তুরস্কের মহাকাশ যাত্রায় নতুন দিগন্ত


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১২ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:০৩

মহাকাশে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে তুরস্ক। নতুন বছরের শুরুতে আরও একটি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠিয়েছে দেশটি। নিজেরাই স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শুরু করেছে। এর পাশাপাশি স্যাটেলাইট লঞ্চপ্যাড তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এর ফলে মহাকাশে নিজেদের দাপট দেখানোর পথে আরও একধাপ অগ্রসর হলো তুরস্ক।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি লঞ্চপ্যাড থেকে গত ৭ জানুয়ারি তুরস্কের একটি স্যাটেলাইট নিয়ে মহাশূন্যে গেছে স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেট। তুর্কসাট ফাইভ-এ নামের স্যাটেলাইটটি নিয়ে মহাশূন্যে গেছে ইউএস অ্যারোস্পেস কোম্পানির তৈরি ২৩০ ফুট লম্বা রকেটটি। এটি তুরস্কের উৎক্ষেপিত সপ্তম স্যাটেলাইট।

এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, তুর্কসাট ফাইভ-এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তুরস্ক আগামী ৩০ বছরের জন্য কক্ষপথে তার অধিকার নিশ্চিত করবে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রোগ্রামে যোগ দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্যাটেলাইটটি তুরস্ককে উন্নত টেলিভিশন সেবা দেবে এবং ব্রডব্যান্ড ডাটা নেটওয়ার্ককে আরও উন্নত করবে। কক্ষপথের ৩১ ডিগ্রি পূর্বে তুরস্কের একটি অব্যবহৃত অরবিটাল স্লটে অবস্থান করবে এটি। এরদোয়ান জানান, নতুন স্যাটেলাইট কক্ষপথে সক্রিয় হলে তুরস্কের স্যাটেলাইটের সংখ্যা দাঁড়বে ৭-এ।

তুরস্কের এর আগে উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে তুর্কসাট থ্রি-এ, তুর্কসাট ফোর-এ এবং ফোর-বি ছিল যোগাযোগ স্যাটেলাইট। আর গোকতুর্ক-ওয়ান, টু এবং রাসাত নামের স্যাটেলাইট তিনটি ছিল পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট।

তুরস্কের পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এবার উৎক্ষেপিত তুর্কসাট ফাইভ-এ স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌছতে সময় লাগবে চার মাস বা তার সামান্য কিছু বেশি সময়। আর সেটি সেবা দিতে শুরু করবে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে।

উৎক্ষেপণের দিন ফ্লোরিডার কেপ কানাভেরালে স্পেসএক্সের মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন তুরস্কের পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ওমর ফাতিহ সায়ান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত উন্নত ইন্টারনেট সেবা পৌছে দিতে পারবে তুর্কি প্রতিষ্ঠানগুলো। যার মাধ্যমে পুরো দেশ দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবার আওতায় চলে আসবে। আর মহাশূন্য বিষয়ে তুরস্কের সামর্থের প্রমাণ পাবে সারা বিশ^।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার বক্তৃতায় জানিয়েছেন, স্যাটেলাইটটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিশাল অঞ্চলসহ ভূমধ্যসগার, আজিয়ান সাগর ও কৃষ্ণসাগর এলাকা কাভার করবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, এই স্যাটেলাইট নতুন সেবা দেয়ার পাশাপাশি আগের তিনটি স্যাটেলাইটের ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, যে ৩০টি দেশের মহাশূন্যে অধিকার রয়েছে, তুরস্ক তার একটি।

তুরস্কের এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ছিলো এই সেক্টরের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের নতুন বছরের প্রথম স্যাটেলাই উৎপেক্ষপণ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও বিশে^র সেরা ধনী এলন মাস্ক এই এই উৎক্ষেপণের সরাসরি সম্প্রচারের দৃশ্য শেয়ার করেছেন নিজের টুইটার একাউন্ট থেকে।

তুরস্কের পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রী আদিল কারা-ইসমাইলগলু জানিয়েছেন, উৎক্ষেপণের ৩৫ মিনিটের মাথায় তুর্কসাট ফাইভ-এ স্যাটেলাইট থেকে প্রথম সিগনাল এসেছে। সব কিছু ঠিকভাবে চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই যাত্রায় সময় লাগবে চার মাস। এরপর আমরা এই স্যাটেলাইটের পরীক্ষা চালাবো কিছুদিন, তারপর এটি পুরোদমে কাজের জন্য সক্রিয় করা হবে।

২০১৭ সালে নেদারল্যান্ড ভিত্তিক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের সাথে দুটি স্যাটেলাইট নির্মাণের চুক্তি করে তুরস্ক। তার প্রথমটি তুর্কসাট ফাইভ-এ। তুরস্কের স্যটেলাইট কমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান তুর্কসাট, টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ ও এয়ারবাস যৌথভাবে স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করেছে। গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুর্কসাটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর কয়েক দফা পিছিয়ে সেটি উৎক্ষেপণ করা হয় নতুন বছরের শুরুতে।

৪২টি ট্রান্সপন্ডার নিয়ে মহাকাশে যাওয়া এই স্যাটেলাইটির মাধ্যমে তুরস্ক পাবে কু-ব্যান্ড টেলিভিশন সম্প্রচার সুবিধা।এটির নিয়ন্ত্রণ করা হবে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার গোলবাসি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে। ১৪০ দিন পর কক্ষপথে পৌছা স্যাটেলাইটিকে এখান থেকেই এক মাসের পরীক্ষামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হবে প্রথমে। এরপর এটি পুরোপুরি সক্রিয় করা হবে।

যে কোনো সাধারণ স্যাটেলাইটের চেয়ে এটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ৩০ বছর সেবা দেবে তুরস্ককে। এটি থেকে প্রাপ্ত সেবা বিদেশেও রফতানি করতে পারবে দেশটি। সাড়ে তিন কেজি ওজনের স্যাটেলাইটটি নিজের প্রয়োজনে ১২ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উদপাদন করবে।

একই সিরিজের পরবর্তী স্যাটেলাইট তুর্কসাট ফাইভ-বি’র নির্মাণ কাজও শেষের পথে। চলতি বছর জুন মাসেই সেটি মহাশূন্যে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে তুরস্কের। কক্ষপথের ৪২ ডিগ্রি পূর্বে অবস্থান নিবে স্যাটেলাইটটি এবং সেটি তুরস্ককে দেবে উন্নত কা-ব্যান্ড টেলিকাস্ট সুবিধা। দুটি স্যাটেলাইট তুরস্কের ইন্টারনেট যোগাযোগ ও সম্প্রচার ব্যবস্থায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছেন দেশটির বিজ্ঞানীরা।

শুধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণই নয়, নিজস্বভাবে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট তৈরির কাজও শুরু করেছে তুরস্ক। তুর্কসাট ফাইভ-এ স্যাাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তার দেশ ইতোমধ্যেই নিজস্বভাবে স্যাটেলাইট উৎপাদনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তিনি জানান, ২০২০ সালে তুরস্ক নিজেদের তৈরি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট মহাশূন্যে পাঠাবে।

নিজেদের তৈরি প্রথম স্যাটেলাইটটি হবে হাই রেজুলেশনের স্যাটেলাইট। এরদোয়ান বলেন, ২০২২ সালে আমরা নিজস্ব উৎপাদিত তুর্কসাট সিক্স-এ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট পাঠাবো মহাশূন্যে।

রাজধানী আঙ্কারায় সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তুর্কসাট সিক্স-এ স্যাটেলাইট নির্মাণ করছে তুরস্ক। দেশটির পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কয়েকটি তুর্কি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে এটি। এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে তুর্কসাট। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ, আসেলসান, সি-কেট এবং তুরস্কের শীর্ষ বিজ্ঞান সংস্থা সাইন্টিফিক এন্ড টেকনোলজি রিসার্চ কাউন্সিল অব টার্কি।

এখন পর্যন্ত বিশে^ নয়টি দেশ নিজস্বভাবে স্যাটেলাইট উৎপাদন করছে। এই তালিকায় ১০ম দেশ হিসেবে যোগ হবে তুরস্ক। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তুরস্ক সরকারের সাথে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক চুক্তির মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের শুরু হয়।সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, তুর্কসাট সিক্স-এ স্যাটেলাইন নির্মাণের প্রোকৌশলগত দিক ও ফ্লাইট মডেল বিষয়ক কাজ দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এ বিষয় জাতিকে শীঘ্রই সুসংবাদ দিতে পারবে তারা।

অবশ্য এর আগেও বিদেশী কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে স্যাটেলাইট তৈরি করেছে তুরস্ক। ২০১১ সালের ১৭ আগস্ট রাশিয়ার একটি লঞ্চপ্যাড থেকে মহাশূন্যে পাঠানো হয় রাসাত নামের স্যাটেলাইটটি। যেটি ছিলো তুরস্কের পাঠানো দ্বিতীয় আর নিজেদের তৈরি প্রথম পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট। এবং প্রথম নির্মাণেই দারুণ সফলতা দেখিয়েছে তুবিতাক স্পেস টেকনোলজি নামের প্রতিষ্ঠানটি। সম্ভাব্য তিন বছরের লাইফটাইম দিয়ে স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করা হলেও সেটি ইতোমধ্যে সফলভাবে মহাশূন্যে কাটিয়েছে সাড়ে নয় বছর। তুরস্ক আরেকটি পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে ২০১৬ সালে- যেটি ব্যবহৃত হয় দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দাবৃত্তি ও নজরদারির কাজে।

নজরদারির কাজে এর আগেও স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে তুরস্ক। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গোকতুর্ক-টু নামের একটি হাই রেজুলেশন স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে দেশটি। তুবিতাক স্পেস টেকনোলজিসের অর্থায়নে প্রকল্পটিতে সহযোগি ছিলো টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। এই স্যাটেলাইটটিও তুর্কি সামরিক বাহিনীর তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারির কাজে ব্যাপক অগ্রগতি এনে দেয়। এটির রয়েছে হাইস্পিড ডাটা কমিউনিকেশন সিস্টেম, যার মাধ্যমে এটি কক্ষপথে আবর্তনের সময় একবারেই প্রায় ৬৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলের ছবি তুলতে পারে।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও নির্মাণ শুধু নয়, নতুন বছরে মহাশূন্য নিয়ে বিশাল এক কর্মসুচি হাতে নিয়েছে তুরস্ক। দেশটির এই কর্মসূচির নাম ন্যাশনাল স্পেস প্রোগ্রাম। টার্কি স্পেস এজেন্সির ১০ বছর মেয়াদি এই প্রোগ্রামটি শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে। যার শেষ হবে ২০৩০ সালে। ২০১৮ সালে তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করে স্পেস এজেন্সি। দেশটির মহাশূন্য গবেষণায় নতুন পদক্ষেপ শুরু হয় এর মাধ্যমে। মহাশূন্য বিষয়ক কৌশল ও নীতি নির্ধারণ এবং নিজস্ব ভাবে মহাশূন্য শিল্প প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইতোমধ্যেইজানিয়েছেন, তার দেশ ক্ষুদ্র আকৃতির মাইক্রোস্যাটেলাইট তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। বর্তমানে অনেক দেশই মাইক্রো স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে মহাশূন্যে। যে কারণে শুধু উৎপাদনই নয়, মাইক্রো স্যাাটেলাইট উৎক্ষেপণের লঞ্চপ্যাডও তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে তুরস্ক। এরদোয়ান বলেন, এই উদ্যোশ্য আমরা মাইক্রো স্যাটেলাইট লঞ্চপ্যাড স্থাপন করছি। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ^বিদ্যালয় এবং বেসরকারিখাতকে এই স্যাটেলাইট তৈরিতে আমরা সহযোগিতা দিয়ে চলেছি।

তুরস্ক প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল ১৯৯৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। কিন্তু সেই উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। উৎক্ষেপণের ১২ মিনিটের মাথায় কারিগরি ত্রুটির কারণে তুর্কসাট ওয়ান-এ স্যাটেলাইটটি বিধ্বস্ত হয় সমুদ্রে। তবে এই সেক্টরে বিনিয়োগ আর প্রচেষ্টার ধারবাহিকতা রক্ষা করেছে দেশটি। যার ফলস্বরূপ একই বছর আগস্টে তুর্কসাট ওয়ান-বি নামের দ্বিতীয় স্যাটেলাইটটি তারা সফলভাবে পাঠাতে পেরেছে পৃথিবীর কক্ষপথে।

মহাকাশ প্রযুক্তিতে তুরস্কের এই সাফল্য দেশটির অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে তাতে সন্দেহ নেই।সামরিক, কূটনৈতিক দিক থেকে ক্রমশ নিজেদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এরদোয়ানের দেশ মহাকাশ প্রযুক্তিখাতেও কতটা অগ্রসর হচ্ছে সেটির বড় প্রমাণ তাদের এই স্যাটেলাইট প্রকল্পগুলো।