যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন-রাশিয়ার পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা


  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৭:৫৫

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিক কমান্ডের প্রধান চার্লস রিচার্ড বলেছেন, চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় অভিযোগ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে রাশিয়া পারমাণবিক হামলার নীতি গ্রহণ করেছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র এর সঙ্গে যুক্ত করেছে চীনের নাম।

চার্লস রিচার্ড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবার রাশিয়া এবং চীনের মতো দুটি সমকক্ষ শক্তিকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। যে দেশ দুটি পারমাণবিক শক্তিধর। গত বছর মস্কো এক কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তায় জানায়, রাশিয়ার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলকে পারমাণবিক বোমা বহনকারী হিসেবে গণ্য করবে। এর জবাব দেবে পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের প্রস্তুতির জবাবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে নতুন একটি পারমাণবিক বোমা এবং তা মোতায়েন করা হয় সাবমেরিনে। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র চীন এবং বৃটেনের পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ করছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গত কয়েক বছর ধরে অনেক বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ পারমাণবিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা বলে আসছেন।

এবার এ আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিক কমান্ডের কমান্ডার চার্লস রিচার্ড। রিচার্ড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই চীন অথবা রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। চীন রাশিয়া তাদের নতুন এডভান্সড কৌশলগত অস্ত্র যাতে প্রয়োগ করতে না পারে সে ব্যাপারেও উপায় খুঁজতে হবে।

চার্লস রিচার্ড নেভল ইনস্টিটিউট জার্নালে চীন ও রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন টাইমস। চার্লস রিচার্ডের মতে , স্নায়ু যুদ্ধের পরে প্রতিদ্বন্দ্বী পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশগুলোর সাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা দূর হয়েছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নেই। চীন এবং রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

রিচার্ড পরামর্শ দিয়েছেন পারমাণবিক যুদ্ধ অসম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের এ ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের এ যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে উলব্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে পারমাণবিক যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

রিচার্ড পরিস্থিতি ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন যুক্তরাষ্ট্র কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি এবং এ বিষয়ে কী করা উচিত তা যতক্ষণ পর্যন্ত অনুধাবন করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের পরিকল্পনা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। এমনকি কাঙ্খিত পদক্ষেপও নিতে পারব না।

যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষপে মোকবিলার জন্য মস্কো এবং বেইজিং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পারমাণবিক এবং কৌশলগত দক্ষতার ক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগ করেছে। ওয়াশিংটন টাইমসকে এক সাক্ষাতকারে রিচার্ড বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম বারের মত দুটি সমকক্ষ শক্তিকে এক সাথে মোকাবেলা করতে হবে যারা পারমাণবিক শক্তিধর। আর এটি ঘটতে যাচ্ছে এই দশকের শেষেই।

তার মতে আমেরিকা এবং তার মিত্রদের স্বার্থে এ হুমকি বিষয়ে এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে। এ বিষয়ে কী করনীয় সে সম্পর্কে অনেক ধারনা এসেছে কিন্তু তার মধ্যে অল্পই পরামর্শ রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে রাখবে।

রিচার্ড পরামর্শ দিয়েছেন, পেন্টাগনকে আরো কৌশলগত সমরাস্ত্র এবং সিস্টেম সংগ্রহ করতে হবে । একই সাথে কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল আর সাইবার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।

রিচার্ড চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সমকক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করে পরামর্শ দিয়েছেন চীনকে খাট করে দেখা হবে ভুল সিদ্ধান্ত। রাশিয়ার মত চীনও আগ্রাসী উপায়ে গনতান্ত্রিক মূল্যবোধকে হুমকিতে ফেলেছে এবং বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থাকে রিজের স্বার্থে নিজের মত করে গড়ার চেষ্টা করছে। প্রতি ক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচলিত অস্ত্র ব্যবস্থার পাশাপাশি তারা হাইপারসনিক এবং এডভান্সড মিসাইল সিস্টেম, মহাকাশ এবং কাউন্টার স্পেস দক্ষতা বৃদ্ধি করে চলছে। স্পেস সিস্টেমের কারনে তারা বিশ্বব্যাপী কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল এবং গোয়েন্দা দক্ষতা অর্জন করছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন রাশিয়ার মত চীনা বিমান এবং নৌ বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের আন্তর্জাতিক আকাশ ও সমুদ্রসীমায় বেশ হয়রানি করছে। ভূমিতে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র আর সাবমেরিন ভিত্তিক মিসাইল এর পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। চীনের পারমাণবিক বোমার সংখ্যা তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পেতে পােের আগামী এক দশকে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিক কমান্ডের প্রধান রিচার্ড মনে করেন, চীন ১৯৬০ সাল থেকে পরমানু বোমার ক্ষেত্রে নো ফার্স্ট ইউজ পলিসি মেনে চললেও এটা পরিবর্তন হতে পারে চোখের পলকে। চীন সীমিত আকারে এবং প্রথমে পারমাণবিক হামলার চালানোর পদক্ষেপ নিতে পারে।

তার বিশ্লেষণ নাইন ইলেভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কাউন্টার টেরোরিজম নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে আর চীন এবং রাশিয়া বাড়িয়ে চলছে পরমানু বোমার মজুদ। এ দুটি দেশ প্রতি নিয়ত বিশ্ব শান্তি আর বৈশ্বিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। স্লায়ু যুদ্ধের সময়ও যা হয়নি এখন তারা তা করছে । এই দুই দেশ হলো সাইবার এটাক আর মহাকাশে হুমকি। রাশিয়ার মিসাইল পাওয়ার এবং পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকায়ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে রিচার্ড বলেন, আকাশে এবং সমুদ্রে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নানা ধরনের উসকানিমূলক সামরিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে । এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমনও পরিচালনা করেছে । সবচেয়ে বড় হুমকি হলো তাদের এন্টি স্যাটেলাইট উইপন। এটি মহাকাশে আন্তর্জাতিক যেসব সম্পদ রয়েছে তার জন্য হুমকি।

ট্রাম্প শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ করেছিলো রাশিয়া তার শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সীমিত পরিসরে পারমাণবিক হামলার নীতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও সামরিক স্থাপনায় স্বল্প ক্ষমতার পারমাণবিক বোমা হামলার নীতি গ্রহণ করেছে রাশিয়া। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে স্বল্প ক্ষমতার নতুন একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে যা মোতায়েন করা হয়েছে একটি সাবমেরিনে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক কর্মসূচী ব্যাপক সংস্কার এবং নতুন নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাথে তার মিত্র বৃটেনও ২০২০ সালে পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকায়নের ব্যাপক কর্মসুচী গ্রহনের ঘোষণা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যখন রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক হামলার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তখন রাশিয়াও একই ধরনের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। রাশিয়ারও আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও সামরিক স্থাপনায় আকস্মিক পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে। আর এর লক্ষ্য হবে রাশিয়ার পারমাণবিক আক্রমনের সক্ষমতা নস্যাত করে দেয়া।

রাশিয়া গত বছর হুশিয়ারি দিয়ে বলেছে তার দিকে ছুটে আসা যে কোনো ব্যালেস্টিক মিসাইলকে সে পারমাণবিক বোমা বহনকারী মিসাইল হিসেবে বিবেচনা করবে। আর এর জবাবও দেবে পারমাণবিক আক্রমণের মাধ্যমে। রাশিয়া কোনো বিলম্ব না করে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাবে শত্রুর বিরুদ্ধে।

মিলিটারি বিষয়ক সংবাদপত্র রেড স্টারে রাশিয়ার এ কঠোর হুশিয়ারির কথা প্রকাশ হয় ২০২০ সালের আগস্টে। আর রাশিয়া এ হুমকি দিয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে । মিলিটারি টাইমস অনলাইনেও তখন এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
রাশিয়ান একজন মেজার জেনারেল এবং কর্ণেলের উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে।

রেড স্টারের খবরে বলা হয় রাশিয়ার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলে যদি পারমাণবিক বোমা না থেকে অন্য প্রচলিত বোমা থাকে তবু রাশিয়া এর জবাব পারমাণবিক বোমা হামলার মাধ্যমেই দেবে । কারন রাশিয়া মনে করে তার ওপর এ ধরনের যে কোনো হামলা রাশিয়ার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি। ফলে রাশিয়ার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলকে তারা পারমাণবিক বোমা বহনকারী মিসাইল হিসেবে গণ্য করবে।

এমনকি রাশিয়ার কাছে যদি নির্ভরযোগ্য খবর আসে যে, কোনো দেশ তার বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে ক্ষেত্রেও রাশিয়া তার বিরুদ্ধে অফেনসিভ পদক্ষেপ হিসেবে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাবে।

রাশিয়ার আশংঙ্কা যুক্তরাষ্ট্র কক্ষপথে মিসাইল মোতায়েন করতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ সক্ষমতা রাশিয়া তার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করে।