মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানকে যে কারণে সমর্থন দিচ্ছে ভারত


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৫

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেকে দাবি করে। মিয়ানমারের নির্বাচনি ফলাফলকে অগ্রাহ্য করে এবং স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে সরিয়ে সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা নিয়ে নেওয়ার পর বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করলেও ভারত এ বিষয়ে বিস্ময়করভাবে চুপ রয়েছে। এমনকি সু চিকে মুক্তি দেওয়ার কিংবা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিকে পুনরায় চালু করার বিষয়েও ভারত কোনো আনুষ্ঠানিক দাবি তোলেনি। ভারতের এ আচরণ বিশ্ববাসী বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে বিস্মিত করেছে।

ভারত ও চীন উভয় দেশই মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়ে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করেনি। অথচ এ দুটি দেশের প্রতিক্রিয়া তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা মিয়ানমারের সাথে এ দুটি দেশেরই সীমান্ত রয়েছে। চীনকে অনেকেই একনায়কতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এখনো বিবেচনা করে। তাই চীনের অবস্থান খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের পতাকা বহন করার দাবিকারী রাষ্ট্র ভারতের নীরবতা ও কৌশলী আচরণ বিশ্লেষকদের বিস্মিত করেছে।

ভারত মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। তবে তারা মোটের ওপর সেনা অভ্যুত্থানের কোনো নিন্দা করেনি। সেনা অভ্যুত্থানের পরপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা উদ্বেগের সাথে মিয়ানমার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। ভারত সবসময়ই গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের যাত্রাকে সমর্থন করে এসেছে। আমরা আশা করি, আগামীতেও মিয়ানমারে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর লক্ষ্য রাখছি।’

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেনা অভ্যুত্থানের পরপর যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, ভারতের আনুষ্ঠানিক মন্তব্য তার চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। চীনের মুখপাত্র সেনা অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “মিয়ানমারে যা হচ্ছে আমরা তা দেখছি। আমরা পরিস্থিতিকে এখনো বোঝার চেষ্টা করছি। চীন বরাবরই মিয়ানমারের বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমরা আশা করি, মিয়ানমারের সকল পক্ষই নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্যকে ইতিবাচকভাবে নিরসন করবে এবং সংবিধান ও আইনী কাঠামোর আওতায় থেকে একসাথে কাজ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।

কেন চীন ও ভারতের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এ সাদৃশ্য দেখা দিলো?, খুব সম্ভবত এর কারণ এটাই, সেনা অভ্যুত্থানের মূল কারিগর মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রধান, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং আগে থেকেই চীন ও ভারত উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক ধরে রেখেছেন। কারো কারো মতে জেনারেল মিন বেইজিং এর চেয়ে বরং দিল্লির সাথেই বেশি ঘনিষ্ট। খুব বেশিদিন আগের কথাও নয়। জেনারেল মিন অভিযোগ করেছিলেন যে, চীন মিয়ানমারে বেশ কিছু সন্ত্রাসী সংগঠনকে প্রশয় দিচ্ছে, তাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করছে। তিনি অভিযোগ করেন চীন রোহিঙ্গাদেরকেও নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছে এবং রোহিঙ্গা ইস্যু দিয়ে চীন বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প বাস্তবায়নে মিয়ানমারের সাথে দর কষাকষিও করছে।

রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে সাক্ষাতকারের সময় চীনের দিকে জেনারেল মিন আঙ্গুল তুলেছিলেন। তিনি অবশ্য সরাসরি চীনের নাম বলেননি। বলেছিলেন প্রতিবেশি এক পরাশক্তি আমাদের দেশের মাটিতে বিদ্রোহীদেরকে উস্কে দিচ্ছে। পরবর্তীতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জমিন টুন পরিস্কার করেন যে, সেনা প্রধান সাক্ষাতকারে সন্ত্রাসী সংগঠন বলতে আরাকান আর্মী এবং আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে বুঝিয়েছেন। যারা বর্তমানে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে রাখাইন প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে। রাখাইনের সাথে চীনের সীমান্ত রয়েছে এবং চীনই পরোক্ষভাবে এ সন্ত্রাসীদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে।

চীনকে নিয়ে বিব্রত হলেও জেনারেল মিন দিল্লির সাথে দীর্ঘদিন ধরেই সুসম্পর্ক ধরে রেখেছেন। নরেন্দ্র মোদির সরকার অং সান সু চির বিকল্প হিসেবে তার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক জিইয়ে রেখেছে। বিগত ৬ বছরে ভারতের সাথে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার মাত্রাও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। জেনারেল মিন অং ২০১৭ সালের জুলাইতে একবার এবং ২০১৯ সালের জুলাইতে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফর করেন। অন্যদিকে, ভারতের তৎকালীন সেনা প্রধান এবং বর্তমানে দেশটির চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াতও ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে দু দফায় মিয়ানমার সফর করেন।

২০১৯ সালে জেনারেল মিনের ভারত সফরের সময় দুদেশ সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করে। এ সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশ সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করে। কোনো দেশের শত্রুরা যেন অপর দেশের মাটি ব্যবহার করে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে না পারে সে বিষয়েও নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে। পাশাপাশি, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এর সাথে ২০২০ সালের জুলাইয়ে মস্কোতে জেনারেল মিন আবারও বৈঠক করেন। সর্বশেষ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে ভারতীয় প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের বৈঠক হয় গত বছরের অক্টোবর। সে সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিক হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এবং সেনা প্রধান জেনারেল এমএম নারাভানে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো সফর করেন।

ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মিয়ানমারের সেনা প্রধান এবং ক্যু’র মূল নায়ক জেনারেল মিন অংয়ের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করেন। পাশাপাশি, তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো ইন, ডেপুটি কমান্ডার ইন চীফ এবং মিয়ানমারের সেনা দফতরের আরো কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সাথেও বৈঠক করেন।

মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে ভারতের কর্মকর্তারা দেশে ফেরার কয়েকদিনের মাথায় ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবরে ভারত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে আইএনএস সিন্ধুবীর নামক একটি কিলো-ক্লাস সাবমেরিন হস্তান্তর করে। ১৯৮৮ সাল থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী এ সাবমেরিনটি ব্যবহার করে আসছিল। এরপর ভারত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে আরো বেশ কিছু অস্ত্র সরবরাহ করে। ২০১৭ সালে ভারত মিয়ানমারের নৌ বাহিনীর কাছে হালকা ওজনের টর্পেডো হস্তান্তর করে।

মিয়ানমারে শ্রিংলা এবং জেনারেল নারাভানের সফরের সময়, ভারত মিয়ানমারে নতুন করে আরো বেশ কিছু সমরাস্ত্র দিতেও সম্মত হয়। যার মধ্যে আছে আর্টিলারি গান, টি-সেভেন্টি টু ট্যাংকের বিস্ফোরক, পানির নীচে শত্রু স্থাপনা নির্নায়ক সোনার এবং টর্পেডো। দক্ষিন এশিয়ার ভূরাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক বালাদাস ঘোষাল মনে করেন, মিয়ানমারকে সাবমেরিন প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অব্যহত নৌ সহযোগিতার ইংগিত পাওয়া যায়। বেইজিং বাংলাদেশের সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্পর্ক ভালো করেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি মিং শ্রেনীর সাবমেরিনও পেয়েছে। তারই জবাব হিসেবে ভারত মিয়ানমারকে এ যাত্রায় সাবমেরিন হস্তান্তর করে।

ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে আরো একটি সমঝোতা স্মারক রয়েছে যার ভিত্তিতে দুই দেশ তাদের নৌ পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং জাহাজ সম্পর্কিত তথ্যও বিনিয়ম করবে। ইন্ডিয়া-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সেনা মহড়া বা আইএমবিএএক্স এর আওতায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যেও যোগাযোগ ও লেনদেনের মাত্রা বেড়েছে। এ বিষয়টি আরো পোক্ত হয় ২০২০ সালের মে মাসের একটি ঘটনায়, যখন ভারতের কাংখিত ২২ জন বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ভারতের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনাকে দিল্লি ও নেপিডোর কুটনৈতিক কর্মকান্ডের একটি বিরাট সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

মিয়ানমারের সাথে ভারতের ঘনিষ্টতা সম্ভব হয়েছে জেনারেল মিন অং এর জন্য। মিয়ানমারে ক্যু পূর্ব বেসামরিক শাসনামলেও তিনি সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব হিসেবেই বিবেচিত হতেন।

নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত ও মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১৪ সাল থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন। ভারতের প্রেসিডেন্টও মিয়ানমার সফর করেছেন। গত ৬ বছরে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ভারত সফর করেছেন তিন দফায়। দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে ২৫টি ফোরামে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করছে।

প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ার যে নীতি নরেন্দ্র মোদির সরকার গ্রহণ করেছে তারই অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সাথে বিগত ৬ বছরে ভারত সম্পর্ক অনেকটাই উন্নয়ন করেছে। আর ভারতের এ নীতি ও কৌশলের কোনোটাই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

ভারতের এ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীরও কোনো আপত্তি নেই। তাই অন্য অনেক দেশ মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করলেও মিয়ানমারের সেনা শাসন নিয়ে ভারত মোটেও বিব্রত নয়। তাই যেভাবে ভারত এতদিন মিয়ানমারের সাথে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়েছে, জেনারেল মিনের নতুন প্রশাসনের সাথেও যে তা অব্যহত থাকবে তাতেও কোনো সংশয় নেই।