হালিমা আডেন : প্রথাবিরোধী এক মডেল

ফ্যাশন জগতে হালিমার টিকে থাকা ও সাফল্যের জন্য তাকে কম সংগ্রাম করতে হয়নি - গেটি ইমেজ

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:০৫

হিজাবের স্বাধীনতার সাথে আপস করতে না পারার কারণে শোবিজ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় মডেল তারকা হালিমা আডেন। পশ্চিমা জগতে প্রথাবিরোধী হিসেবে খ্যাতি পাওয়া হালিমা ছিলেন প্রথম হিজাব পরা মডেল।

হিজাব পরেই তিনি অংশ নিয়েছে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইক, ভোগ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে এমনকি মিস আমেরিকা প্রতিযোগীতায়ও। সম্প্রতি ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু কাজের অনুরোধ আসায় তিনি শোবিজ ছেড়ে দেন। উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম নেয়া হালিমা কিভাবে পশ্চিমা ফ্যাশন জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিভাবে স্রোতের বিপরীতে পাড়ি দিয়েছেন এতটা পথ সেসবই জানাবো আজ।

২০১৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাষ্ট্রের সুন্দরী প্রতিযোগীতায় হৈচৈ ফেললো এক সোমালী বংশোদ্ভূত তরুণী। সে হিজাব পরেই অংশ নিলো প্রতিযোগীতায়। আর যখন সুইমিং স্যুট বা বিকিনি রাউন্ড এলো সে পরলো মুসলিম নারীদের সাতারের জন্য বিশেষভাবে তৈরী পোষাক বুরকিনি। তা সত্ত্বেও একের পর এক ধাপ পাড়ি দিয়ে পৌছে গেল সেমিফাইনালে।

শোবিজ জগতের বিশিষ্টজনদের নজরে এলো মেয়েটি। সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিলেও সে তার পদক্ষেপের মাধ্যমে নতুন একটি ধারা তৈরি করলো যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের শোবিজ জগতে। স্মার্ট, মেধাবী আর নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল মেয়েটির খোঁজ নিতে শুরু করলো বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো। এরপর একই বছর মিস আমেরিকা প্রতিযোগীতায় সে অংশ নিলো এবং সেখানেও তার মাথায় ছিলো হিজাব। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গন্ডি ছাড়িয়ে পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই আলোচনা শুরু হলো তাকে নিয়ে।

কয়েকদিন পর তার সাথে চুক্তি করলো নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা আইএমজি মডেলস; কিন্তু শর্ত ছিলো একটাই নিজস্ব সংস্কৃতি আর ধর্মীয় বিশ^াস বর্জন করতে হয় এমন কোন কাজ তিনি করবেন না। আইএমজি মডেলসের কর্মকর্তারা সে শর্তেই রাজি হলো। শুরু হলো মডেলিং জগতে তার পদচারণা।

মেয়েটির নাম হালিমা আডেন। জন্ম কেনিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে। হালিমার পিতৃপুরুষের ভিটা ছিলো হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের দেশ সোমালিয়ায়। নব্বইয়ের দশকে দেশটির গৃহযুদ্ধের সময় হালিমার বাবা নিখোঁজ হন। হালিমাকে গর্ভে নিয়ে অসংখ্য সোমালী পরিবারের সাথে তার মা জীবন বাচাতে পালিয়ে যান কেনিয়ায়। আশ্রয় হয় কাকুমা শরণার্থী শিবিরে। এখানেই ১৯৯৭ সালে জন্ম হালিমার। তার শৈশব কেটেছে শরনার্থী শিবিরে।

শরণার্থী শিবিরটিতেই মানবেতর পরিস্থিতিতে কেটেছে হালিমার শৈশব। জীবন চলে বটে, কিন্তু সে জীবনের গন্তব্য অনিশ্চিত। তাই তো সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হালিমার মা তাকে নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। হালিমার বয়স তখন ছয় বছর। মিসেউরিতে কিছুদিন থাকার পর মিনেসোটা অঙ্গরাষ্ট্রের সেন্ট ক্লাউডে বাস করতে শুরু করে তারা। এখানেও প্রচন্ড সংগ্রাম করতে হয়েছে এই পরিবারটিকে। স্কুল জীবন শেষ করে এখানেই সেন্ট ক্লাউড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন হালিমা। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ই মডেলিংয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তার। নাম লেখান ২০১৬ মিস মিনেসোটা প্রতিযোগীতায়। আর সেখান থেকেই শুরু হয় তার স্রোতের বিপরীতে পথচলা।

বিজ্ঞাপনী সংস্থা আইএমজি মডেলসের সাথে চুক্তির কয়েকদিন পরই ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার কার্নি রোটিফিল্ডের সিআর ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের মডেল হওয়ার ডাক পান হালিমা। এরপর পা রাখেন সাফল্যের একেকটি নতুন ধাপে। কয়েকদিন পর প্রচ্ছদের মডেল হন ভোগ ম্যাগাজিনের আরবি সংস্করণের। এরপর ডাক আসে ভোগ ইংরেজী সংস্করণ থেকেও। বলা বাহুল্য যে ভোগ ম্যাগাজিনের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোন হিজাবী তরুণী প্রচ্ছদে জায়গা পেয়েছেন। টিনেজারদের জন্য ম্যাগজিনটির পৃথক সংস্করণ ‘টিন ভোগ’ও ডাকে হালিমাকে।

২০১৭ সালের থেকেই মডেলিংয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায় হালিমার। একের পর এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করতে থাকেন তিনি। ওই বছর মার্কিন পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ঈগল প্রথমবারের মতো বাজারে আনে ডেনিম হিজাব। হালিমাকে দিয়েই শুরু হয় এর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। এরপর ইউরোপ আমেরিকার অনেক নামীদামী ফ্যাশন হাউজ হিজাব বাজারে ছাড়ে। মুসলিম নারীদের হাতে পছন্দের পোষাক তুলে দিতে রীতিমতো প্রতিযোগীতায় নামে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফ্যাশন সচেতন মুসলিমরাও পেয়ে যাননিজস্ব পোশাকের নতুন দিগন্ত। বিশে^র নামী ফ্যাশন হাউজগুলোতে এখন যে বিকিনির পাশাপাশি হিজাবও বিক্রি হয়, তার পথটা দেখিয়েছেন হালিমাই।

২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে ডাক পান ৫ ফুট ৫ ইঞ্জি উচ্চতার হালিমা আডেন। সেখানে তিনি র‌্যাম্পে হেঁটেছেন এডিডাসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইজি ও ইতালির ম্যাক্সমারার হয়ে। এছাড়া ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার আলবার্টা ফেরেট্টির একটি পোশাকের জন্য নির্বাচিত করা হয় তাকে।ওই বছর মিস আমেরিকা প্রতিযোগীতার বিচারকও ছিলেন হালিমা।

২০১৯ সালে ফ্যাশন কোম্পানি মোডানিসার সাথে একটি চুক্তি হয় হালিমার। প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম নারীদের জন্য হিজাব, পাগড়িসহ ২৭টি নতুন পণ্য বাজারে আনে। যেগুলোর উদ্বোধন করা হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুল ফ্যাশন উইকে।এটি ছিলো ইউরোপের মুসলিম নারীদের জন্য আরেকটি নতুন দিগন্ত।ওই বছর স্পোর্টস ইলস্ট্রেটেড ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে সুইম স্যুটের মডেল হন হিজাব ও বুরকিনি পরে। ওই ঘটনা প্রসঙ্গে হালিমা বলেছেন, ওই ঘটনাটি ছিলো আমার কমিউনিটি ও পুরো বিশে^র কাছে একটি বার্তা যে, ভিন্ন অতীত, চেহারা কিংবা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট নিয়েও মানুষ কাছাকাছি আসতে পারে।

২০১৮ সালে জাতিসঙ্ঘের সহযোগী সংস্থা ইউনিসেফ তাদের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মনোনীত করে হালিমা আডেনকে। শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। ইউনিসেফের হয়ে শৈশবের স্মৃতিবিজরিত কেনিয়ার কাকুমা শরণার্থী শিবিরে যান হালিমা। উন্নত বিশ্বের এক সুপার মডেল যেন ফিরে পান নিজের শেকড়। ক্যাম্পের প্রতিবেশী ও শৈশবের খেলার সাথীদের খুঁজতে চেষ্টা করেন হালিমা। অনেককে পেয়েও যান। কয়েক ঘণ্টার জন্য হালিমা ফিরে যান হারানো শৈশবে।

ফ্যাশন জগতে হালিমার টিকে থাকা ও সাফল্যের জন্য অবশ্য তাকে কম সংগ্রাম করতে হয়নি। একে তো তার বসবাস ছিলো মিনেসোটায়- যেটি ফ্যাশন জগতের বড় জায়গাগুলো যেমন- মিলান, লন্ডন কিংবা নিউইয়র্ক থেকে অনেক দূরে। গায়ের রং কালো, উচ্চতাও কম। তার ওপর হালিমার পথচলা ছিলো সম্পূর্ণরূপে স্রোতের বিপরীতে। যে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার আগে শর্ত দিতেন পোশাকের ব্যাপারে শালীনতায় তিনি ছাড় দেবে না।

যে কোনো অনুষ্ঠানের ব্যাকস্টেজে পোশাক পরিবর্তনের গণরূমে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন না হালিমা। আয়োজকদের বলতেন, পোশাক পরিবর্তনের জন্য তাকে অবশ্যই আলাদা রুম দিতে হবে। নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকেই যেমন প্রথম দিকে কোন প্রতিষ্ঠান বা ফ্যাশন ডিজাইনার তার প্রতি আগ্রহ দেখায়নি এসব শর্তের কারণে। প্রতিযোগীতা শেষ হওয়ার দুই দিন আগে শেষ পর্যন্ত তার ডাক পড়ে মঞ্চে। হালিমাও যেন এসব মেনেই নিয়েছিলেন।

এক সাক্ষাৎকার দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, নতুন কিছু করতে হলে যে সংগ্রাম করতেই হবে সেটি জানতাম। আমি সেটি জেনেই এই যুদ্ধে নেমেছিলাম। সবাইকে জানাতে চেয়েছি- হিজাব আমার পছন্দ, আমার সংস্কৃতি। আপনাকে সেটি মেনেই আমার সাথে কাজ করতে হবে।

চার বছরের পথ চলায় হালিমাকে এই লড়াইটা করেই যেতে হয়েছে। পরিবার থেকে পাওয়া ধর্মীয় শিক্ষাটাই তাকে এই সাহসটা জুগিয়েছে। পরিবারে আছে ধর্মচর্চা।হালিমার মা আলজাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ও যেটা করছে সেটা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মানানসই নয়। তার চেয়ে যদি স্থায়ী একটা চাকরি পেত আমি খুশি হতাম।

এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে আপোস করা সম্ভব নয়, তাই মডেলিংকে বিদায় বলছি। ছবি : ইনস্টাগ্রাম
এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে আপোস করা সম্ভব নয়, তাই মডেলিংকে বিদায় বলছি। ছবি : ইনস্টাগ্রাম

 

শেষ পর্যন্ত মডেলিং ছাড়তেই বাধ্য হয়েছেন হালিমা। তবে সেটাও মাথা উচু রেখে। বিদায় বেলা বলেছেন, কাল তারা আবার আমাকে ডাকবে; কিন্তু যদি ১০ লাখ ডলারের প্রস্তাবও দেয় তবু হিজাব ছাড়তে পারবো না।

এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে আপোস করা সম্ভব নয়, তাই মডেলিংকে বিদায় বলছি।

স্বকীয়তা রক্ষার লড়াই হিসেবে হালিমার মডেলিং ছাড়ার সিন্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরাও। সুপার মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল হালিমার ইনস্টগ্রাম পোস্টে মন্তব্য করেছেন, নিজের নীতির প্রতি সৎ থাকার জন্য তোমাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। তারকা মডেল গিগি হাদিদ কিংবা সঙ্গীত শিল্পী রিহান্নাও সমর্থন দিয়েছেন হালিমার এই সিদ্ধান্তের প্রতি।

এদিন হিজাব ও পুরো শরীর আবৃত পোশাকের একটি ছবি পোস্ট করে হালিমা লিখেছেন, এটিই আমার এগিয়ে চলার পথ। আপনি আমার সাথে কাজ করতে চাইলে মেনে নিন, অথবা দূরে থাকুন। এই বক্তব্যটির মধ্যে নিহিত রয়েছে হালিমা আডেনের পুরো ক্যারিয়ারের সারমর্ম। তার এই শক্ত অবস্থানের কারণেই এখন অনেক মুসলিম মেয়ে হিজাব পরেই মডেলিংয়ে আসার সাহস পেয়েছেন। ফ্যাশন হাউজগুলোও তাদের জায়গা দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এখন মিলান, লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন উৎসবগুলো হিজাবি মডেলদের দেখা মেলে প্রায়ই। আর হালিমা আডেনই এদের পথিকৃত। ফ্যাশন জগতে আর না থাকলেও এই যে ধারাটি তৈরি করেছেন, তার জন্য হালিমা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরদিন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে