আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে সম্প্রতি সোমালিয়ার ঋণের ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে তুরস্ক। ঋণের ভারে নুয়ে পড়া দেশটির পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় এ অর্থ পরিশোধ করে দেশটি। এরপর সোমালিয়া এমন একটি আইন অনুমোদন করেছে, যাতে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর অনুসন্ধানকাজের দুয়ার খুলে যায়। এক বছর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছিলেন, সোমালিয়া তাদের জলসীমায় তেল অনুসন্ধান করতে তুরস্কের তেল কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মোগাদিসু এখন আইন পাস করে তাদের তেল অনুসন্ধানের পথ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করল।
ইসলামি ও নন-ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের নেতা হওয়ার জন্য আঙ্কারার বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবেই এসব আয়োজন সম্পন্ন হলো। এরদোয়ানের এ কৌশলের কেন্দ্র এখন আফ্রিকা মহাদেশ।
২০১১ সালে সোমালিয়া সফর করেন এরদোয়ান। তখন থেকেই মোগাদিসুর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর করে তোলেন তিনি। তুরস্কের কোম্পানিগুলোকে সেখানে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়; আঙ্কারা সেখানে অনেক স্কুল ও মাদরাসা নির্মাণ করে; সোমালিয়ার শিক্ষার্থীদের তুরস্কে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, দেশের বাইরে তুরস্ক নিজেদের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটি নির্মাণ করে মোগাদিসুতে। লোহিত সাগরের প্রবেশপথের কাছাকাছি এ মূল্যবান কৌশলগত জায়গায় তুরস্ককে ঘাঁটি করার সুযোগ করে দেয় সোমালিয়া।
সোমালিয়া নিয়ে এরদোয়ানের এ হিসাব-নিকাশ বিশ্বব্যাপী তুরস্কের প্রভাব বাড়ানোর বৃহত্তর কৌশলেরই অংশ।
২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এরদোয়ান বলে আসছিলেন, চলমান বৈশ্বিক শৃঙ্খলাটা যথার্থ নয়। জাতিসংঘের ভেটো-ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ স্থায়ী সদস্য-রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করেই তিনি বারবার বলেছেন, এ গ্রহটা পাঁচ অঙ্কের চেয়েও বড়। তিনি আভাস দিয়েছিলেন, তুরস্কেরও বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। আঙ্কারার উচিত মুসলিম-বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করা।
১৮ বছর তুর্কি সরকারের হাল ধরে এগোতে থাকা এরদোয়ান আঙ্কারার শক্তিকে তিলে তিলে দৃঢ় করার কাজ করেছেন। কখনও শক্তভাবে আবির্ভূত হয়েছেন, কখনও নরম কৌশলে।
প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে তিনি অভ্যন্তরীণ অস্ত্র শিল্প উন্নয়নের পথে হেঁটেছেন। তুরস্ক কেবল দুই ধরনের রণতরিই তৈরি করছে না, বরং একটি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারও শিগগির উদ্বোধন করতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়াকে পরাজিত করতে আজারবাইজানকে মূল সহায়তা দিয়েছে তুরস্কের তৈরি ড্রোন। ২০২০ সালে আফ্রিকার উত্তর উপকূলে তথা লিবিয়ায় তুরস্কের জোট এবং জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত জিএনএ সরকারের বিরুদ্ধে খলিফা হাফতারের হামলাকে প্রতিহত করে তুরস্কের ড্রোন।
আগে যে দেশটি আমদানির ওপর নির্ভর করে সেনাবাহিনী চালাত, তাদের জন্য এ অগ্রগতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এ অগ্রগতি এরগোয়ানকে অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল করেছে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস জুগিয়েছে। মাঝেমধ্যে, নিজের মিত্রদেরও চ্যালেঞ্জ করছেন তিনি।
কৌশলের কোমল দিক ব্যবহার করে তিনি কাছের এবং দূরের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কাজটা বেশ ভালোভাবেই সেরেছেন।
তুরস্কের গায়ে যখন শুধু ‘ন্যাটো’ এবং ‘ইউরোপভিত্তিক’ পরিচয় ছিল, তখন আফ্রিকায় তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। এরদোয়ান দ্রুত এ মহাদেশে দূতাবাসের সংখ্যা ১২ থেকে ৪২-এ নিয়ে আসেন। তার আমলের প্রথমার্ধে যখন অর্থনীতির সব সূচকের অগ্রগতি ছিল, তখন তিনি এ মহাদেশে বিনিয়োগ করতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করেন।
কোভিড-১৯ এসে বিমান ভ্রমণকে বিপর্যস্ত করার আগে তাদের রাষ্ট্র-মালিকানাধীন তার্কিশ এয়ারলাইনস আফ্রিকায় অর্ধশতাধিক গন্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার অফার দেয়। মানে, আপনি যদি আফ্রিকা সফর করতে চান, ইস্তাম্বুলে ট্রানজিট করার একটি সুবর্ণ সুযোগ মিলবে।
আফ্রিকায় প্রভাব বাড়ানোটা সহজ ছিল এরদোয়ানের জন্য। এ মহাদেশ থেকে সহজে অনেক ফল অর্জনের সুযোগ ছিল তার। লক্ষ্য অর্জনে যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল, তা ছিল পরিমিত এবং সাশ্রয়ী।
তবুও, এ রকম পদক্ষেপ বাধাহীনভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল না। এ অঞ্চলে নৌ উপস্থিতি মিসর এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলো ভালোভাবে নেয়নি। ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি দেশের এ পদক্ষেপকে নব্য-অটোমান সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আখ্যা দিয়ে দিয়ে একে ব্যাহত করার চেষ্টা করা হয়।
আরব দেশ-বেষ্টিত কাতার যখন এ অঞ্চলে বিভিন্ন ইস্যুতে গভীর বিতর্কের মুখোমুখি, তখন দেশটিকে সক্রিয় সমর্থন দেয় তুরস্ক। এ সক্রিয় সমর্থনের পর উপসাগরীয় দেশগুলোতে তুরস্ক নিয়ে সন্দেহ আরও শক্তভাবে দানা বাঁধে।
উদাহরণস্বরূপ, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকে যখন তুরস্কের সেনাসদস্যরা যুক্ত হয়ে পড়েন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তাদের জোট নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান হুমকি অনুভব করতে থাকে। প্রশ্ন দানা বাঁধতে থাকে, এরদোয়ান নিজ দেশের এত দূরে ঘাঁটি বানাবেন কেন? বিশেষ করে, মিসর লোহিত সাগরে অনধিকার প্রবেশের আতঙ্কে ভুগতে থাকে।
এ অঞ্চলে যখন আরব আমিরাত নিজেদের ঘাঁটি নির্মাণ করে, তখন তাদের প্রাথমিক ইচ্ছে ছিল ইয়েমেন সঙ্ঘাতে নিজের পক্ষকে সমর্থন করা। এখন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সাইপ্রাস, গ্রিস ও ইসরাইলের সঙ্গে সারিবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে আরও একধাপ এগিয়ে দেশটি আঙ্কারা নিয়ে তাদের ক্রমবর্ধমান অস্বস্তির কথা পরিষ্কার করেছে।
তুরস্কের ভূমি থেকে পূর্ব আফ্রিকার দূরত্ব খুব বেশি নয় বলেই কি আঙ্কারা সেখানে অবস্থান মজবুত করার চেষ্টা করছে? না। পশ্চিম আফ্রিকায়ও প্রভাব বিস্তারের একই রকম পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে দেশটি যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, সামরিক উপাদান বাদ দিলে পশ্চিম আফ্রিকায়ও এ প্রচেষ্টার ধরন একই রকম।
এখানে কিন্তু আরব দেশগুলো কিংবা ইসরাইল নয়, বরং বিচলিত হচ্ছে ফ্রান্স। তারা ফ্রেঞ্চ-ভাষাভাষী আফ্রিকান দেশগুলোকে তাদের প্রভাববলয় হিসেবে বিবেচনা করে। এখানে তুর্কিদের তৎপরতা দেখে মোটেও খুশি নয় ফ্রান্স। এমনিতেই লিবিয়া ইস্যুতে আঙ্কারার ধাক্কা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্যারিস; তার ওপর ফ্রান্সের প্রভাববলয়ে আঘাত করার কারণে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে।
১৯১২ সালে ফ্রান্সের দখলে আসার পর সময়ের পরিক্রমায় আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষভাগে স্বাধীনতা পায়। এরপরও ফ্রান্সের দখল করা ২৪ দেশের মধ্যে ১৪ দেশে এখনও চলছে তাদের শোষণ। টোগো, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, আইভরিকোস্ট, মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো, নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবনকে বলা হয়ে থাকে ফ্রাঙ্ক জোন। এই অঞ্চলেই ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে তুরস্ক।
আলজেরিয়া, গাম্বিয়া, সেনেগাল, গ্যাবন, মৌরতানিয়া, মালি, সোমালিয়া ও লিবিয়ার সাথে তুরস্কের বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে। তুরস্ককে যে ভূমধ্যসাগরে থামিয়ে দিতে ফ্রান্সের তোড়জোড়, তার অন্যমত কারণ তুরস্কের আফ্রিকায় পা বাড়ানো।
তুরস্কের আফ্রিকা নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১৯৯৮ সাল থেকে। ২০০৫ সালকে তুরস্ক ‘ইয়ার অব আফ্রিকা’ বলে আখ্যা দেয়। ২০০৮ সাল থেকে তুরস্ক আফ্রিকান ইউনিয়নের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। একই বছরে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ‘তুর্কি আফ্রিকা কোঅপারেশন সামিট’, যেখানে আফ্রিকার ৫০টি দেশ থেকে প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন।
২০১৩ সালে গ্যাবনে গিয়ে এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘আফ্রিকা আফ্রিকানদেরই থাকবে। আমরা এখানে স্বর্ণের জন্য আসিনি।’ বছরখানেক আগে এরদোয়ান আলজেরিয়া, সেনেগাল ও গাম্বিয়া সফর করেন। লিবিয়াতে সৈন্য পাঠালেও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই আফ্রিকার দেশগুলোকে আস্থায় আনতে চাইছে তুরস্ক। ২০১৯ সালে তুরস্ক ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ১২ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৩ সালে আফ্রিকার দেশগুলোয় তুরস্কের বিনিয়োগ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সাল নাগাদ সেখানে তুরস্ক ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। তুরস্কের বিনিয়োগ মহাদেশজুড়ে ৭৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। গত ১০ বছরে এরদোয়ান ৩০টি আফ্রিকান দেশে ২৮টি সফর করেছেন। এমনকি ২০১১ সালে দুর্ভিক্ষ, খরা ও যুদ্ধাক্রান্ত সোমালিয়া সফর করে আলোচনায় আসেন তিনি।
যে দেশগুলিতে তিনি ভ্রমণ করেছেন, তার মাঝে অনেকগুলি দেশই প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ এবং সেখানে ফরাসিদের প্রভাব যথেষ্ট। এরদোগানের ভ্রমণ করা প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশের মাঝে রয়েছে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, জিবুতি, সেনেগাল, আইভোরি কোস্ট, গিনি, মাদাগাস্কার, শাদ, মৌরিতানিয়া ও মালি। এর মাঝে তিনি আলজেরিয়া এবং সেনেগালে ভ্রমণ করেন তিনবার করে। প্রতিটা দেশের সঙ্গে তুরস্ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দাতব্য কর্মকাণ্ড নিয়ে চুক্তি করেছে।
আফ্রিকায় এরদোয়ানের কূটনৈতিক তৎপরতা কতটুকু সফল হয়েছে, সেটা সময়ই বলবে। তবে, করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তাদের সামর্থ্যে কিছুটা ভাটা পড়লেও এরদোয়ান দমে যাওয়ার পাত্র নন। বিশেষত, নিজ দেশের জনগণের আরও কাছে যাওয়ার জন্য যখন এ দুর্দান্ত বৈদেশিক অর্জন অসাধারণ কাজ করছে, তখন তিনি পিছু হটবেন কেন!