এক নজিরবিহীন সাইবার হামলা হলো সংবাদমাধ্যমে। এক ইসরাইলি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের স্পাইওয়্যার দিয়ে আলজাজিরার অনেক সাংবাদিকের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। নেতৃস্থানীয় গবেষকদের ভাষ্য, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নির্দেশে এ হামলা হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ জানাবো আল জাজিরার ওপর কিভাবে এই হামলার ঘটনা ঘটলো।
কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি মিত্রদের দীর্ঘ অবরোধ, ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি-প্রভাবাধীন দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং এ অঞ্চলে তুরস্ক-ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কাতারভিত্তির সংবাদমাধ্যমের ওপর এ হামলাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সিটিজেন ল্যাব-এর গবেষকদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার বিরুদ্ধে বড়সড় গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা আবিষ্কার করেছেন তারা। এ সংবাদমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে আরব অঞ্চলের স্বৈরশাসকদের পথের কাঁটা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
শীর্ষস্থানীয় ডিজিটাল নজরদারি গবেষকরা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে অ্যাপল আইফোনের দম্ভে চপেটাঘাত করল এ প্রতিবেদন। আইফোনের দুর্বলতার দিকটি ব্যবহারকারীদের সামনে বড় হয়ে ধরা দিল।
সিটিজেন ল্যাবের গবেষকরা বলেছেন, এমন কিছু ক্ষতিকর কোড তারা আবিষ্কার করেছেন, যা ইসরাইলের এনএসও গ্রুপের ক্লায়েন্টরা ব্যবহার করে থাকেন।
অভিযোগ রয়েছে, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের আগেকার সাইবার হামলাগুলোতেও এই এনএসও গ্রæপের স্পাইওয়্যার ব্যবহৃত হয়েছিল। অবশ্য গ্রুপটি বলেছে, তাদের সফটওয়্যার ডিজাইন করা হয়েছে সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ধরার কাজে, সরকারিভাবে ব্যবহারের জন্য।
মরক্কোর সাংবাদিক, রুয়ান্ডার রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, স্পেনের রাজনীতিবিদ ও টোগোর গণতন্ত্রপন্থীদের টার্গেট করে কোম্পানিটির সফটওয়্যার কাজ করছে বলে দীর্ঘদিন ধরে যে অভিযোগ করা হচ্ছিল, সিটিজেন ল্যাবের আবিষ্কার করা নতুন হামলা এরই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই দেশগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং ক‚টনীতিকরা রয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
এনএসও’র বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও হোয়াটসঅ্যাপের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিবিশেষকে টার্গেট করে স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে এনএসও গ্রæপ। মার্কিন আদালতে গ্রুপটির বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের।
ফেইসবুকের মালিকানাধীন চ্যাটিং মেসেঞ্জারটির দাবি, নজরদারির উদ্দেশ্যে ১৪০০ মোবাইল ফোনে ম্যালওয়্যার পাঠিয়েছে এনএসও গ্রুপ। অবশ্য, হোয়াটসঅ্যাপের এমন দাবি নাকচ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আদালতের নথিতে হোয়াটসঅ্যাপ দাবি করেছে, ‘এনএসও গ্রুপ ম্যালওয়্যার বানিয়ে থাকে, যার কাজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত ডিভাইসগুলো ডিক্রিপ্ট করার পর সেগুলোর মেসেজ ও অন্যান্য যোগাযোগে প্রবেশ করা।’
হোয়াটসঅ্যাপ বলেছে, অনেকগুলো হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট তৈরি করে হোয়াটসঅ্যাপ সার্ভারের মাধ্যমে ভাইরাসযুক্ত কোড পাঠিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটি।
হোয়াটসঅ্যাপের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের ধারণা এই হামলায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্তত ১০০ সদস্যকে টার্গেট হয়েছে, যা অপব্যবহারের একটি সুস্পষ্ট উদারহরণ।’ নিজেদের সেবায় এনএসও গ্রুপকে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ।
এদিকে হোয়াটসঅ্যাপের এমন দাবির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা জানিয়েছে এনএসও গ্রæপ। তারা বলেছে, এনএসও’র মূল উদ্দেশ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং গুরুতর অপরাধ দমনে লাইসেন্সধারী সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সহায়তা করা।
আলজাজিরার সাংবাদিকদের ফোন হ্যাক করা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এনএসও বলেছে, এ অভিযোগের ব্যাপারে তারা একমত নন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বারবার বলে আসছি, আমরা কারও তথ্যভান্ডারে প্রবেশ করি না। নজরদারির কাজে আমাদের সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। এ সিস্টেম অপব্যবহারের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পেলে আমরা জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।’
যারা এ হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন আলজাজিরার অ্যারাবিক নেটওয়ার্কের বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক তামের আলমিশাল। সিটিজেন ল্যাব বলেছে, আলমিশাল সন্দেহজনক কোনো লিংকে কখনও ক্লিক করেননি। অ্যাপল সার্ভার থেকে আসা একটি ক্ষতিকর কোডের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়ে তার ফোন এনএসও’র সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। এর কয়েক সেকেন্ড পরই তার ফোনে ঢুকে পড়ে এনএসও।
কিছুদিন আগে ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোসের ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনায় আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমকে দায়ী করে ফেইসবুক। তদন্তকারীদের ধারণা, হোয়াটসঅ্যাপে ম্যালওয়্যারযুক্ত একটি ভিডিও ফাইল রিসিভ করার পরই বেজোসের আইফোন হ্যাকিংয়ের শিকার হয়। গত বছর একই পদ্ধতিতে এনএসও গ্রুপ পেগাসাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০ জন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর ফোন হ্যাক করেছিল।
ফেসবুকের এ বক্তব্যের বিষয়ে অ্যাপল কোনো মন্তব্য করেনি। এনএসও গ্রুপ বেজোসের ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনায় যুক্ত থাকার কথা নাকচ করে দিয়েছে। এ ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে বলে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
আলজাজিরা জানায়, তাদের অ্যারাবিক চ্যানেলের টিভি ব্রডকাস্টের সময় তিন ডজন সাংবাদিকের ফোন হ্যাক করা হয়।
সিটিজেন ল্যাব জানায়, চারটি স্বতন্ত্র ক্লাস্টার থেকে আলজাজিরার ৩৬টি ফোন হ্যাক করা হয়। এনএসও গ্রæপের অপারেটররাই এজন্য দায়ী। এর এক অপারেটরের সাংকেতিক নাম ‘মনার্কি’। সিটিজেন ল্যাব বলেছে, এ অপারেটর সৌদি সরকারের পক্ষ হয়ে আলজাজিরার ১৮টি ফোন হ্যাক করেছেন।
অন্য অপারেটরের সাংকেতিক নাম ‘ক্লিক কেস্ত্রেল’। তিনি ১৫টি ফোন হ্যাক করেন। তিনি কাজ করেছেন আরব আমিরাতের হয়ে। একটি ক্ষেত্রে, সৌদি এবং আমিরাত একই ফোন হ্যাক করে। গবেষকরা বলেছেন, এ হামলাটি দুই দেশ সমন্বিতভাবে করেছে।
গবেষকরা বলেছেন, কাতারের আল আরাবি নেটওয়ার্কের লন্ডনভিত্তিক উপস্থাপক রানিয়া দ্রিদিকেও হ্যাক করা হয়। সিটিজেন ল্যাবের ভাষ্য, তাদের কাছে যুক্তিপ্রমাণ রয়েছে যে, ২০১৯ সালের অক্টোবর এবং ২০২০ সালের জুলাই- এই সময়ের মধ্যে তার ফোন ছয়বার হ্যাক করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে কাতারের বিরুদ্ধে আমিরাত, মিশর, সৌদি আরব ও বাহরাইনের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক রয়েছে। এই চার দেশের দাবি, কাতার সন্ত্রাসবাদের সমর্থক এবং ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। তাই কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করে দেয় এই চার দেশ। এই নিষেধাজ্ঞা জারির পরই চারটি দেশ কাতারের সব নাগরিককে নিজেদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে।
কাতার গোড়া থেকেই বলে আসছে, তারা সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেয় না। জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেয় না। ওই চার দেশ তিন বছর আগে যখন নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখনই জানিয়েছিল, ১৩ দফা দাবি মানলে তারা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। কিন্তু কাতার তা মানতে চায়নি। ১৩ দাবির মধ্যে অন্যতম প্রধান দাবি ছিল, কাতারের সংবাদসংস্থা আলজাজিরাকে বন্ধ করে দিতে হবে।
কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের চাপিয়ে দেওয়া অবরোধ অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ। তবে এ বিষয়ে সৌদি জোটের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ অ্যালেনা ডুহান বলেছেন, কাতারের সঙ্গে সৌদি জোটের অবরোধের মূলে সন্ত্রাসবাদ নয়, আঞ্চলিক ঝামেলা। এভাবে একটি দেশের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার হরণ করে সরকারকে শিক্ষা দেওয়ার নীতি কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়।
আলজাজিরা বন্ধের দাবির বিষয়ে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবিরোধী আইন করেছে কাতার সরকার। তারপরও অবরোধ অব্যাহত রাখাটা অমানবিক।
এদিকে, সৌদি হুমকি উপেক্ষা করে ইরান, তুরস্ক ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করে কাতার। দেশটিতে বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের নামে তৈরি তুর্কি ঘাঁটিতে থানি সরকারের সমর্থনে কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দেশটিতে তুরস্ক ও ইরান জরুরি খাদ্যসহ অন্যান্য সামগ্রী পাঠিয়ে পাশে দাঁড়ানোয় সৌদি জোটের অবরোধ ভেস্তে যায়।
সম্প্রতি তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, শুধু কাতার নয়, পুরো পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কাতারে তাদের সেনারা অবস্থান করছেন। এর জবাবে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেন আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ।
এদিকে, কাতারের ওপর আরোপ করা অবরোধের অবসান ঘটাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও।
হোয়াইট হাউজের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও ট্রাম্প জামাতা জ্যারেড কুশনারের সফরের পর কাতারের ওপর উপসাগরীয় দেশগুলোর দেওয়া অবরোধ প্রত্যাহার নিয়ে পক্ষগুলো বেশ তৎপর।
ইসরাইল কি সৌদি-কাতার সম্পর্ক চাচ্ছে না? দেশটি কি আরব ঐক্যে ফাটল রাখতে চাচ্ছে? এনএসও কি সেই চাওয়ায় রসদ জোগাচ্ছে? সৌদি প্রভাবাধীন দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের নতুন সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে