তিন মোড়লের ভ্যাকসিন কূটনীতি


  • মোতালেব জামালী
  • ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৭:২৪

বিশ্বের তিন প্রধান শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এমনকি সামরিক প্রভাবকেও কাজে লাগাচ্ছে। এর সাথে এবার যুক্ত হয়েছে কোভিড-১৯ মহামারির ভ্যাকসিন।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন- তিন দেশই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন দিয়ে সহায়তার মাধ্যমে এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাদের এই ভ্যাকসিন কূটনীতির সফলতা কতটুকু আসে এবং কে কাকে টেক্কা দিতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়েই হিমশিম খেয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর দিকে তার কোনো নজরই ছিল না। আর এই সুযোগটি নিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানটি দখল করে ফেলেছে তারা।

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বায়োনটেক-ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা- এই তিন কোম্পানীর টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এর বাইরে রাশিয়া স্পুটনিক ভি ও চীন সিনোভ্যাক টিকার অনুমোদন দিয়েছে।

চীন তাদের দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানী সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের মাধ্যমে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, ব্রাজিলসহ সারাবিশ্বেই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কূটনীতি শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পনীর ভ্যাকসিন যাতে প্রবেশ বা বাজার দখল করতে না পারে সেজন্য চীন সব চেষ্টাই করছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওষুধ কেম্পানী মডার্না, জর্মাান-আমেরিকান কোম্পানী ফাইজার ও ব্রিটিশ-ডাচ অক্সফোর্ড-এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনও এই অঞ্চলে বাজারজাত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়াই প্রথম করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কার করে। গত বছর আগষ্ট মাসে দেশটি তাদের ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি অনুমেদন করে। তারা দাবি করছে যে, স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন ৯৫ শতাংশের বেশি কার্যকর ও নিরাপদ। যদি তাদের দাবি সত্য হয় তাহলে মডার্না, ফাইজার এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কিংবা চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের চেয়ে রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের চাহিদাই বাড়বে। এ কারণে রাশিয়াও তাদের ভ্যাকসিন মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশে^র অন্যান্য অঞ্চলে বাজারজাত করার জোরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতি জোরালো করার কারণ হচ্ছে, দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তাদের উহান নগরীর একটি গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকেই সারাবিশে^ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার এ অভিযোগ তোলায় বিশ্বব্যাপি চীনের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা কাটিয়ে উঠার জন্যই দেশটি তার ভ্যাকসিন কূটনীতি জোরালো করেছে।

ইমেজ পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে চীন প্রথমে করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন দেশগুলোতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশ ও আফ্রিকার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। চীনের জোরালো ভ্যাকসিন কূটনীতির কারনে আরব আমিরাত ও বাহরাইনসহ জিসিসির সদস্য দেশগুলোতে চীনের ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়। অন্যদিকে চীন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আফ্রিকার দেশগুলোতে চিকিৎসক, মাস্ক ও অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠায়। এ মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া প্রথম দেশ হিসেবে চীনের এই সহায়তা পায়।

আরব আমিরাত চীনা ভ্যাকসিন নিয়ে বেইজিং এর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করতে চায়। তারা ধারণা করছে, এরফলে আমিরাতে চীনের বিনিয়োগ আসবে। জোরদার হবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

অবশ্য চীনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন দেশ নানা প্রশ্ন তুলতে থাকে। হংকং সরকার এক সময় দ্রুত চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানীর ভ্যাকসিন পেতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের তাড়াহুড়ো নেই । কারণ হচ্ছে- হংকংয়ের অধিকাংশ মানুষের সিনোভ্যাকে কোনো আস্থা নেই। হংকংয়ের এক হাজার মানুষের কাছে কোভিড-১৯-এর কোন ভ্যাকসিনে বেশি আস্থা জানতে চেয়েছিল হংকং বিশ্ববিদ্যালয়। জবাবে মাত্র ২৯ দশমিক মানুষ বলেছেন চীনের সিনোভ্যাকের কথা। হংকং এর মানুষের মাঝে যে জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিনের প্রতি আকর্ষণ বা আস্থা বেশি তা খুবই স্পষ্ট। সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৫৬ ভাগ মানুষ বলেছেন, তারা জার্মানির বায়োনটেক কোম্পানীর ভ্যাকসিনই নিতে চান। আর ৩৫ ভাগ জানিয়েছেন তারা চান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসির তৈরি ভ্যাকসিন।

ভ্যাকসিন নিয়ে এই আস্থার সঙ্কট আরো অনেক দেশে দেখা গেছে। যেমন ভারতের মানুষ সে দেশের তৈরি ভ্যাকসিনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশি দেশগুলোতে ভারত থেকে সরবরাহ করা ভ্যাকসিন নিয়ে সাধারন মানুষ প্রশ্ন তুলছে। যদিও ভ্যাকসিন পুরোমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়নি। ভ্যাকসিনের ওপর আস্থাহীনতা প্রভাব পড়ছে ভ্যাকসনি কূটনীতিতে।

ব্রাজিলের গবেষকরা বলেছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখতে পেয়েছেন, চীনের ভ্যাকসিন ৭৪ শতাং কার্যকর। কিন্তু করোনা মহামারি প্রতিরোধে ব্যবহারের সময় এর কার্যকারিতা ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। আরব আমিরাত ও বাহরাইন বলেছে, তাদের দেশে চীনা ভ্যাকসিনের তৃতীয় দফা ট্রায়ালের সময় এর ৮৬ শতাংশ কার্যকারিতার প্রমান পেয়েছেন তারা।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট তথ্য নেই। তাই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬৫ বছরের কম বয়সীদের দিতে চায় জার্মানি। এই টিকা বয়স্কদের ওপর কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জার্মানির দুটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ওপর কাজ করে না। সেখানে সাফল্যের হার মাত্র আট শতাংশ। অবশ্য সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা। তারা জানিয়েছিল, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রেও তাদের টিকা সমান কার্যকর। দুটি ডোজ নেয়ার পর ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে বয়স্কদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও জার্মানির ভ্যাকসিন কমিটি জানিয়েছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬৪ বা তার কম বয়সীদের দেয়া উচিত।

ভ্যাকসিন নিয়ে আরব আমিরাতের ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভরশীলতা বাদ দিয়ে পূর্বমুখি কূটনীতি অনুসরণের আভাসও পাওয়া যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে আরব আমিরাত যে বিশেষ সুবিধা পেত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তা বাইডেন প্রশাসন কাটছাট করবে বলে ধারণা করছে আমিরাত সরকার। তাদের আশঙ্কা, প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমিরাতের কর্তৃত্ববাদী পররাষ্ট্র নীতি বদলাতে বাধ্য করবেন। সে কারণে দেশটি আগেভাগেই চীনের সঙ্গ গাটছড়া বাধতে চাইছে। আমিরাত অবশ্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিনও কেনার অনুমোদন দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা মস্কোর সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে।

চীন ইরাকেও ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে। বেইজিং তার কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছে তার অংশ হিসেবেই ইরাকে করোনার ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠিয়েছে।

অন্যদিকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো ভ্যাকসিন নেবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। দেশটি বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও কয়েকটি কোম্পানীর কাছ থেকে করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে। ইরানের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা রাশিয়া চীনের কাছ থেকে করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তেহরানের সাথে চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই আভাস পাওয়া যায়।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবই প্রথম জার্মান-আমেরিকান কোম্পানি ফাইজার-বায়োনটেকের ভ্যাকসিন কেনার অনুমোদন দিয়েছে। পরে জর্ডান, কাতার ও ওমান সৌদি আরবকে অনুসরণ করে একই কোম্পানীর ভ্যাকসিন কিনেছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে চায়।

রাশিয়াও হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারাও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কূটনীতির সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ফয়সাল মিকদাদ জানান, তারা রাশিয়ার সাথে তাদের উৎপাদিত স্পুটনিক ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে আলোচনা করছেন। সিয়িার জনগণ রাশিয়ার স্পুটনিক ও তাদের উৎপাদিত অন্যান্য ভ্যাকসিন দ্রুতই পাবে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মার্কিন সহায়তায় সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হলে বাশারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ফলে সিরিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব খুব বেশি। এ কারণে সিরিয়া যে রাশিয়ার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনবে তা অবধারিত ছিল।

এদিকে ইসরাইল ফাইজারের ভ্যাকসিন আমদানি করেছে। কিন্তু ইহুদি দেশটি গাজা ও পশ্চিম তীরে অবরুদ্ধ ৫০ লাখ ফিলিস্তিনিকে কোনো ভ্যাকসিন দিতে অস্বীকার করেছে। ফলে ফিলিস্তিনিরা রাশিয়ার কাছ থেকে স্পুটনিক ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে। মিসর অবশ্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনাটার ভ্যাকসিন কিনছে। এছাড়া চীনের সিনোফার্ম কোম্পানীর ভ্যাকসিন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনও আনছে দেশটি। এর মাধ্যমে দেশটি সব সুপার পাওয়ারের সাথেই সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে।

তুরস্ক চীনের কাছ থেকে দুই দফায় প্রায় এক কোটি ভ্যাকসিন কিনছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো রকম সন্দেহ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না ভোগার জন্য জনগনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তুরস্ক কেন চীনের ভ্যাকসিনের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে দেশটির ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির নেতৃত্বাধীণ সরকার ওয়াশিংটনের দিক থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে ঝুকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীন তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যে আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছে তার অংশ হিসেবেই দেশটি তার ভ্যাকসিন কূটনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে। এতে তারা সফলও হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবেই বলা যায়।