তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক সব সময়ই ওঠানামা করেছে। কখনও তাদের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, আবার কখনও আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়ে তা শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি হয়। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব থাকলেও পরস্পরের মধ্যে উত্তপ্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এ কারণে দেশ দুটির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই বৈরীতার সম্পর্ক অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানিয়া খেলাফতের সময় থেকেই শুরু হয়। অটোমান সুলতানদের সাথে তৎকালীন সৌদি শাসকদের যুদ্ধও হয়েছে।
প্রথম বিশ^যুদ্ধে উসমানীয় খিলাফতের বিলুপ্তির পর সৌদি আরবের দ্রুত উত্থান ঘটে। কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া প্রতিষ্ঠার পর ১৯৩২ সালে তুরস্ক-সৌদি সম্পর্কের নতুন সূচনা ঘটে। তুরস্কের তৎকালীন শাসক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নিজ দেশকে নিরাপদ রাখতে সৌদি আরবের সাথে সুসর্ম্পক গড়ে তোলেন। দুই দেশই সুন্নি মুসলিম প্রধান দেশ হলেও ইসলামের অনুশীলন নিয়ে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রবল হয়ে ওঠায় সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
সৌদি আরব কঠোর ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করে, যেটাকে ওহাবি মতবাদ বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে তুরস্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং তারা কখনও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র বা প্রশাসনে ইসলামী ভাবধারার উত্থান ঘটতে দেয়নি। তুরস্ক-সৌদি সর্ম্পকে অতীতের মতো এখনও নানামুখী টানাপড়েন আছে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে সৌদি আরবের কনস্যুলেটে হত্যার পর দুই দেশের সম্পর্কে মারাত্মক অবনতি ঘটে। সৌদি শাসকদের বিশেষ করে যুবরাজ সালমানের কঠোর সমালোচক জামাল খাসোগিকে গোয়েন্দারা কনস্যুলেটের ভেতরে ডেকে নিয়ে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলে। এ হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিন্দার ঝড় তোলে।
কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাটি স্থাপন, ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়াসহ নানা ইস্যুতে ২০১৭ সালে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্য দেশগুলো।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতারের ওপর আরোপিত অবরোধের নিন্দা জানান। অন্যদিকে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা তুরস্কের পণ্য বর্জন, দেশটির জনপ্রিয় বিভিন্ন ড্রামা সিরিয়াল ও মিডিয়া নিষিদ্ধ করে। কিন্তু এরপরও তুরস্কের সাথে কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা কাতারকে কোন বিপদেই ফেলতে পারেনি। কেননা তুর্কি পার্লামেন্ট কাতারে সেনা মোতায়েন করার বিল অনুমোদন করে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান জাহাজ ভর্তি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী কাতারে পাঠান। ফলে এ মাসের শুরুর দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয় বিনা শর্তেই।
কাতারের ওপর অবরোধ প্রত্যাহারে শুধু কাতার নয়, তুরস্কেরও জয় হয়েছে। সৌদি আরব এখন তুরস্কের সাথে বৈরিতার বদলে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চাইছে। অবরোধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটা সবার জন্যই খুবই একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় এলাকায় সহযোগিতা জোরদার হবে।
অবরোধ প্রত্যহারের পরই সৌদি আরব ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে মধ্যস্থার প্রস্তাব দেয় কাতার। কাতারের বিশেষ দূত মুতলাক আল কাহতানি বলেন, যদি দেশ দু’টি মনে করে যে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে কাতারের ভূমিকা রাখার কোন সুযোগ আছে তাহলে আমরা অবশ্যই তা করবো।
চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জিসিসি’র শীর্ষ সম্মেলনের আগেই তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক ভালোর দিকে যাওয়ার একটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। গত নভেম্বরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরুর সময় সৌদি বাদশাহ সালমান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এরপর নাইজারে ওআইসি সম্মেলনে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কালুসোগলু এক টুইটে বলেন, সৌদি-তুরস্ক অংশীদারিত্ব শুধু দুই দেশেরই নয়, সমগ্র অঞ্চলের জন্যই কল্যান বয়ে আনবে।
তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগের অন্য কারণও আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কাতার বিশ^বিদ্যায়য়ের ইবনে খালদুন সেন্টারের গবেষক ও সহকারি অধ্যাপক আলী বাকির মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে যাওয়ায় ও জো বাইডেন ক্ষমতায় আসাটাও সৌদি আরবের তুরস্কমুখি হওয়ার অন্যতম কারণ। তার মতে, বাইডেন যদি রিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন তাহলে তাদেরকে নতুন পন্থার কথা ভাবতে হবে। আর যদি বাইডেন চাপ সৃষ্টি না করেন তাহলে আঙ্কারার সাথে রিয়াদের সম্পর্ক উন্নয়নের কোন প্রয়োজন হবে না।
তুরস্ক ও সৌদি আরব দুই দেশই ধারণা করছে যে, বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগের নীতির সম্পূর্ণ পরিবর্তন করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সাথে সংঘাতে যাওয়া ও কাতারের ওপর জিসিসি’র অবরোধ আরোপের পক্ষে ছিলেন। তার এই নীতি মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের সৃষ্টি করে। বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের এই নীতি তেকে সরে এসে মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকারের উন্নয়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেবন বলে ধারণা করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
তুরস্কের সাবানসি বিশ^বিদ্যালয়ের ইস্তাম্বুল পলিসি সেন্টারের গবেষক আহমেত এভিন মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন সৌদি রাজ পরিবারের প্রতি একেবারে অন্ধ। সৌদি রাজ পরিবারের সমর্থন না পেলে ট্রাম্পের রিয়েল এষ্টেট ব্যবসা অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে যেতো। লন্ডনের ফরেন পলিসি সেন্টারের রিসার্চ ফেলো ইমরে সেলিসকানও মনে করেন , ট্রাম্পের সাথে সৌদি রাজপরিবারের অনেক সদস্যের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ট্রাম্পের বিদায়ের পর পর এখন তারা তাদের অবস্থান ও সুর পাল্টাচ্ছে।
২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘আরব বসন্ত’ নামের গনতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলে তুরস্ক এই অঞ্চলে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর প্রতি সমর্থন দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল এসব দেশে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারে পরিবর্তন হয়ে ইসলামী ভাবধারার সরকার প্রতিষ্টা করা। যে সরকারগুলোর সাথে এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
কিন্তু সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলো মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘোর বিরোধী। তারা মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে। এর ফলে এসব দেশে থাকা এই সংগঠনের সদস্যরা পালিয়ে তুরস্কে গিয়ে আশ্রয় নেয়।মিসরে ২০১২ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু পরের বছর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির সেনাবাহিনী। মোহাম্মদ মুরসির প্রতি তুরস্কের সমর্থন ছিল। অন্যদিকে ক্ষমতা দখলকারি সেনা প্রধান আবদেল ফাতাহ আল সিসির প্রতি সৌদি আরবের সমর্থন ছিল। মিসরকে কেন্দ্র করেও সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছিল।
সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাতের জন্য বিরোধী গ্রুপগুলো সশস্ত্র আন্দোলন শুরুর পর তুরস্ক বিরোধীদের প্রতি সমর্থন জানান। সৌদি আরবও প্রথম দিকে তাদের সমর্থন দেয়। পরে সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা বাশার আল আসাদকে সমর্থন করে। লিবিয়ায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে জাতিসংঘ সমর্থিত ত্রিপোলী ভিত্তিক গভর্ণমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ সরকারকে সমর্থন দেয় তুরস্ক। তাদের সমর্থনে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠায় এরদোগান। অন্যদিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর লিবিয়ার বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারকে সমর্থন দেয়।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় কোন পক্ষই পুরোপুরি লাভবান হতে পারেনি। লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। সৌদি আরব বা তুরস্ক কেউই সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী হতে পারেনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিই হয়েছে দু’পক্ষেরই।
তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারিদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে এরদোয়ানকে। সৌদি আরবের সাথে উন্নত বাণিজ্যিক সম্পর্ক তুরস্কের অর্থনীতিকে অনেকটাই চাঙ্গা করবে বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির সিনিয়র ডাইরেক্টর আয়কান ইরদেমির।
তিনি মনে করেন , ১৯৮০ দশকে সৌদি পুজি তুরস্কের বাজার ও অর্থনীতিকে অনেকটা চাঙ্গা করেছিল। এরফলে দেশটির প্রতি বিদেশি বিনিয়োকারীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি সেই সম্পর্ককে স্থবির করে দিয়েছে।
কাতারের ওপর অবরোধ প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে সৌদি নেতৃত্বধীন জোট ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক আবারও উন্নত হওয়ার পথ সুগম হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের নেতৃত্বে কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার মাধ্যমে তুরস্কও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এসব দিক চিন্তা করেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন।