বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে চীনের সাথে ভারতের অমিলের চেয়ে মিল বেশি। দুই দেশেরই একশ কোটির বেশি জনসংখ্যা আছে। দুই দেশের আছে বৃহৎ অর্থনীতি। ২০০৮ সালে চীন ছিল ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্কও অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও দেশ দুটির মধ্যে এমন কিছু বিরোধের বিষয় আছে, যেগুলোর সমাধান না হলে বৃহৎ প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব হবে না। আর এর প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর।
বর্তমানে চীন ও ভারতের মধ্যে গত ৩০-৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক বিরাজ করছে। হিমালয় অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ লাদাখ সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের পর তা আরও খারাপ হয়েছে। ওই সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। চীনের কত সৈন্য মারা গেছে, তা অবশ্য দেশটি প্রকাশ করেনি। দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে নিজেদের ভূখণ্ডে সেনাদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করেছে।
লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শংকর বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালেও একবার লাদাখ সীমান্তে দুইদেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের পর থেকে চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা একটা কঠিন পর্যায় পার করছি। যদিও আমাদের সম্পর্ক ইতিবাচক দিকেই এগিয়ে চলেছে। দুই দেশই সীমান্তে বড় ধরনের সেনা সমাবেশ না করার একাধিক চুক্তিতে পৌঁছেছে। ভারতের অভিযোগ- চীন সম্প্রতি সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে হাজার হাজার সৈন্য সমাবেশ করেছে। চীনের এই পদক্ষেপে দুই দেশের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ভারতও যে লাদাখ সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করেছে, তা অবশ্য জয়শংকর এড়িয়ে যান।
সীমান্ত সমস্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হলেও তাতে অচলাবস্থা কাটেনি। এই সমস্যার সমাধান না হলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবেনা বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। বেইজিং ভিত্তিক সেন্টার ফর চায়না এন্ড গ্লোবালাইজেশন এর সিনিয়র ফেলো অ্যান্ডি মংক চীন-ভারত সম্পর্ক একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ভারতের চীন বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা। ভারতের এই চেষ্টা শুধু দেশটির সাথেই নয়, তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও একটা বিরুপ প্রভাব ফেলবে। চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে নয়, বরং চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার মাধ্যমেই ভারত আরো বেশি লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক স্থবির হয়ে আছে। সার্ককে পাশ কাটিয়ে ভারত অন্যান্য উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগে জড়িত হচ্ছে। যেমন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তার শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক সংস্থা বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনোমিক কোঅপারেশন বা বিমসটেকের নেতাদের আমন্ত্রণ জানান। এই সংস্থার ৫টি সদস্য দেশ হ”েছ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড।
ভারতের অতীত ইতিহাস দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দিল্লির উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের চেষ্টা তেমনভাবে ফলপ্রসু হয়নি। নেতৃত্ব, সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব এক্ষেত্রে বড় কারণ। ঢাকায় বিমসটেকের একটি স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে ১৭ বছর লেগেছে। অন্যদিকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার ইকোনোমিক করিডোর বা বিসিআইএম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে।
সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ দৃশ্যমন না হওয়ায় ভারত আরো উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের দিকেই হাটবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে চীন ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই গঠনের কারণে ভারত উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের দিকে আরো বেশি মনোযোগ দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারত বিমসটেক গঠনের উদ্যোগ নেয়ার অনেক আগে থেকেই চীনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও কানেক্টিভিটির পরিকল্পনার ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। বিমসটেকে চীনের অনুপস্থিতির কারণে ভারতের এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেয়ার সফলতা নিয়ে অনেক বিশ্লেষক আগে থেকেই সন্দিহান ছিলেন।
এ সম্পকের্ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্রীনিবাসন বলেন, বিমসটেকের দেশগুলোর অর্থনীতির অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থার পাশাপাশি এসব দেশের অর্থনীতির নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে। একইসঙ্গে এতে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অনুপস্থিতি ভারতের উদ্যোগের গতিকে শ্লথ করে দেবে। কেননা চীন ছাড়া অন্য কেন দেশের পক্ষে বড় বিনিয়োগ করা সম্ভব হবেনা।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত বহুদেশীয় উদ্যোগের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। দেশটি আঞ্চলিক যে কোনো নিরাপত্তা উদ্যোগকে তার নিজস্ব স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে ব্যবহারের চেষ্টা করে। এর ফলে প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে ভারতের ‘বড় ভাই’ সুলভ আচরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভারত একতরফাভাবে কোনো উদ্যোগ নিলেই প্রতিবেশি অন্য দেশগলো সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখে। অন্যদিকে নতুন অর্থনৈতিক শক্তির দেশ চীন খুব দ্রুতই ভারতকে পিছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তার গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করেছে।
চীনের বেল্ট এন্ড রোডস ইনিশিয়েটিভে অংশগ্রহনে ভারত অনীহা দেখালেও এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো ভারতকে অনুসরন করেনি, বরং তারা চীনের উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। এরফলে দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুতই চীনের প্রভাব বেড়ে বেড়েছ। একই সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে মৈত্রির বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে। বিআরআই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর তার বড় প্রমান।
বিআরআই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য সুব্রাম্মনিয়াম স্বামী বলেছেন, পাক-ভারত সীমান্ত দিয়ে না নিয়ে বরং কোলকাতা বা মুম্বাই দিয়ে বিআরআইকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি চীনের বিবেচনা করা উচিত। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পরস্পরের প্রভাব খর্ব করতে চীনও ভারত এই অঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিক কৌশল গ্রহন করেছে।
২০০৭ সালে চীন সার্কের পর্যবেক্ষক দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর দেশটি সার্কের কার্যক্রমে অংশগ্রহনের আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। কিন্তু ভারতের অনাগ্রহের কারণে বিষয়টি আর অগ্রসর হতে পারেনি। অথচ সার্কে যুক্ত হলে চীনের বড় বিনিয়োগে সার্কের গতি আরো আগেই জোরদার হতে পারত। পর্যবেক্ষকের মর্যাদার কারণে চীন সর্কের কোনো ফোরামেই কোনো প্রস্তাব উত্থাপন বা কোনো আলোচনা করতে পারছেনা। চীনকে পূর্ণ সদস্য বানালে ভারত আগের মতো সার্কে তার প্রভাব খাটাতে পারবেনা জেনেই দেশটি চীনকে সদস্য পদ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। অথচ চীনকে সার্কের সদস্য করা হলে এই অঞ্চলের ছোট দেশগুলোর অর্থনীতিই বেশি লাভবান হতো বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে বড় ভূমিকা পালন করতে দিতে ভারতের অনাগ্রহের বেশ কিছু কারন রয়েছে। ভারত মনে করে চীন এই অঞ্চলে বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ পেলে এশিয়ার অর্থনীতি চীন কেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। ভারতের এই আশংকার বড় কারণ হচ্ছে চীনর অনুকূলে ভারতের বড় বাণিজ্য ঘাটতি।
চীন-ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ণের পথে আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে চীনের কূটনীতি বুঝতে ভারতের ব্যর্থতা। এ কারণে আঞ্চলিক দৃশ্যপটে ভারত চীনকে একটি ‘আনপ্রেডিক্টবল’ খেলোয়াড় হিসেবে মনে করে। যেমন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে চীনের উহানে নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর মধ্যে বৈঠক হয়। ২০২০ সালের শুরুর দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে চীন কাশ্মির ইস্যু আবারও তোলার চেষ্টা করে। এ ঘটনা ভারতকে কৌশল নির্ধারণী মহলকে বড় একটা ধাক্কা দেয়।
দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাতের আশংকা কমানোর লক্ষ্য উভয় দেশই পারস্পারিক আস্থা বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপ গ্রহন করা সত্ত্বেও দুদেশ স্নায়ু যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশই পরস্পরের আঞ্চলিক প্রভাব কমাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা কৌশল গ্রহন করছে।
এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের পথ রুদ্ধ করতে ভারত যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অষ্ট্রেলিয়ার সাথে একটি অঘোষিত জোট গঠন করেছে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন ভারতের প্রতিবেশি নেপালের সাথে রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। তিব্বত থেকে কাঠমান্ড পর্যন্ত এই রেল লাইন নির্মান করা হবে। এর মাধ্যমে চীন ভারতের ঘাড়ের কাছে নিজের অবস্থান জোরদার করবে। একইসঙ্গে চীন ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত অবস্থান জোরদার করতে পাকিস্তানকেও নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানে তালেবান ও দেশটির সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনায় এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে বেইজিং। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এই অঞ্চলের বৃহত্তর পরিসরে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে চীন ভারতকে কৌশলগতভাবে পিছনে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে একটি পশ্চাদপদ দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চীনের ভুিমকা ছিল খবই সীমিত। কিন্তু গত চার দশকের সংস্কার ও বিশ্বের জন্য চীনকে উন্মুক্ত করে দেয়ার ফলে দেশটি আজ এক বৃহৎ পরা শক্তি। বর্তমানে চীন তার বিপুল অর্থনৈতিক সম্পদ, শিল্প শক্তি ও সামরিক সক্ষমতায় এক অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছে। অন্যদিকে ভারত অন্য পরাশক্তিগুলোর সহযোগিতা নিয়ে চীনকে মোকাবেলার চেষ্টা করছে।