তিব্বত মালভূমি থেকে উৎসারিত নদ-নদীগুলো এশিয়ার ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোর একশ কোটিরও বেশি মানুষের মিঠা পানির অন্যতম উৎস। তিব্বতের ইয়ারলং সাংপোতে একটি বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে চীন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত। যার প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশের ওপর।
উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পর তিব্বত মালভূমি হচ্ছে বিশ্বে মিঠা পানির তৃতীয় বৃহত্তম উৎস। এজন্য তিব্বতকে তৃতীয় মেরুও বলা হয়ে থাকে। এখানে বেশ কয়েকটি বৃহৎ নদীর উৎপত্তি হয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের পানির উৎস হচ্ছে তিব্বত থেকে উৎপন্ন হওয়া নদ-নদীগুলো। এসব নদ-নদী তিব্বত থেকে চীন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস প্রভৃতি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে বড় নদ হচ্ছে ইয়ারলাং সাংপো যেটাকে আমরা ব্রহ্মপুত্র হিসেবে চিনি। এটি পশ্চিম তিব্বতের কৈলাশ পর্বতের নিকটে হিমবাহ থেকে থেকে সৃষ্টি হয়ে এই মালভূমির ভিতর দিয়ে ২৯০০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। এরপর এটি ভারতের মধ্য বাংলাদেশে এসে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বৃহৎ অন্য নদীগুলো হচ্ছে মেকং, হোয়াং হো, ইয়াংজি, ইরাবতী, সিন্ধু, কোসি, অরুণ, কর্ণালী, ত্রিশুলী ইত্যাদি। এই নদ-নদীগুলো থেকে এসব দেশ মিঠা পানির পাশাপাশি খাদ্য ও জ¦ালানী উৎপাদন করে আসছে।
এসব কারণে তিব্বত মালভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। তিব্বত মালভূমি শুধু ভারত নয়, এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর পানির নিরাপত্তার প্রধান উৎস।
ইয়ারলং সাংপোতে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ভারতসহ এ অঞ্চলে দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ভারতের নীতি নির্ধারকরা চীনের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অন্য দেশগুলোকে নিয়ে একটি বলয় গড়ে তুলতে চান। যাতে সম্মিলিতভাবে এ ধরনের প্রকল্প না নিতে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়।
যদিও ভারত নিজেও একই ধরনের কাজ করেছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে করে শুস্ক মওসুমে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষিকাজে পানির মারাত্মক সংকট তৈরির পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। আবার বর্ষা মওসুমে ফারাক্কার গেটগুলো খুলে দিয়ে পানি ছেড়ে দেওয়ায় তলিয়ে যায় বাংলাদেশ। এতে ফসল, গবাদিপশু, ঘরবাড়ী সহ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। একই ভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী তিস্তার উজানে ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে বাংলাদেশের বিশাল একটি সেচ প্রকল্প অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাঁধ নির্মাণকারী দেশ চীন তিব্বত দখল করার পর মহাসড়কসহ যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশটির মূল ভূখন্ডের বিভিন্ন নগরী ও শহরের সাথে তিব্বতর সংযোগ স্থাপন করেছে। গত কয়েক দশকে চীন বিপুল অর্থ ব্যয় করে তিব্বতে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করেছে।
পুরস্কার বিজয়ী কানাডিয়ান সাংবাদিক ও লেখক মাইকেল বাকলে ২০১৪ সালে ‘মেল্টডাউন ইন তিব্বত’ নামে একটি বই লিখেছেন। এতে তিনি তুলে ধরেছেন , চীন কিভাবে তিব্বতের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে ব্যস্ত রয়েছে যা এই মালভূমির পরিবেশ-প্রতিবেশকে ধ্বংস করছে। তিনি চীনের এই কাজকে ‘পরিবেশ হত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বাকলে তার বইয়ে লিখেছেন, পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ তিব্বত থেকে উৎসারিত নদ-নদীর পানির উপর কোন না কোন ভাবে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ নির্ভরশীল। তারা খাবার পানি, কৃষি কাজ, মাছ ধরা ও শিল্পে ব্যবহার সহ নানাভাবে এই পানির উপর নির্ভরশীল। এসব নদ-নদীতে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করার ফলে এখন সব কিছুই বদলে যাচ্ছে।
বর্তমানে চীন হচ্ছে বিশ্বে সব চেয়ে বেশি বাঁধ নির্মাণকারী দেশগুলোর একটি। এক সময় চীন মঙ্গোলীয় যাযাবরদের হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মহাপ্রাচীর বা গ্রেট ওয়াল নির্মান করেছে। এখন দেশটি পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কংক্রিটের মহাদেয়াল বা ’গ্রেট ওয়াল অব কংক্রিট’ নির্মাণ করছে। এটা করতে গিয়ে চীন এশিয়ার ভাটির দেশ গুলোর পানি নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
তিব্বত পলিসি ইন্সটিটিউট এর রিসার্চ ফেলো ড্যাচেন পালমো তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত সাত দশকেরও বেশি সময়ে চীন ৮৭ হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করেছে। এসব বাঁধ থেকে ৩৫২ দশমিক ২৬ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় যা ব্রাজিল, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে চীনের এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ২ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, চীন ১৯৫০ এর দশক থেকে ২২ হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করেছে যেগুলোর উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশি। এ সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বে এ ধরনের বাঁধের অর্ধেক। চীনের এসব বাঁধের কারণে এশিয়ার বিপুল সংখ্যক মানুষ মিঠা পানির অবাধ প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিভারসের গবেষক মাইকেল বাকলে বলছেন, উচু দেয়ালের বাঁধের কারণে মাছ ও পানির অন্যান্য প্রানীর চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। পানির প্রবাহের সাথে নানা পুষ্টিকর উপাদানও ভাটির দিকে যেতে পারে না। এসব কারনে নদী বিধৌত অববাহিকায় পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। বনাঞ্চল, জলাভূমি ও আবাদি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া উপকূলীয় ব-দ্বীপের ভাঙন তরান্বিত হওয়াসহ নানা বিরুপ প্রভাব পড়ে।
বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখার ফলে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সেচভিত্তিক চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। এশিয়ার দেশগুলোতে ধান, তুলা ও রাবার চাষে প্রচুর পানি ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ধান উৎপাদন হয় চীন ও ভারতে। এ দু’টি দেশ ছাড়াও মিয়ানমার, বাংলাদশ, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত।
জাতিসংঘের ’ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টস ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরবর্তী ৩০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়বে প্রায় ২০০ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমানের ৭৭০ কোটি থেকে বেড়ে ৯৭০ কোটিতে পৌছতে পারে। বিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়ায় চাল হচ্ছে প্রধান খাদ্যদ্রব্য। এ কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে আরও বেশি ধান উৎপাদনের প্রয়োজন হবে।
ধান উৎপাদন করতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এশিয়ার এই অঞ্চলের ৮টি দেশে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হয় বা শীর্ষ ধান উৎপাদনকারি দেশ। তিব্বত মালভূমি থেকে উৎসারিত নদ-নদীগুলোর পানির অবাধ প্রবাহ যদি ভাটির এসব দেশে যেতে বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে ধান উৎপাদনও মারাত্মভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি র গবেষকরা ২০১৬ সালের এক গবেষণায় বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা এবং জনসংসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ এশিয়ায় পানির মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হবে। এই সময়ের মধ্যে এশিয়ার প্রায় ১০০ কোটি মানুষ তীব্র পানি সংকটে ভুগবে। পানির এই সংকট থেকে এশিয়ার প্রতিবেশি দেশ গুলোর মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন হতে পারে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে যা অতীতেও দেখা গেছে।
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য প্যাসিফিক ইন্সটিটিউট এর এক প্রতিবেদনেও পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব- সংঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলে পানি নিয়ে অন্তত: ৯২৬টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। অতীতের এসব ঘটনাবলী এবং বর্তমানে চীনের বিশৃঙ্খলভাবে হাজার হাজার বাঁধ নির্মাণ থেকে একথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, পানি ইস্যুটি খুব শিগগিরই একটি একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
পানি নিয়ে সংঘাতের প্রেক্ষাপট থেকেই ভারতের গবেষক ব্রাম্ম চেলানী ভবিষ্যৎ পানি সংকট নিয়ে লেখা তার বইয়ের নাম রেখেছেন ‘পানি: এশিয়ার নতুন যুদ্ধক্ষেত্র’।
এশিয়া কেবল চীনের স্বপ্ন নয়। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশও এশিয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। যদি চীনের বর্তমান উচু ধরণের অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক বাঁধ নির্মাণকাজ বাধাহীনভাবে চলতে থাকে তাহলে তিব্বতের নদ-নদীগুলোর ওপর চীনের একতরফা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলোতে পরিবেশবাদী আন্দোলন শুরু হতে পারে। এশিয়ায় চীনের কৌশলগত বা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা এই অঞ্চলে তার প্রতিবেশি দেশগুলোর স্বার্থকে ক্ষুন্ন করছে।
এ নিয়ে ভারত সোচ্চার। ভারতের রাজনীতিক ও গবেষকরা চীনের পাপ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারাও একই ধরনের পাপী। উজানে পানি প্রত্যাহারের ফল ভাটির দেশ বাংলাদেশ মরুকরনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হুমকির মুখে। বাড়ছে লবনক্ততা। যা কৃষি উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলছে। ইয়ারলং সাংপো বা ব্রক্ষপুত্র নদের ওপর চীনের বাধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ভারতের আর্তচিৎকার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর তেমন প্রভাব ফেলছে না। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সবার একসাথে প্রতিবাদ জানানো প্রয়োজন। এজন্য ভারতকে বাধ ও ব্যারাজ নির্মাণের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বাংলাদেশের পানির নায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর জনগণের স্বার্থেই উজানে পানি প্রত্যাহার বন্ধ করতে হবে। তিব্বতের নদ-নদীগুলোর পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।