নতুন করে ঝড় তুলেছে তুর্কি মেগা সিরিয়াল ‘আরতুগ্রুল’

তুর্কি মেগা সিরিয়াল ‘আরতুগ্রুল’ এর পোস্টার - ডেইলি সাবাহ

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ২৫ মে ২০২০, ১৪:২৬


তুর্কি সোপ অপেরা ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’। এই সিরিজের দর্শকপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কেবল মুসলিম রাষ্ট্র নয়, আরতুগ্রুল-এর ঢেউ ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে। তুর্কী পরিচালক মেতিন গুনেয়-এর এই নির্মাণ এখন ঝড় তুলছে ইউটিউবে। তুর্কী সংবাদমাধ্যম ডেইলি সাবাহ জানিয়েছে, পাকিস্তানে ইউটিউব ব্যবহারকারীদের কাছে নতুন করে ঝড় তুলেছে আরতুগ্রুল।


পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল পিটিভিতে প্রচার হয় সিরিজটির উর্দু ডাবিং। এতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাক টেলিভিশন দর্শকরা। টিভিতে প্রচারের পর এ বছর রমজানের শুরুর দিন সিরিজের এপিসোডগুলো ছাড়া হয় ইউটিউব চ্যানেলে। মধ্যরমজানেই ওই চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৩০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। তখন পাকিস্তানের ওই টেলিভিশনের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়, রমজানের শেষের দিকে সাবস্ক্রাইবার সংখ্যায় ইতিহাস গড়বে ইতিহাসনির্ভর এই সিরিজ।


গত বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তুরস্ক সফরে গেলে ‘আরতুগ্রুল’ তার নজরে আসে। পরে এটিকে উর্দুতে ডাবিং করার ব্যবস্থা করেন তিনি। ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে এই সিরিজটি সাড়া জাগানোর মতো বলেই মনে করেন পাক প্রধানমন্ত্রী। ইমরান খান বলেছেন, সত্য ইতিহাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিরিজ পিটিভিতে দেখানোর উদ্দেশ্য হলো, জাতিকে ইসলামি ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেওয়া। কারণ, ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ ইসলামি সভ্যতা ইতিহাস ও মুসলিম বীরদের নিপুণভাবে তুলে এনেছে।’


এর আগে একটি সম্মেলনে রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান এবং মাহাথির মুহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ উদ্যোগে মুসলমানদের জন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেল খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। পরে রাজনৈতিক বাস্তবতার ভীড় ঠেলে এই পরিকল্পনা কতটা এগিয়েছে সে ব্যাপারে নতুন কোনো খবর গণমাধ্যমে আসেনি।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোগান নিয়মিত পানি ঢেলে যাচ্ছেন নিজের দেশের ‘সোপ অপেরা’য়। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্মিত হচ্ছে ইতিহাসনির্ভর অসংখ্য সিরিজ। এদের মধ্যেই একটি ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’। তবে এই সিরিজটি সারা বিশ্বে এতোটা সাড়া ফেলবে সেটা স্বয়ং এরদোগানও আন্দাজ করতে পারেননি বলে মন্তব্য করেছেন অনেক বিশ্লেষক। কী আছে এই সিরিজে আসুন জেনে নেই

মেহমেত বোযতাঘ প্রযোজিত এই সিরিজে নায়কের ভ’মিকায় অভিনয় করেছেন এনজিন আলতান দোজায়তান। তার অভিনয় দর্শককে টেনে নিয়ে যায় যাযাবরদের তাঁবুতে। বিশ্লেষকরা মনে করেন ‘এনজিন আলতান’-এর অনবদ্য অভিনয় এই সিরিজকে জনপ্রিয় করতে সহায়ক হয়েছে।


সিরিজটি বানানোর পেছনে পরিচালক মেতিন গুনেয়কে সামলাতে হয়েছে বিশাল আয়োজনের ধকল। যাযাবর জীবনের চিত্র তুলে ধরতে পশ্চিমের দেশ থেকে ভাড়া করে আনতে হয়েছে দক্ষ কোরিওগ্রাফার। শ্যুটিংয়ের সবটাসময়জুড়ে তার সঙ্গে ছিলো ২৫ টি ঘোড়া। আর যাযাবর জীবনের দরকারি অন্য কিছু পশু। এইসব পশুদের চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত ছিলো পশু চিকিৎসক। এদের রাখার জন্য তৈরি করতে হয়েছিলো বড়সর একটি আস্তাবল। আর সেই সময়ের মতো করে বানানো হয়েছিলো যাযাবর জীবনের সেট।


শ্যুটিং-এর এই মহা আয়োজন দেখতে স্পটে ঘুরতে যেতেন অনেকেই। তুর্কি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, অন্তত ২৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’-এর শ্যুটিং দেখতে গিয়েছেন। এই শ্যুটিং সেটে এসে আরতুগ্রুল গাজীর সংগ্রামের ইতিহাস জেনে মুসলমান ধর্মও গ্রহণ করেছিলেন একজন। শুধু তাই নয়, টেলিভিশনের পর্দায় আরতুগ্রুলে প্রভাবিত হয়েও মুসলমান হয়েছেন অনেকে। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে মুসলিম কমিউনিটি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এক মেক্সিকান দম্পতি মুসলমান হন। এই দম্পতিকে পবিত্র কালেমা পাঠ করান ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’-এর চরিত্র আব্দুর রহমান এর ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেতা জালাল আল। মুসলমান হওয়ার পর জালাল আল ওই দম্পতিকে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় দু’টি কুরআন ও তুরস্কের পতাকা উপাহার দিয়েছেন।


মেক্সিকান দম্পতি নিজেদের অনুভ’তি জানিয়ে বলেন, ‘দিরিলিস আতরগুগ্রুল দেখে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমাদের কৌতুহল হয়। পরে বিশ্বজুড়ে তুরস্কের মানবিক কার্যক্রমে প্রভাবিত হয়ে আমরা ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’


তুর্কি সোপ অপেরা আরতুগ্রুল এতোটা শক্তিশালী কেন? এর জবাবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূলত মুসলমানদের সোনালী সময়টাকে চিত্রায়িত করা হয়েছে বলেই বিশ্বের মুসলিমদের এই সিরিজের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ইতিহাসের বাঁকবদলের সময়কে তুলে আনার জন্য অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সিরিজটির প্রতি কৌতুহলী। তাছাড়া এর অভিনয় ও নির্মাণশৈলী নিখুঁত। আর পেছনের গল্পটা ধ্রুপদী। এক যাযাবর জীবনের লড়াই। যাযাবর থেকে পৃথিবী শাসন করার মতো সাম্রাজ্য গঠনের ইতিহাস। যাযাবরদের জীবন অনিশ্চিত। এদের নিজেদের ভ’মি নেই। স্থায়ী ঘর নেই। যেখানেই যান, সঙ্গে করে নিতে হয় তাঁবু। এই তুঁবুতেই এদের জীবন। একদল তাঁবুতে ঘুমুতে গেলে অন্যদলকে জেগে পাহারা দিতে হয়।


এমন-ই এক যাযাবর দল ‘কায়ী’। মধ্য এশিয়া থেকে এরা আনাতোলিয়ায় গিয়ে তাঁবু গাড়ে। এই দলের নেতার নাম সুলাইমান শাহ। তখন আনাতোলিয়ায় ছিলো সেলজুক শাসন। আর ওই এলাকায় ছিলো মঙ্গলদের উৎপাত। ছিলো বাইজেন্টাইন ও ক্রুসেডারদের শত্রুতা। এতে সেলজুক শাসন দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। দুর্বল এই শাসনের প্রতি অনুগত ছিলো ‘কায়ী’দের দল। কেবল এই দল বা গোত্রই নয়। মুসলিম যাযাবরদের সবগুলো গোত্রই ছিলো সেলজুকদের অনুগত। যাযাবরদের একেকটি গোত্রভিত্তিক ছিলো একেকটি সৈন্যদল। এইসব দলের যোদ্ধাদের ডাকা হতো ‘গাজী’। প্রতিটি গোত্রের একজন করে নেতা থাকতো। এরা মঙ্গল, বাইজেন্টাইন ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। ‘কায়ী’ গোত্রের নেতা ছিলেন সোলাইমান শাহ। তার সন্তান আরতুগ্রুল গাজী-ই এই সিরিজের নায়ক।


এক যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে তার নায়োকোচিত আবির্ভাব হয়। এই যুদ্ধটা হয়েছিলো মঙ্গলদের বিরুদ্ধে। তখন সেলজুক শাসক ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ সেলজুকী। ১১২৪ সালে সেলজুক রাজধানী কোনিয়া দখল করতে মঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান বিশাল বাহিনী পাঠান। সেই বাহিনীর তুলনায় সেলজুকদের সক্ষমতা ছিলো নাজুক। সেলজুকরা ধরেই নিয়েছিলেন, মঙ্গলদের বিরুদ্ধে তাদের টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে এগিয়ে এলো ‘কায়ী’ গোত্র। গোত্রপতি সুলাইমান শাহ তার ছেলে আরতুগ্রুলকে পাঠালেন যুদ্ধে। আরতুগ্রুল লড়াই করেন মুসলিম ভাইদের জন্য। সেলজুক সা¤্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য। তার পকেষ সেনাসংখ্যা ছিলো মাত্র চার শ’ ৪৪ জন। সেই যুদ্ধে ‘কায়ী’ গোত্রর এই নেতার বীরত্বের কারণেই বিশাল জয় পায় সেলজুকরা। পালাতে বাধ্য হয় চেঙ্গিস খানের মঙ্গল বাহিনী। আরতুগ্রুলের সাফল্যে মুগ্ধ হন সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ। তিনি আরতুগ্রুলকে ‘বদরের ফেরেশতা’ হিসেবে অভিহীত করেন। এতেই আরতুগ্রুল এর লড়াই শেষ হয়নি। তার বীরত্বের কারণে সেলজুকরা একে একে ফিরে পেতে থাকে হারানো দুর্গ।
আরতুগ্রুলে মুগ্ধ সুলতান আলাউদ্দিন যাযাবর ‘কায়ী’ গোত্রর জন্য আনাতোলিয়ার সুগুতে একটি এলাকা বরাদ্দ দেন। সেই ‘সুগুত’ ছিলো একটি বিন্দুর মতো। পরে এই বিন্দু থেকেই তৈরি হয় ‘সিন্ধু’। অর্থাৎ সুগুত থেকেই যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর পরাক্রমশালী রাজবংশ উসমানীয়দের শাসন। উসমানীয় সাম্রাজ্যর  প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমান ছিলেন সেই যাযাবর বীর আরতুগ্রুল আর তার স্ত্রী হালিমা হাতুন এর সন্তান।


আরতুগ্রুল এর মৃত্যুর পর তার ছেলে উসমান বাবার আসনে বসেন। ‘কায়ী’ গোত্র ও তাদের শাসিত ‘সুগুত’ চলতে থাকে তার নেতৃত্বে। অন্যদিকে সেলজুক শাসকরা আরো দুর্বল হতে থাকে। নিজেদের মধ্যে দেখা দিতে থাকে আরো ফাঁটল। ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে সাম্রাজ্য । আরতুগ্রুল-এর সন্তান উসমান বুঝতে পারেন, এদের দিয়ে কিছুই হবে না। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা তো দূরের কথা, নিজেদের ওজনই বহন করতে পারছে না এই সাম্রাজ্য ।


তাই সাম্রাজ্যর ক্রান্তিলগ্নে নতুন সাম্রাজ্যর  ঘোষণা করেন ওসমান। ১২৯৯ সালে ঘোষণা দেওয়া স্বাধীন এই সাম্রাজ্যটি  পরিচিত ‘ওসমানীয় সা¤্রাজ্য’ নামে। পশ্চিমাদের কাছে বিকৃত নাম ‘অটোমান এমপায়ার’। প্রতাপশালী এই সাম্রাজ্য টিকে ছিলো ১৯২২ সাল পর্যন্ত।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখতে নিচে ক্লিক করুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে