ন্যাটোর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ সামরিক শক্তির দেশ তুরস্ক। রাশিয়া থেকে আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এস-ফোর হান্ড্রেড কেনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন তুরস্ককে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে আসছিলো। কিন্তু সে সব হুমকিকে তোয়াক্কা না করে যখন তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এস ফোর-হান্ড্রেড কিনেই ফেলেন, তখন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পখাতকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ দিয়েছে। কিন্তু এই অবরোধকে কেন্দ্র আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
গত এপ্রিলে তুরস্কের এস-ফোর হান্ড্রেড অপারেশনে যাওয়ার পর মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বেশ কয়েকজন এবং সিনেট সদস্যরা তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপ করার জন্য কয়েকদফা বিল আনেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অসহযোগিতার কারণে সে প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্থ হলেও শেষ পর্যন্ত অবরোধ আরোপের পক্ষেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমানও কেনার একটি প্রস্তাবও প্রত্যাখান করে- যা যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ক্ষেপিয়ে তোলে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে গত ১৫ ডিসেম্বর। আংকারা ও মস্কো উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের কারণে তুরস্ক হয়তো রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও ইরানকে নিয়ে একটি ব্লক গড়ার দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়তে পারে।
ইরানও দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অবারোধের মুখে আছে। বিদায়ী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকবার তুরস্ককে স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে যে, যদি রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড কেনে তাহলে এ অঞ্চলে থাকা মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। সেই সাথে, নতুন এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে তুরস্কের সেনাবাহিনী ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাশিয়া প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে যাবে। যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কখনোই স্বস্তিদায়ক হবে না। পম্পেও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এস ফোর হান্ড্রেড নিয়ে সমস্যা সমাধানের আহবান জানিয়েছেন। এ অবরোধের কারনে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির লাইসেন্সটি নিষিদ্ধ হবে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে।
এ অবরোধের কারণে মার্কিনবিরোধী সব মহল বিশেষ করে আফগান তালিবান, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, রাশিয়া, চীন এবং পাকিস্তান- সবগুলো দেশ এক কাতারে চলে আসবে। বর্তমানে এ দেশগুলোর সবাই কোনঠাসা অবস্থায় পড়ে গেছে।
তুরস্কের সাথে এমনিতেও অনেকদিন ধরে ফ্রান্স, গ্রিস ও আরো বেশ কয়েকটি আরব দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন যাচ্ছে। সম্প্রতি নাগারনো কারাবাখ নিয়ে যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষে এবং রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষে অবস্থান নিলেও এই যুদ্ধ তুরস্ককে রাশিয়ার স্থায়ী কোনো শত্রুতে পরিণত করেনি। পাকিস্তান এ যুদ্ধে তুরস্কের মতোই আজারবাইজানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দী ভারত সমর্থন করেছে আর্মেনিয়াকে। অর্থাৎ নাগারনো-কারাবাখের যুদ্ধকে কেন্দ্র করেও বিশ্বে আরেক দফা মেরুকরণ হয়ে গেছে।
ভারত অবশ্য এখন পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। তাই তুরস্কের পর নিকট ভবিষ্যতে যদি পাকিস্তানের ওপরও যুক্তরাষ্ট্র একই ধরণের অবরোধ আরোপ করে তাহলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। যদিও রাশিয়ার এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিনতে ভারত মস্কোর সাথে চুক্তি করেছে। তারপরও ভারতকে কখনোই যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের মতো করে কোনঠাসা করবে বলে মনে হয় না।
গ্রীসের সাথে তুরস্কের বিরোধ এবং তাতে রাশিয়া যেভাবে সমর্থন দিচ্ছে তা নিয়ে ফ্রান্স ও ইউরোপের আরো বেশ কয়েকটি দেশ সংশয়ে পড়ে গেছে। পরিস্থিতিকে সামাল দিতে কিংবা একদিকের চাপ থেকে বাঁচার জন্য তুরস্ক নীরবে ন্যাটো থেকে বের হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তুরস্কের জন্য এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ন্যাটো ত্যাগ করলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ইসরাইল। কারণ তুরস্ক যেভাবে সামরিক দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে উঠছে ইসরাইল তা মোটেও ভালো ভাবে মেনে নিতে পারছে না।
এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আয়া সোফিয়া মসজিদ পুনরায় চালু করার সময় জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করার কথাও বলেছিলেন। যা ইসরাইলের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এরদোয়ান সেদিন বলেছিলেন, জেরুজালেম এক সময় সাবেক অটোম্যান সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল এবং তিনি জেরুজালেমকে আবার সেভাবেই জয় করার স্বপ্ন দেখেন। শুধু ইসরাইলের মতো ইহুদি রাষ্ট্রই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র কাতার ছাড়া আর সবগুলো দেশেরই তুরস্ককে নিয়ে দ্বিধা ও উদ্বেগেরে মধ্যে রয়েছে।
আগামী দিনের বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, হয়তো পৃথিবীতে দুটো ব্লক খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। একদিকে থাকবে, সবগুলো আরব দেশ, যেখানে ইসরাইল ও ভারতও সংযুক্ত থাকবে। কাতারের সাথে সৌদি বাদশাহ সালমানের সম্পর্ক মেরামত করার যে প্রক্রিয়া তাতে অনেকেই মনে করছেন যে, বাদশাহ সালমান বোধ হয় কাতারকেও এ ব্লকে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন।
সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের পরিকল্পনা হলো, কাতারের আল উদেইব সামরিক ঘাটিকে ইরান আক্রমনের কাজে ব্যবহার করা। এমন হুমকিও দেয়া হয়েছে যে, কাতারকে অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে হবে। তা না হলে, ২০২২ সালে ফিফা বিশ্বকাপের স্বাগতিক রাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে কাতারের যে অবস্থান তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আগামী দিনগুলোতে চীনের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক আরো উন্নত হতে পারে। পাকিস্তান এক্ষেত্রে চীনকে তুরস্কের কাছাকাছি নেয়ার চেষ্টা করছে। আর চীন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী যে কোনো দেশের সাথেই গাটছড়া বাঁধতে রাজি। অন্যদিকে, রাশিয়ার সাথে দীর্ঘদিনের সামরিক সম্পর্ক থাকলেও ভারত এবার রাশিয়াকে একটু সরিয়ে যেন আমেরিকার সাথে সর্ম্পক ঘনিষ্ট করছে।
গত আগস্টে আমেরিকার সাথে বেসিক এক্সচেঞ্জ করিডোর চুক্তি হওয়ার পর থেকে ভারত রাশিয়ার সাথে পূর্ব নির্ধারিত কাভকাজ ২০২০ মহড়া থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শেষ পর্যায়ে এসে মেরুকরনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আগামীতে বাইডেন কী কৌশল অবলম্বন করেন, তাই এখন দেখার বিষয়। তবে এরদোয়ানকে মনে করা হয় সবচেয়ে বাস্তববাদী নেতা। যিনি খুব পরিকল্পিতভাবে ও হিসেব কষে এ অঞ্চলের ভুরাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি দরকষাকষি করতে সক্ষম। কোন কার্ড কখন খেলতে হবে তা ভালো জানেন। সেটা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যার সাথে হোক না কেন। কোনো সরল হিসাবে চলার লোক যেমন তিনি নন তেমনি ভূকৌশলগত স্বার্থে তিনি নিজের অবস্থান তৈরি করতেও সক্ষম।
ফিলিস্তিন সংকটকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো কৌশল স্থায়ী হবে না। বারাক ওবামা যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যই আশা আর স্বপ্নে বুক বেঁধেছিল। জো বাইডেন যখন আমেরিকার মসনদে বসতে যাচ্ছেন, তখন সে ধরনের কোনো আশার ফুলঝুড়ি শোনা যাচ্ছে না। বরং এ অঞ্চলের মানুষ এখন আর বিশ্বাসই করে না যে, বাইডেন এসে নতুন কিছু করবেন বা ট্রাম্পের নীতি থেকে একেবারে ইউটার্ন করে ভিন্নভাবে দেশ চালাবেন। বিশেষ করে ফিলিস্তি ইস্যুতে ট্রাম্প যা করে গেছেন, বাইডেন তার থেকে খুব আলাদা হবে বলে কেউই মনে করছে না।
একটির পর একটি আরব দেশকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। পশ্চিম তীরে নতুন নতুন ইহুদি বসতি তৈরি করা হচ্ছে। ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তথাকথিত আবরাহাম চুক্তি বা ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির নামে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের গোটা পরিস্থিতিকে যেভাবে একদিকে টেনে নিয়ে গেছেন, তার উল্টো দিকে যাওয়া বাইডেনের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।
তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছে, ট্রাম্পের একপেশে মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণেই গোটা অঞ্চলে সমস্যা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরাইল এরই মধ্যে পুরনো জেরুজালেম থেকে আরবদেরকে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্ছেদ করে শহরের মানচিত্রটাই বদলে দিতে চায়। বিগত ২০ বছরে অধিকৃত ভূখন্ড বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতির সংখ্যা ২ লাখ বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। জেরুজালেম শহরে ২০১১ সালে সর্বশেষ যে আদমশুমারি হয়েছিল তাতে দেখা গেছে শহরে মুসলিম নাগরিকের সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র ৩৬ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গনতন্ত্রপন্থী ব্যক্তিরা চায় ১৯৬৭ সাল পূর্ববর্তী মানচিত্রের আলোকে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল নামক দুটো রাষ্ট্র গঠিত হোক। এ প্রস্তাবে জেরুজালেমকে দুটোর কোনো দেশকেই না দিয়ে বরং উভয়ের জন্য উম্মুক্ত রাখার কথাও বলা হয়। ইসরাইলের মধ্যে আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি বেড়ে যাওয়ায় শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা বেড়েই চলছে।
ইসরাইলী জনগনের ওপর বেশ কয়েকটি জরিপ চালানো হয়েছে। তাতে দেখা যায়, অধিকাংশ ইহুদিও একটি দ্বি রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষেই মত দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরাইলের নীতি নির্ধারকেরা বরাবরই জনগনের সে আকাঙ্খা অবজ্ঞা করেছে। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ও এ বিষয়ে কোনো কার্যকর উদ্যেগই নিতে পারেনি। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অন্ধকারের ঘনঘটা আগের মতোই থেকে গেছে, বরং আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে