্রিধারী মুরসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো অভিযোগই নেই। মুরসির সময়ে মিসরে প্রতিটি নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও স্বচ্ছ। কিন্তু সিসি এখন প্রহসনের নির্বাচনে প্রায় শতভাগ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।

২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থানের পর স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সরকার মুখোশ পুরোপুরি খুলে ফেলেছে। যে কোনো ধরনের সমালোচনা ও ভিন্নমত বর্বরভাবে দমন করেছেন সিসি। উপরন্তু মোবারক আমালের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা আবারও ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।

সামরিক বাহিনীকে ধনী বানানো এবং তাদের লোভ পূর্ণ করার জন্য জনগণকে ন্যূনতম সেবা প্রদানেও ব্যর্থ হচ্ছে সিসির সরকার। তবে মিসরীয় বিপ্লবের সূতিকাগার তাহরির স্কয়ারে এখন এসবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক শোনা যায় না। তাহরির স্কয়ারের জমিনে এখন সবুজ ঘাস জন্মেছে। গোপন পুলিশ বাহিনী কার্যত প্রকাশ্যেই ঘিরে রাখে সেই তাহরির স্কয়ার। শিগগিরই এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে মিসর অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। মিসর রাষ্ট্রটি এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে।