তুরস্ক : নতুন গেইমের প্রধান খেলোয়াড়

-

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৩৩

বিশ্বজুড়ে যখন ক্রমাগত বিভাজন সৃষ্টি আর সেই বিভাজন থেকে ফায়দা হাসিলের প্রতিযোগিতা চলছে, তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নতুন এক সুপারস্টার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস এডভারসারিস থ্রু স্যাংকশনস অ্যাক্ট’ তথা কাটসার আলোকে আঙ্কারার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তুরস্কের অপরাধ- তারা মার্কিন আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সমরাস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত এজেন্সি এসএসবির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তুরস্ক এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তুরস্ক কোনোভাবেই মাথানত করবে না। বরং কীভাবে এ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলা করবে, দেশটি এখন সে কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত রয়েছে।

অবরোধ জারির পরও তুরস্ক একদিকে যেমন তার প্রতিরক্ষা অস্ত্র নির্মাণ ও বিপণন কার্যক্রম চালু রেখেছে, ঠিক তেমনি আবার আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে নানা ধরনের কৌশলও অবলম্বন করছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, তিনি যেন নতুন করে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিয়েভে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকটি ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ।

রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকেই ইউক্রেনের ওপর চড়াও হয়ে আছে। রাশিয়ার সাথে সিরিয়া ইস্যুতে তুরস্কের একটি কৌশলী সম্পর্ক আছে। এমন অবস্থায় ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের এ গাটছড়াকে বিশ্লেষকরা নতুন কোনো মেরুকরণের ইংগিত বলেই মনে করছেন।

তুরস্কের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকে। সে বছরই কিয়েভে পশ্চিমা সমর্থকপুষ্ট সরকারের বদল হয়। গত বছরের মে মাসে ভøাদিমির জেলেংস্কি দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এ সম্পর্ক আরো ভিন্ন মাত্রা পায়। নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে আজারবাইজান তুরস্কের সহায়তা নিয়ে জয়ী হওয়ায় ইউক্রেনের নীতি নির্ধারকরা তুরস্কের ব্যাপারে আরো আগ্রহী হয়ে উঠেন।

যুদ্ধচলাকালীন অবস্থায়ই জেলেংস্কি অক্টোবরে তুরস্ক সফরে যান। এ সময় তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এরদোয়ানও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে তার দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং বলেন, গোটা অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনের ভূমিকা অপরিসীম। এরদোয়ান আরো বলেন, ২০১৪ সালে রাশিয়া যেভাবে ক্রিমিয়াকে জোরপূর্বক নিজেদের মানচিত্রে শামিল করার চেষ্টা করেছে তুরস্ক তা কখনোই সমর্থন করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।

জেলেংস্কি তুরস্কের এ ঘোষণায় রীতিমতো উদ্বেলিত হন। তিনি জানান, তুরস্ক ও ইউক্রেন যৌথভাবে কৃষ্ণসাগর এলাকাকে সুরক্ষা করার জন্য দুটো নৌ ঘাটি স্থাপন করবে। তুরস্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা খাতে যেভাবে এগিয়ে আসছে, ইউক্রেন সেখানে অন্যতম সহযোগি হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে, টার্বোপ্রোপ, ডিজেল ইঞ্জিন, এভিওনিক্স, ড্রোনস, এন্টি শীপ, ক্রুজ মিসাইল, রাডারসহ মহাকাশ ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি সরবরাহেও ইউক্রেন তুরস্ককে সহায়তা করেছে।

সাবেক সেভিয়েত যুগ থেকেই প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে ইউক্রেন তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনের সমরাস্ত্র উন্নয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে তুরস্ক বিনিয়োগ করছে। ইউক্রেনের ইঞ্জিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মোটর সিকেও তুরস্ক বড়ো একটি শেয়ার ক্রয় করেছে। তুরস্ক ইউক্রেনের সাথে মিলে যৌথভাবে কমব্যাট ড্রোন নির্মাণেও কাজ শুরু করেছে। এসব ড্রোনসহ অন্যান্য সমরাস্ত্র নির্মাণ প্রযুক্তির কৌশলও ইউক্রেন এরই মধ্যে তুরস্ককে দিয়েছে।

তুরস্কের মহাকাশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান রকেটসান বেশ অনেকদিন ধরেই রকেট ও মিসাইল নির্মাণ করে আসছে। এবার ইউক্রেন মহাশূন্যখাতেও তুরস্ক এবং রকেটসানকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। তুরস্কের টিএফএক্স যুদ্ধ বিমান প্রকল্পেও ইউক্রেন জেট ইঞ্জিন নির্মাণে সহায়তা করবে। আগামীতে দুই দেশ মিলে সামরিক স্যাটেলাইট নির্মাণের বিষয়েও একমত হয়েছে।

অন্যদিকে, তুরস্ক ইউক্রেনকে বেরাকতার জাতীয় নজরদারি ও সশস্ত্র ড্রোন সরবরাহ এবং আটমাকা এন্টি শিপ মিসাইল দিতে রাজি হয়েছে। তুরস্ক আর ইউক্রেন মিলে বর্তমানে যৌথভাবে ৫০টি সামরিক প্রকল্প পরিচালনা করছে। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কারাবাখের যুদ্ধে আজারবাইজান যে কৌশলে আর্মেনিয়া থেকে তাদের অধিকৃত এলাকাকে উদ্ধার করেছে, ইউক্রেনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে একই কৌশল প্রয়োগ করতে পারে। এক্ষেত্রে ইউক্রেন, ক্রিমিয়া এবং কার্চ প্রণালীর ওপর দিয়ে ড্রোনও ব্যবহার করতে পারে।

ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুলেবা দিমিত্রো ডিসেম্বরে তুরস্ক সফর করেন। সে সময় তিনি সাবেক অটোম্যান সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ক্রিমিয়া ইস্যুতেও তুরস্ক সাবেক অটোম্যানদের মতোই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।

কৃষ্ণসাগরকে কেন্দ্র করে ন্যাটো সক্রিয় হতে শুরু করেছে। ন্যাটোভুক্ত অধিকাংশ দেশই এ অঞ্চলে রাশিয়ার খবরদারি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ সময়ে তুরস্কের সাথে ইউক্রেনের উষ্ণ সম্পর্ক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নতুন মেরুকরণের বার্তা দিচ্ছে। রাশিয়ার সাথে যেখানে তুরস্কের সমঝোতামূলক সম্পর্ক আছে। সেখানে রাশিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে এমন কিছু ভূমিকা তুরস্ক কেন নিচ্ছে, তা নিয়ও প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে মনে করেন, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার একচেটিয়া আধিপত্যকে তুরস্ক চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে। লিবিয়া ও সিরিয়ায় যেভাবে রাশিয়া তুরস্কের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে চাইছে। ইউক্রেন ও ন্যাটোকে সাথে নিয়ে তুরস্ক তার জবাব দিচ্ছে।

অনেকে বিশ্লেষক মনে করেন, তুর্কি ড্রোনের সহায়তা নিয়ে আজারবাইজানের মতো ইউক্রেনও রাশিয়ার সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানতে পারে। তবে এরদোয়ান সে পথে হাটবেন বলে মনে হয় না। এরদোয়ান ভালো করেই জানেন, রাশিয়া, ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এখন যুদ্ধ করার অবস্থায় নেই। তাই এরদোয়ানও স্বেচ্ছায় রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়াতে চাইবেন না। এরদোয়ান এটাও জানেন , পশ্চিমারা তুরস্ক ও রাশিয়ার মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে।

কেননা, রাশিয়ার সাথে তুরস্কের দুরত্ব তৈরি হলে তুরস্ক বাধ্য হয়েই ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তাই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও তুরস্কের সাথে সমঝোতাপূর্ন সম্পর্কই বজায় রাখতে চান। ন্যাটো যতই তুরস্কের সাথে সহজ সম্পর্ক করতে আগ্রহী হোক না কেন, ন্যাটোর সাথে তুরস্কের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যথেষ্ট দুরত্ব আছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আপাতত তুুরস্কের নীতি নির্ধারকদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কোনো সহানুভূতিও থাকার কথা নয়।

বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের সাথে সর্ম্পককে একটি অবস্থানে রাখতে সক্ষম হলেও বাইডেন আমলে তা নতুন করে জটিলতার মুখে পড়তে পারে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে যখন এরদোয়ানবিরোধী ক্যু হয়, তখন বাইডেন ওবামা প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। আংকারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ভালো করার শর্ত হিসেবে সেই ক্যু’র নেপথ্যের নায়ক ফেতুল্লাহ গুলেনকে হস্তান্তর করার দাবি করে বসতে পারে। তেমনটা হলে মার্কিন-তুরস্ক সর্ম্পক নতুন করে টানপোড়েনের মুখেও পড়তে পারে।

তুরস্ক শুধু কৃষ্ণসাগরেই কৌশলী ভূমিকা পালন করছে তা নয়। উপমহাদেশসহ গোটা এশিয়াতেও তুরস্ক গেইম চেঞ্জারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছর থেকেই ইস্তাম্বুল-তেহরান ও ইসলামাবাদের মধ্যে কার্গো ট্রেন চালু হবে। এ তিন দেশের যোগাযোগ মন্ত্রীরা সম্প্রতি ইকোনোমিক কোপারেশন অর্গানেইজেশনের বৈঠকে ইস্তানবুলে মিলিত হয়েছিলেন।

তুরস্ক আশা করছে, এ প্রকল্পটি তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করবে। এ রেললাইনটি ইরানের মধ্য দিয়ে যাবে এবং তুরস্ক ও পাকিস্তানের ভূখন্ডের মোট ৬৫০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছে। এ বিশাল রেল লাইনের ২হাজার ৬শ কিলোমিটার পথ রয়েছে ইরানে, ১ হাজার ৯শ ৫০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে তুরস্কে আর অবশিষ্ট ১ হাজার ৯শ ৯০ কিলোমিটার পথ পাকিস্তানের ওপর দিয়ে।

২০০৯ সালে ইকোনোমিক কোপারেশন অর্গানেইজেশনের ১০টি সদস্যরাষ্ট্র এ বিষয়ে কাজ শুরু করে এবং পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে তৎপর হয়। মূলত সমুদ্র পথ দিয়ে পণ্য পরিবহনে যে অতিরিক্ত সময় লাগে তা কমিয়ে নিয়ে আসার জন্যই এ রেলপথটি নির্মাণ করা হয়।

কার্গো ট্রেনটি পাকিস্তান থেকে ইস্তাম্বুলে পৌঁছতে ১৩ থেকে ১১ দিন লাগতে পারে। এ ট্রেনটিতে সর্বোচ্চ ২০টি ৪০ ফিটের কন্টেইনার থাকতে পারে। ইউরোপ থেকে পণ্য পরিবহন করে পাকিস্তানে আসতে স্বাভাবিকভাবে ৪৫দিন সময় লেগে যায়। এই রেলপথ পন্য পরিবহনে সময় অনেক কমিয়ে আনবে।

কার্গো ট্রেনটি সফলভাবে চালু হওয়ার পর এ তিনটি দেশ নিজেদের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন চালুর বিষয়ও বিবেচনা করছে। এ ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করতে গেলে পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ইরানের তাফতান পর্যন্ত রেলপথটির সংস্কার করতে হবে। এ রেলপথটি ১৯২০ সালে নির্মিত হওয়ায় অনেক স্থানে যাত্রী পরিবহনের উপযোগী নেই। ইতোমধ্যেই পাকিস্তানন ও ইরান উভয় দেশই কোয়েটা থেকে তাফতানে রেলপথ সংস্কারে জরিপ শেষ করেছে।

রেলপথটি নির্মিত হলে পাকিস্তানের সাথে ইরান ও তুরস্কের বাণিজ্যের পরিমাণও অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে। এ অঞ্চলে ভারতের প্রত্যক্ষ ও যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ প্রভাব কমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি ও আমীরাতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ব্লকের কার্যক্রমকে পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য তুরস্ক এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।