মিয়ানমারে ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। এসব দেশ ও সংগঠন অবিলম্বে অং সান সু চিসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি দিয়ে দ্রুত গণতান্ত্রিক শাসনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারের অভ্যুত্থানে চীন একটু সময় নিয়ে মৃদু প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, মিয়ানমারের বিষয়টি তাদের নজরে রয়েছে। দেশটির পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে বেইজিং মিয়ানমারের সব পক্ষকে বসে দেশটিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সংবিধান ও আইনি কাঠামোর আলোকে তাদের মতবিরোধ নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু রাশিয়া তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি। অন্যদিকে মিয়ানমার যে আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্য সেই অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস বা আসিয়ান-এর সদস্য দেশগুলোর কয়েকটি সেনা অভ্যুত্থানকে মিয়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডে ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। তারা মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে চাইবে। এসব কারণে মিয়ানমারের গত এক দশকের ভঙ্গুর গণতন্ত্র আবারও ‘লকডাউন’-এর মধ্যে পড়ে গেল।
এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে কোন দেশ বেশি লাভবান হবে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এখন অনেকের কাছেই এটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে, মিয়ানমারে ক্রমবিকাশমান গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ায় এবং আবারও সামরিক শাসন আসায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চীন। প্রায় ৫০ বছরে সামরিক শাসনের সময় যখন পশ্চিমা বিশে^র দেশগুলো মিয়ানমারের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল তখন মিয়ানমারের জান্তা সরকার চীনের উপরই অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
এবারের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম হয়ে দাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো আবারও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে। কিন্তু এতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিচলিত হবে বলে মনে হয়না। কারণ চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তি তাদের পাশে রয়েছে।
মিয়ানমারে চীনের সরকারি-বেসরকারি বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটিতে অবকাঠামো নির্মানসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীন। এসব কারণে মিয়ানমারের সাথে চীনের জোরালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অনেক আগে থেকেই।।
অন্যদিকে রাশিয়ার সাথেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমার রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে থাকে। সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েকদিন আগেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিয়ানমারে এসেছিলেন দেশটিতে অস্ত্র বিক্রির একটি চুক্তি সই করতে। রাজধানী নেইপিডোতে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয় সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চীনের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে রাশিয়ার সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল বেছে নিয়েছে। এ কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে চীন।
২০১৬-১৭ সালে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যার কারণে মিয়ানমার ও তার নেত্রী অংসান সুচি পশ্চিমা বিশে^ ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার মুখে পড়লেও চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে গেছে দেশটিতে তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। অন্যদিকে সুচিও রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা বিশে^র নিন্দা-সমালোচনার মুখে পড়ায় বাধ্য হয়ে চীনের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এবারও তারা একই নীতি অনুসরন করে মিয়ানমারের সমালোচনা না করে বরং দেশটির পাশে দাড়িয়েছে। মিয়ানমারে নিজেদের বিনিয়োগ ও বানিজ্যিক স্বার্থের কোন ক্ষতি হোক তা তারা চায়না।
চীন কৌশল হিসেবে তার পররাষ্ট্র নীতিতে সারা বিশে^ গণতন্ত্রের বিকাশের প্রতি সমর্থন দেয়ার কথা বেেলছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবেই ২০১৫ সলের নির্বাচনে অংসান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর চীন সুচির সরকারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। বেইজিং মিয়ানমারে অবকাঠামো নির্মান ও বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করে। কারণ তারা জানে যে, সামরিক শাসকদের চেয়ে সুচির সরকারের সাথে তাদের চুক্তি করা অনেক সহজ হবে। চীনা বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ নিয়েছেনও।
২০১৭ সালের মে মাসে অং সান সুচি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে বেইজিং সফরে গেলে সেখানে তিনি চীনের আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই তে মিয়ানমারকে যুক্ত করেন।
বিআরআই এর কাঠামোর আওতায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার ২০১৮ সালে দুই দেশ চায়না-মিয়ানার ইকোনমিক করিডোর বা সিএমইসি নির্মানে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অন্যদিকে সুচির সরকারের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে গত বছর জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার সফর করেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং।
সেনা অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারে যেসব বড় বড় প্রকল্প দুই দেশের মধ্যে আলোচনার টেবিলে ছিল সেগুলোর মধ্যে আছে চীনের সীমান্ত শহর রুইলি ও মিয়ানমারের মান্দালয় শহরের মধ্যে রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। আরেকটি বড় প্রকল্প হচ্ছে চীনের অর্থায়নে বঙ্গোপসাগরের কিয়াউকপিয়াউতে একটি গভীর সমুদ বন্দর নির্মান করা। এই স্থান ইতিমধ্যেই তেল-গ্যাস পাইপলাইনের একটি টার্মিনাল হিসেবে কাজ করছে। এখান থেকে পাইপলাইনে মিয়ানমারের ভিতর দিয়ে চীনের দক্ষিনাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশে গিয়ে পৌছেছে।
এখন দেশটিতে সরকার পরিবর্তনের পর সামরিক শাসকদের প্রতিও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে চীন। কারণ চীন চাচ্ছে না কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিয়ানমারের সাথে তাদের সম্পর্কের সামান্যতম অবনতি ঘটুক। কারন বিআরআই এর আওতাধীন চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরের মাধ্যমে চীন খুব সহজেই ভারত মহাসাগরে গিয়ে পৌছতে পারবে। অন্যদিকে এই একই পথ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের চালান এসে তা খুব দ্রুতই মিয়ানমার হয়ে চীনে পৌছে যাবে।
২০০৮ সালে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে যে সংবিধান প্রনয়ণ করে তাতে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত বিষয়ক- অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি মন্ত্রনালয়সহ সামরিক বাহিনীর হাতে অনেক ক্ষমতা রেখে দেয়া হয়। সংবিধানে বলা হয়েছে যে, সেনাবাহিনী এই তিনটি মন্ত্রনালয়ে মন্ত্রী নিয়োগ দেবে। এখানে বেসামরিক সরকারের কোন ভুমিকা থাকবেনা। সে হিসেবে সেনাবাহিনী এই তিনটি মন্ত্রনালয়ে বর্তমান কিংবা সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফলে অস্ত্র কেনা সংক্রান্ত কোন চুক্তি কার্যত সামরিক বাহিনীই করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমানোর কোন সুযোগ বেসামরিক সরকারের নেই। কেননা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সংবিধান সংশোধন করে পার্লামেন্টে বিল পাশ করা কোন বেসামরিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব হবেনা।
২০০৮ সালের সংবিধানে বলা হয়েছে, পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত কোন বিল পাশ করতে হলে ৭৫ শতাংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে যা কখনোই সম্ভব না। কারণ এই সংবিধানেই পার্লামেন্টের মোট আসনের ২৫ শতাংশ সেনা কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনাইটেড সলিডারিটি এন্ড ডেভেলমেন্ট পার্টি বা ইউএসডিপি কিছু আসন পায়। এর ফলে কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সংবিধান সংশোধন করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমানো সম্ভব হবে না।
এ কারণে মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ভূমিকা সব সময় থেকেই যাবে। আর তা চীনের জন্য এক বিরাট স্বস্তির কারণ। কেননা, মিয়ানমারে সামরিক শাসন যতবার আসবে ততবারই পশ্চিমা বিশ^ দেশটির উপর অর্থনেতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। তখন চীনই হবে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বনিজ্যের জন্য মিয়ানমারের প্রধান ভরসাস্থল। যদিও চীন মিয়ানমারের বেশকিছু বিদ্রোহী সংগঠনকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চীনের উপর ক্ষুব্ধ হলেও তারা কিছু বলতে পারছেনা।
পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে তারা চীনমুখি হচ্ছে। আর সে সুবিধাটা চীন পুরোপুরিই গ্রহন করছে। মিয়ানমারে ক্ষমতায় যারাই থাকুক তাদের সাথেই ব্যবসা-বাণিজ্য করবে চীন। অবশ্য গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে চীনর জন্য একট সমস্যা। কেননা তখন পশ্চিমা দেশগুলোও চীনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। তাদের সাথে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। কিন্তু যতবার সামরিক শাসন আসবে ততবাই পশ্চিমা বিশ^ মিয়ানমার থেকে দূরে সরে যাবে। আর ততবারই চীন হবে দেশটির একমাত্র বিশ^স্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু। খুলে যাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অবারিত সুযোগ।