আর্কটিক অঞ্চলে শিল্প ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। এর ফলে কীভাবে এ অঞ্চলের ইকোসিস্টেমে প্রভাব পড়ছে, আজকের নিবন্ধ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; এ অঞ্চলকে ঘিরে সামরিক উত্তেজনা নিয়েও আলোচনা করব আমরা।
প্রথমে আর্কটিক অঞ্চল নিয়ে কিছুটা জেনে নিই। আর্কটিক বা উত্তর মেরু পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত বিন্দু। এর অন্য নাম সুমেরু। সুমেরুর বিপরীতে পৃথিবীর অপর প্রান্তে আছে কুমেরু বা দক্ষিণ মেরু। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের যে বিন্দুতে এর ঘূর্ণন অক্ষ পৃষ্ঠতলের সঙ্গে মিলিত হয় তাকে বলা হয় উত্তর মেরু। দক্ষিণ মেরু যেখানে একটি বিশাল মহাদেশের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত, সেখানে উত্তর মেরুর অবস্থান আর্কটিক মহাসাগরের মধ্যভাগে। মহাসাগরের এ অংশের পানি বছরের অধিকাংশ সময় সামুদ্রিক বরফে ঢাকা থাকে। এ কারণেই উত্তর মেরুতে কোনো স্থায়ী স্টেশন স্থাপন সম্ভব নয়, যা দক্ষিণ মেরুতে সম্ভব হয়েছে। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরবর্তীতে রাশিয়া, এ অঞ্চলে মনুষ্যবাহী কয়েকটি স্থানান্তরযোগ্য স্টেশন স্থাপন করেছিল। এর কয়েকটি আবার উত্তর মেরু বা এর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে যেতে সমর্থ হয়েছে। এই বিন্দু থেকে নিকটতম স্থানটি হচ্ছে কাফেক্লুবেন দ্বীপ। দ্বীপটি গ্রিনল্যান্ডের নিকটতম সমুদ্র উপকূল থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
মূল্যবান খনিজ সম্পদে ভরপুর আর্কটিক অঞ্চল। এ সম্পদ আহরণে সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে কাজ করছে শক্তিধর দেশগুলো। এ অঞ্চলের নিকটবর্তী দেশগুলোতো আছেই, বাইরের দেশগুলোও বিভিন্নভাবে সেখানে অবস্থান পোক্ত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে ধীরে ধীরে পরিবেশগত ভারসাম্য হারাচ্ছে অঞ্চলটি। এ অঞ্চলকে অক্ষত রাখতে পরিবেশবাদীরা বেশ সোচ্চার। কিন্তু পরিবেশবাদীদের এ চাওয়া তেমন শক্তি পাচ্ছে না।
নরওয়ের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এক রুলে বলেছেন, পরিচ্ছন্ন পরিবেশসংক্রান্ত দেশটির সাংবিধানিক অধিকার আর্কটিকে তেলের জন্য সরকারের ড্রিলিং কাজে বাধা সৃষ্টি করবে না। এমনকি মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশনও এতে লঙ্ঘিত হয় না। আর্কটিকে তেল অনুসন্ধানের জন্য দেওয়া লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেছিল পরিবেশবাদী গ্রুপগুলো। এ রায়ের কারণে সুমেরু অঞ্চলে ড্রিলিংয়ে আর কোনো আইনগত সমস্যা থাকল না।
এ ঐতিহাসিক পরিবেশ মামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে ‘গ্রিনপিস’ এবং ‘নেচার অ্যান্ড ইয়ুথ নরওয়ে’। তারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে বলেছেন, অক্ষত এলাকাগুলোতে ড্রিলিংয়ের কারণে ভঙ্গুর ইকোসিস্টেমে হুমকির সৃষ্টি করবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এতে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির সামরিক উত্তেজনার সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেছেন।
পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে নরওয়েজিয়ান মামলার সঙ্গে রুশ সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক কী? আমরা যা ভাবছি, তারচেয়েও বেশি। প্রসঙ্গটা পরিষ্কার করি। আর্কটিক অঞ্চলের যেখানে প্রবেশ করা যেত না, সেখানে এখন বরফ গলার কারণে পথ তৈরি হয়েছে, খনিজ ও জ¦ালনি সম্পদ এখন হাতের নাগালে চলে এসেছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এটি ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার তৎপরতা সেখানে অন্যদের চেয়ে ঢের বেশি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং এর প্রভবে আর্কটিক অঞ্চলে গলতে থাকা বরফ যতটা চিন্তায় ফেলেছে পরিবেশবাদীদের, ততটাই সামরিক বিশেষজ্ঞদের। বরফে ঢাকা অঞ্চলটি বিনা পয়সার সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকর ছিল। কিন্তু বরফের সঙ্গে গলে পড়ছে সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। যত বেশি বরফ গলে ভূমি উন্মুক্ত হচ্ছে, তত বেশি চিন্তিত হয়ে উঠছেন সংশ্লিষ্ট দেশের সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের তুলনায় উত্তর মেরুর বরফ গলছে দ্বিগুণ হারে। প্রতি সেকেন্ডে গলে যাচ্ছে ১০ হাজার টনের চেয়েও বেশি বরফ। ফলে উন্মুক্ত হচ্ছে নতুন জলপথ। নতুন জলপথ উন্মুক্ত হওয়ায় চলছে বাণিজ্যিক জাহাজ। চলাচলের এই সুযোগের কারণেই ঝুঁকি বাড়ছে উত্তর মেরুকে নিয়ে।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভূরাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ক্লাউস ডডস মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা দেশগুলোর যে দুশ্চিন্তা দেখতে পাচ্ছি, তার মূল কারণ উন্মুক্ত হতে থাকা নতুন জলপথ। আর্কটিক অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অন্যন্য করে রেখেছিল। কিন্তু বরফ গলে এখন যদি উত্তর মেরু বিশ্বের আর দশটা সাগরের মতোই হয়ে যায় তাহলে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে উদ্ভূত সুরক্ষা ব্যবস্থাটি আর কার্যকর থাকবে না।’
এদিকে উত্তর মেরু কেন্দ্রিক তৎপরতায় পাল্টে গেছে নরওয়ের ছোট্ট শহর ট্রমসোর বাস্তবতা। এককালে খুব ছোট একটি বাণিজ্যিক এলাকা ছিল এটি; এখন পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু দেশটির জন্য অপেক্ষা করছে এমন ভবিষ্যত, যা তার ইতিহাসের জন্য বিস্ময়কর। শহরটির মেয়র ক্রিস্টিন রোয়মো জানিয়েছেন, উত্তর মেরুর জলপথ উন্মুক্ত হতে থাকায় ছোট শহরটিতে নিজেদের ঘাঁটি গাঁড়তে চায় বিশ্বের নানা প্রান্তের দেশ।
এসব কারণে কী প্রভাব পড়ছে আর্কটিক অঞ্চলে? খরা, দাবানল, বন্যা- জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপর্যয়গুলো বারবার ঘটছে। এর মাত্রা বাড়ছেও। পানি ও বায়ুদূষণের মতো মানবসৃষ্ট সমস্যা, অতিরিক্ত মাছ ধরা, অতিবেগুনী বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধি এবং সম্পদ নিষ্কাষণজনিত দূষণের কারণে আর্কটিকের নিকটবর্তী অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দারা অতিরিক্ত চাপের মধ্যে বসবাস করছেন।
বল্গাহরিণ এবং স্যামনের মতো প্রাণির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পশুপালন, শিকার ও মাছধরার সুযোগও কমছে। আদিবাসী ও অন্য অধিবাসীদের জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যে তো ব্যাপক প্রভাব পড়ছেই, একইসঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার কারণে পরিবেশগত সমস্যার কারণে সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিলেও সেখানকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনার দিকে নজর দিয়েছে অনেক দেশ।
পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত তেলসম্পদের ১৩ শতাংশই রয়েছে আর্কটিক অঞ্চলে। প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০ শতাংশ লুকিয়ে আছে বরফের নিচে। লৌহ আকরিক, তামা, দস্তায় সমৃদ্ধ এ অঞ্চল। রয়েছে প্লাটিনাম, সোনা, রূপার মতো মূল্যবান ধাতুও। এসব কারণেও সেখানে জাহাজের প্রবেশ ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, সেখানকার স্থল ও সমুদ্রসীমা নিয়ে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা কম, কারণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সেটা একরকম সমাধান হয়ে আছে।
কিন্তু মহীসোপান নিয়ে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ এবং নর্দার্ন সি রুট হয়ে ট্রানজিটের অধিকার প্রয়োগ নিয়ে সমস্যা চলছে। রাশিয়া ও কানাডা যথাক্রমে নর্দার্ন সি রুট এবং নর্থওয়েস্ট প্যাসেজের আংশিক ও পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দাবি করেছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রেরও দাবি রয়েছে। যদিও প্যাসেজ দুটি এখনও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই শিপিং রুট হিসেবে গড়ে ওঠেনি, তা ব্যবহারকারী জাহাজের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনা নিয়ে তৎপর বৈশ্বিক শক্তিগুলো। গবেষণা, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং এ অঞ্চলের সামরীকিকরণে বিপুল বিনিয়োগ করছেন তারা। ‘কোল্ড ওয়ার’ যুগের সামরিক ঘাঁটিগুলো আবার খুলেছে রাশিয়া। ঘাঁটিগুলোতে এবং নর্দার্ন ফ্লিটে সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের কাজ যাচ্ছে দেশটি।
২০১৮ সালে চীন নিজেকে ‘সুমেরু অঞ্চলের নিকটবর্তী রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। নব্বইর দশক থেকে আর্কটিক নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। সেখানকার খনিজ শিল্প ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছেন তারা। রাশিয়ার সঙ্গে জ¦ালানি সহযোগিতা বাড়িয়েছে। দেশটি এখন সেখানে একটি নিউক্লিয়ার-পাওয়ার্ড আইসব্রেকার উন্নয়নের পরিকল্পনা করছে। সুমেরু অঞ্চলে ‘পোলার সিল্ক রোড’ নির্মাণের পরিকল্পনাও প্রকাশ করেছে দেশটি। সাদা চোখে এসব বিষয় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মনে হলেও এটি যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক সমস্যার কারণও হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ান আর্কটিক অয়েল প্রজেক্টে অংশগ্রহণ রয়েছে চীন ও ভারতের। আর্কটিক কাউন্সিলের স্থায়ী পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছে স্বঘোষিত ‘পোলার রাষ্ট্র’ ফ্রান্স। সিঙ্গাপুরও রয়েছে পর্যবেক্ষকের আসনে। বড় শিপিং হাব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিরও।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, সামরিক প্রদর্শনী, খননকাজ এবং মাঝেমধ্যে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যেকার উত্তেজনাকে সংবাদমাধ্যম ‘নতুন কোল্ড ওয়ার’ হিসেবে বর্ণনা করলেও আর্কটিক সঙ্ঘাত খুব শিগগির শুরু হবে বলে মনে হয় না।
ঐতিহাসিকভাবে, আর্কটিক দেশগুলো ‘অনন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র’ হিসেবে নিজেদের নিয়ে গর্ববোধ করে। এখনও সেটা আছে। সেখানে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে। আর্কটিক কাউন্সিল, আর্কটিক কোস্টগার্ড ফোরাম, প্রোটেকশন অব দ্য আর্কটিক মেরিন এনভাইরনমেন্টাল গ্রুপ, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামগুলো কাজ করছে সেখানে। আর্কটিক দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও রয়েছে। অয়েল স্পিল, বিকিরণ ও পরমাণু নিয়ে গবেষণা এবং উদ্ধার অভিযান নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, আর্কটিকের বাইরের কোনো উত্তেজনা বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়লে উত্তরমেরুতেও সেটা আঁচড়ে পড়তে পারে। এ চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যবস্থা কতটা স্থিতিশীল থাকবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।