তেল আবিবভিত্তিক নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর বার্ষিক সম্মেলনে ইসরাইলি সেনাপ্রধান বলেছেন, তার দেশ যদি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে সেনাবাহিনী। আগামী বছরের মধ্যেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। দেশটির সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আভিভ কোচাভি হঠাৎ করেই ইরানে হামলার হুমকি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নিস্তরঙ্গ পরিবেশকে গরম করে তুলেছেন।
ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োশি কোহেন ১১ জানুয়ারি সদ্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সাথে ওয়াশিংটনে সাক্ষাৎ করেন। এর পরপরই সিরিয়ায় ইরানের একটি অবস্থানে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। এই হামলায় ৫৭ জন নিহত হন। মার্কিন গোয়েন্দারা এই হামলায় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে। এরপরই ইরানে হামলার এই হুমকি দেওয়া হলো।
ইসরাইলি সেনাপ্রধানের ইরানে হামলার হুমকির বিষয়ে তেহরান খুব একটা জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির চিফ অব স্টাফ মাহমুদ ভায়েজি বলেছেন, ইসরাইল ‘মনস্তাত্তিক যুদ্ধ’ শুরু করেছে। আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তবে আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইরানকে রক্ষা ও নিরাপদ রাখার প্রশিক্ষণ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর রয়েছে। মাহমুদ ভায়েজি আরো বলেন, নেতানিয়াহুকে এটা মনে রাখতে হবে যে, ট্রাম্প এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় নেই। ট্রাম্প এখন ইতিহাসের পাতায় চলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও এখন আর নেতানিয়াহুর নেই।
ইসরাইলের এই হুমকির সাথে ইরানের সাথে বিশ্বের ৬টি শক্তিধর দেশের পরমাণু চুক্তির সর্ম্পক আছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানী ২০১৫ সালে ইরানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুয়ায়ী ইরান একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে বের করে আনে। এরপর ইরানের উপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইরানের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়ে। কিন্তু এরপরও ইরান এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলো চুক্তির প্রতি অটল রয়েছে।
ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে না গিয়ে ২০১৯ সালে চুক্তির কিছু ধারা লংঘন করেছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। দেশটির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কথা। বর্তমানে তা ৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। আগামীতে এই হার ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার ও সমৃদ্ধ সেন্ট্রিফিউজগুলো পুনরায় সক্রিয় করার পরিকল্পনা করছে ইরান।
ইসরাইল আশঙ্কা করছে ইরান পরমাণু বোমা তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। হয়তো আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তারা পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করবে। দেশটি যদি পরমাণু বোমার অধিকারি হয় তাহলে তারা একসময় তা ইসরাইলে হামলায় ব্যবহার করবে। এই আশঙ্কা থেকেই ইসরাইল সব পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে চায় ।
ইসরাইলি সেনাপ্রধান আভিভ কোচাভি বলেছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সাথে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবারো ফিরে যায় তাহলে সেটা হবে বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত। যদি চুক্তিকে কিছুটা সংশোধন বা পরিমার্জনও করা হয় তারপরেও এতে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না। জেনারেল কোচাভি এখানে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ বলতে যুক্তরাষ্ট্র ও এর নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেই বুঝিয়েছেন।
বাইডেন প্রশাসন ইরানের সাথে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করার ও দ্রুত নতুন চুক্তিতে পৌছার ইঙ্গিত দিয়েছে। জেনারেল কোচাভি আশঙ্কা করছেন, বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের মতো ইরানের সাথে সংঘাতের পথ বাদ দিয়ে সমঝোতার পথে যেতে চাচ্ছে। সেটা হলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে যা ইসরাইলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।
ইসরাইলি সেনা প্রধান দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে আলোচনা করেই ইরানে হামলার এই হুমকি দিয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে নেতানিয়াহু সব সময়ই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে আসছেন। তিনি ২০১৫ সালে ইরানের সাথে ৬ শক্তিধর দেশের পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘একটি খারাপ চুক্তির চেয়ে কোনো চুক্তি না থাকাই ভালো।’
এ বছর নেতানিয়াহু একটি অস্বাভাবিক কাজ করে বসেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার শীর্ষ স্থানীয় উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষন দেয়ার সময় ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রেকে কোনো চুক্তি না করার আহবান জানান।
নেতানিয়াহুর এমন বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর নাক গলানোকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইরানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইসরাইলের অধিকাংশ গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা তখন তাদের সরকারকে এই ধারণা দিয়েছিলেন যে, যেহেতু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে, ইসরাইলকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
ইসরাইলের জনজীবনে সামরিক বাহিনীর বিরাট প্রভাব রয়েছে। কেননা শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কারনেই দেশটির অস্তিত্ব টিকে আছে। সে কারণে সামরিক বাহিনী যে সিদ্ধান্ত নেয় বা যে কথা বলে তার প্রতি জনগনের সমর্থন থাকে । কোভিড-১৯ মহামারির কারণে গত একবছর ধরে দেশটির সেনাবাহিনী কোনো আলোচনায় ছিল না। সে নীরবতা ভেঙ্গে ইসরাইলি সেনাপ্রধান আবারও যুদ্ধে দামামা বাজিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষন করেছেন। তিনি তার তার নিজের সীমানা পেরিয়ে ইসরাইলের পররাষ্ট্র নীতিতেও হস্তক্ষেপ করেছেন। অথচ তা করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার সরকারের। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কি করবেন বা করবেন না তা বলে দেয়া অন্য কোনো দেশের সেনা কর্মকর্তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানে হামলার হুমকি দেয়া ইসরাইলি সেনা প্রধানের একটি কৌশলও হতে পারে। তিনি এর মাধ্যমে সরকারের বাজেটে সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করে রাখলেন। অতীতেও দেশটির সেনাবাহিনী এ ধরনের পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ নিয়েছে।
ইসরাইলি সেনাপ্রধানের ইরানে হামলার হুমকি এলো দুই দেশেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়ার মধ্যে। ইসরাইলে আগামী মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যা হবে দুই বছরের মধ্যে চতুর্থ নির্বাচন। অন্যদিকে ইরানে আগামী জুনে সাধারণ নির্বাচন হবে। নির্বাচনে নেতানিয়াহু আবারো জিততে পারবে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়।
নেতানিয়াহু এটা ভালো করেই বুঝতে পারছেন যে, ট্রাম্প ক্ষতায় থাকতে মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে ইসরাইল যেভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে, এখন আর তা সম্ভব হবে না। ওয়াশিংটনে খেলার নিয়ম বদলে গেছে। কংগ্রেসের দুই কক্ষেরই নিয়ন্ত্রন এখন ডেমোক্রেটদের হাতে। সেখানে আগের মতো কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটানো সম্ভব হবে না।
জো বাইডেন ইসরাইলের সাথে কৌশলগত জোট ও অংশিদারিত্বে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও তিনি চলবেন তার নিজের বুদ্ধি-বিবেক অনযায়ী। ট্রাম্পের মতো তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তা করানো যাবে না। তিনি ইতিমধ্যেই ইরানের সাথে উত্তেজনা কমানো এবং ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণের আভাস দিয়েছেন।
ইরানের পরমাণু চুক্তি নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আলোচনার জন্য ইসরাইলি গোয়ন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োশি কোহেন ওয়াশিংটন যাবেন বলে খবর এসেছে। আলোচনার সময় ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে বেশ ইসরাইলের চাওয়াগুলো তুলে ধরবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরমধ্যে অন্যতম গুরুত্ব পাবে, ইরান যেন পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। দেশটি কোনো পরমাণু অস্ত্র বানাবে না এমন নিশ্চয়তা সংক্রান্ত ধারা ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানানো হবে। এছাড়া ইরানের পরমাণু কর্মসূচীর ব্যাপারে ইসরাইল সর্বশেষ তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছে সেগুলোও বাইডেন প্রশাসনকে দেয়া হবে।
ইসরাইলি সেনাপ্রধান ইরানে হামলার যে হুমকি দিয়েছেন, তা যদি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর গোপন ইচ্ছার প্রতিফলন হয়ে থাকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন অবশ্যই তাতে হস্তক্ষেপ করবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার মেয়াদের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্ট করতে দেবেন না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অবনতি হোক তা তিনি চাইবেন না। ফলে ইসরাইলকে তিনি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রাখবেন বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাননা তিনি। যুদ্ধ কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের যুদ্ধবিরোধী শক্ত অবস্থানের কারণে ইসরাইল ইরানে হামলা চালানোর সাহস করবে না বলে আশা করা যায়।